(পঞ্চদশ পর্ব )

বেশির ভাগ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি ডাকযোগে। ডাক-ঠিকানা সংগ্রহ করেছি পত্রিকার হকারের কাছ থেকে। পত্রপত্রিকার দোকানে এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে,পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠা থেকে পত্রিকার ঠিকানা সংগ্রহ করে এনেছি। তারপর ঐ ঠিকানায় লেখা পাঠিয়েছি।

বেশির ভাগ পত্রিকার সম্পাদক বা বিভাগীয় সম্পাদকের সাথে আলাপ-পরিচয় ছিল না। অনেক পত্রিকার অফিসও চেনা-জানা ছিলো না। ডাক যোগেই লেখা পাঠাতাম,পছন্দ হলে পত্রিকা কতৃপক্ষ লেখা ছাপতেন। কোনো কোনো লেখা ছাপা হলেও জানতে পারিনি। হকারের নিকট গিয়ে পরখ করে দেখতে হতো। মিলে গেলে ভালো, আর না হলে ভাবতাম অন্য কিছু।

এবারের প্রসঙ্গ দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকা। দৈনিক আজকের কাগজ ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার একটি দৈনিক সংবাদপত্র। এর প্রথম প্রকাশক ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ এবং সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান। ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া পত্রিকাটি ২০০৭ সালে আর্থিক সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়।

দৈনিক আজকের কাগজ প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই বেশ সুনাম ও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। নাইমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে একদল উদ্যোগী ও নিবেদিতপ্রাণ তরুণ সংবাদকর্মী এতে সম্পৃক্ত হন। তারা তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পত্রিকাটিকে দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় উন্নীত করতে সক্ষম হন। নাইমুল ইসলাম খান এখনও আমাদের সংবাদ-পত্র জগতে ভালোভাবেই টিকে আছেন।

দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত যে কয়টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার সবগুলো আমার সংগ্রহে নেই। হাতের কাছে যা পেয়েছি তার একটি তালিকা তৈরি করেছি। তালিকাটি এরকমঃ

০১. ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’, সামাদ সিকদার। ‘বইমেলা প্রতিদিন’,শেষ মুহূর্তে আয়ু বাড়লো। নতুন প্রকাশিত বইয়ের খবর,তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ ।
০২. ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব’০৮- ০৬- ১৯৯৫।
০৩. ‘সুকান্তর মৃত্যুচিন্তা’, সামাদ সিকদার। প্রকাশকাল, বৃহস্পতিবার ০৭ জুলাই ১৯৯৫, ২৩ ভাদ্র ১৪০২ বঙ্গাব্দ।
০৪. সামাদ সিকদারের কবিতার বই ‘যদি দেখা হয়’। ‘বইমেলা প্রতিদিন’, ‘দুর্যোগের কালো মেঘ কাটতে শুরু করেছে’। নতুন প্রকাশিত বইয়ের খবর, তারিখ ০৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ ।
০৫. সামাদ সিকদারের কবিতার বই ‘যদি দেখা হয়’। ‘বইমেলা প্রতিদিন’, ‘জোয়ারের সঙ্গে প্রথম দেখা এবং গোলাম সমাচার’। নতুন প্রকাশিত বইয়ের খবর, তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ ।
০৬. ‘পালোয়ান’, সামাদ সিকদারের ছড়া। প্রকাশকাল ০৪ এপ্রিল ১৯৯৬।
০৭. ‘সুকান্তের মৃত্যুভাবনা’, সামাদ সিকদার।প্রকাশকাল, বৃহস্পতিবার ২০ জুন ১৯৯৬, ০৬ আষাঢ় ১৪০২ বঙ্গাব্দ।
০৮. ‘দস্যু থেকে দেবী’, সামাদ সিকদারের ছড়া। প্রকাশকাল ১৮ জুলাই ১৯৯৬।

দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বইমেলা প্রতিদিন’ শিরোনামে একটি পাতা বের হতো। এখানে নতুন প্রকাশিত বইয়ের নাম, লেখক, প্রকাশক ও বইটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি থাকতো। বইমেলা প্রতিদিনের বিভাগে অন্য একটি আকর্ষণীয় শিরোনামও থাকতো।

দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার ‘বইমেলা প্রতিদিন’ -এর পাতায় ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ তারিখে অন্যান্য বইয়ের সাথে আমার লেখা ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’ গ্রন্থের খবর প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশক ছিলেন, আজিজ মেহের, ‘বস্তু প্রকাশন,’ পুরানা পল্টন, ঢাকা। বইমেলা প্রতিদিনের অন্য শিরোনামটি ছিল, ‘শেষ মুহূর্তে বইমেলার আয়ু বাড়ল’।

‘বইমেলা প্রতিদিন’- এর ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ তারিখ সংখ্যায় অন্যান্য বইয়ের সাথে আমার লেখা কবিতার বই, ‘যদি দেখা হয়’-এর খবর প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশক,’বিশাকা’ প্রকাশনী। ‘বইমেলা প্রতিদিন’-এর এদিনের অপর শিরোনামটি ছিল, ‘দুর্যোগের কালো মেঘ কাটতে শুরু করেছে’।

দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ তারিখে আবারও আমার লেখা কবিতার বই ‘যদি দেখা হয়’-এর পরিচিতি প্রদান করা হয়। এই দিনের ‘বইমেলা প্রতিদিন’ -এর অন্য শিরোনামটি ছিল,’জোয়ারের সঙ্গে প্রথম দেখা এবং গোলাম সমাচার’। বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের নামানুসারেই এই সুন্দর শিরোনাম।

দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায়, ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব’ শিরোনামে, ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’ গ্রন্থের প্রকাশনার ওপর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশের তারিখ ছিল, ০৮ জুন ১৯৯৫। প্রকাশনা উৎসব বিষয়ে দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় লেখা হয়েছে,

‘সামাদ সিকদার রচিত ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’ গ্রন্থটি সুকান্তর সমস্ত সাহিত্য-কর্মের আলোচনা ও যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ। সুকান্তর ওপর এধরণের বই এই প্রথম। ‘

‘সুকান্তর মৃত্যুচিন্তা’ শিরোনামে আমার লেখা বিরাট একটি নিবন্ধ,দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল, বৃহস্পতিবার ০৭ জুলাই ১৯৯৫, ২৩ ভাদ্র ১৪০২ বঙ্গাব্দ। উল্লেখ্য,দৈনিক আজকের কাগজ লেখার মূল পান্ডুলিপির পুরোটা ছাপেনি।

দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত অর্ধ-পৃষ্ঠারও বেশি ‘সুকান্তর মৃত্যুচিন্তা’ নিবন্ধের শুরুটা ছিল,

কবি ‘বেকস’ জন্ম ও মৃত্যুকে তুলনা করেছেন বল লোফালুফি খেলার সাথে। ‘বেকস’ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সিন্ধু দেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সুকান্তর মতো ‘বেকস’ও স্বল্প আয়ুর কবি। মাত্র ২২ বছর বয়সে সিন্ধু দেশের ভক্তকবি ‘বেকস’ মৃত্যুবরণ করেন।…

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন মৃত্যুকে তুলনা করেছেন দোলনার সঙ্গে। কখনোবা পাশা খেলার সাথে, আবার কখনোবা বল খেলার সাথে। অনেক শিল্পী, দার্শনিক,কবি-সাহিত্যিক মৃত্যুকে তুলনা করেছেন নিদ্রা বা মহানিদ্রার সাথে। স্বল্প আয়ুর কবি ‘শেলী’ মৃত্যুকে বলেছেন নিদ্রার সহোদর। কবি সুকান্তও বোধ হয় মনের অজান্তেই কবি শেলীর মতো মৃত্যুকে নিদ্রার সহোদর রূপে ভেবেছিলেন। মৃত্যু কামনায় সুকান্ত রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্হ হয়েছেন কখনো কখনো।…

মৃত্যু যে ঘনিয়ে আসছে সুকান্ত নিজেই তা আঁচ করতে পেরছিলেন। হৃৎস্পন্দন থেমে আসার সংবাদ অনুভব করেছিলেন নিজেই।…

২৪ পৌষ ‘৪৮ তার বন্ধু অরুণকে লেখা এক চিঠিতে সুকান্ত লিখেছেন,’এক দিন হয়তো এ পৃথিবীতে থাকবো না…সত্যি অরুণ বড় ভালো লেগেছিল পৃথিবীর স্নেহ,আমার ছোট্ট পৃথিবীর করুণা। বাঁচতে ইচ্ছে করে… কিন্তু মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে…আবার পৃথিবীতে বসন্ত আসবে,গাছে ফুল ফুটবে। শুধু তখন থাকবো না আমি। ‘…

মৃত্যুকে সামনে উপস্থিত দেখেও ভয় পাবার পাত্র নন সুকান্ত। তার অশান্ত মনে যে সর্বদা বিপ্লবই বিরাজ করে! জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে সুকান্ত ছিলেন আশাবাদী। তার বিশ্বাস ছিলো, মৃত্যুই সবকিছু শেষ করে দেয় না। মৃত্যু সকল কিছু শেষ করে দিতে পারেনা। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাই তিনি সৃষ্টি করে গেছেন মহত্তম সাহিত্য। গেয়েছেন মানুষের জয়গান।….

ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি বা সমাজই সুকান্তর দৃষ্টিতে বড় ছিল। তিনিও যেন ‘উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ’-এর সেই বিখ্যাত কবিতার মহান ডাক শুনেছিলেন,
“Fare Well, Fare well the heart that lives alone, /
Housed in a dream, at distance from the kind! /
Such happiness, what ever it be known. /
IM to be pitied, for it is surely blind! (Nature and the Poet — William Words Worth, Stanza -X111)
অর্থ হলো,’যে লোক নিঃসঙ্গ বা আত্নকেন্দ্রিক জীবনযাপন করে, অন্যের জন্য কোন অনুভব নেই,তাকে বিদায়! বিদায় — যে মানবজাতি হতে দূরে এক কল্পনার জগতে বাস করে, তাতে যে সুখ, সে সুখ যেখানেই পাওয়া যাক তা ঘৃণ্য, কারণ তা নিশ্চয়ই অন্ধ এবং মানবজাতির কোন উপকারে আসে না। ‘
সুকান্তকে মৃত্যু ছিনিয়ে নিতে পারে না। সুকান্তকে জনতার কাছ থেকে কোনোক্রমেই আড়াল করে দিতে পারেনা যমদূত!কেননা সুকান্ত মানুষের কবি,জনতার কবি।

নিবন্ধটির শেষের দিকটায় ছিল,
সুকান্তর খ্যাতি-যশ সুকান্ত দেখে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারেননি,তার কবিতা-ছড়া বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং সমাদৃত হয়েছে। প্রথমে ম্যালেরিয়া পরে টাইফয়েড ও অবশেষে যক্ষায় আক্রান্ত হন সুকান্ত। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৩১ শ্রাবণ যার জন্ম,তিনি ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ২৯ বৈশাখ মাত্র ২১ বছরে আমাদের ছেড়ে চলে যান।…
সুকান্তর চলে যাওয়া বা মৃত্যু আজ আমাদের কাছে কোনো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো তার কাজ,আমাদের জন্য রেখে যাওয়া তার রচনা। প্রয়োজনের তাগিদে তাই রচয়িতা অপেক্ষা রচনাই হয়ে উঠেছে আজ মুখ্য।

তথ্যসূত্রঃ
১. সাহিত্য চর্চা, বুদ্ধদেব বসু।
২. কালিক ভাবনা, আহমদ শরীফ।
৩. সুকান্ত সমগ্র, বদরুদ্দীন উমর ও রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত।
৪. অন্বেষণ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
৫. সুকান্ত-চর্চা, নারায়ণ চৌধুরী।
৬. সুকান্তঃ কবি ও মানুষ, সামাদ সিকদার।
৭. কালের সারথীঃ সুকান্ত,অজিত কুমার মৃদুল।
৮. বাংলা সাহিত্যের খসড়া,শ্রী প্রিয়রঞ্জন সেন।
৯. Civil Disturbances in India, S. B. Chowdhury.
১০. Elements of Political Knowledge, Progress Publishers, Moscow.
১১. On Poetry and Poets, T. S. Eliot.
১২. নাজিম হিকমতের কবিতা,অনুবাদ — সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
১৩. স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা, নরহরি কবিরাজ।
১৪. সুকান্তর সমগ্র কবিতা, আব্দুল হাফিজ, রাজশাহী।
১৫. কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের রচনা সমগ্র, সম্পাদনায় — রফিক সন্যামত।
১৬. ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ, কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী।
১৭. রবিরশ্মি, চারু বন্দোপাধ্যায়।
১৮. বাংলা সাহিত্যের খসড়া, শ্রী প্রিয়রঞ্জন সেন।
১৯. বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা, গোপাল হালদার ।
২০. বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত।

( চলবে)

২৪ -০৬-২০২০।
রূপায়ণ টাউন, ভুইঁগড়, নারায়নগঞ্জ, বাংলাদেশ।।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন