নরওয়ে থেকে:-
একটা সময় বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে অনেক ভালোবাসা, সৌহার্দ এবং হৃদ্যতা ছিল। ছিল সম্মানবোধ এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি।
এক বাড়িতে বসবাসকারী অনেক ঘরের লোকদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সবাই একই ছাতার নিচে একই পরিবারের সদস্যদের মতো ভাতৃত্য, সৌহার্দ এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করতো। বাড়িতে কারো বিয়ে মানে সারা বাড়ির সকল ঘরের সকল সদস্যের সাথে নিয়ে সঙ্গবদ্ধ ভাবে উৎসব আলোচনা। আর কারো মৃত্যু মানে সারা বাড়িতে সবার মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসতে। সময় পাল্ঠে গেছে, পাল্টে গেছে বাংলাদেশী গ্রামীণ সমাজ ব্যাবস্থার অনেক রীতিনীতি, পাল্ঠে গেছে মূল্যবোধ আর পারস্পরিক সম্প্রীতির সংজ্ঞা।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম, বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করবো বলে সারাদিন পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতাম, সকাল বিকেল আব্বার কাছে কাছে থাকতাম যাতে অংক কিংবা ইংলিশের ব্যাপারে আব্বার কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারি। আমাদের আব্বা অন্যদের কাছে শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন তা জানিনা, তবে আমার শিক্ষা জীবনে মূল্যবোধ সম্পন্ন সৎ একজন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠার ব্যাপারে আমার বাবার শিক্ষকতা এবং আদর্শ আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করতো।
আমাদের বাড়িতে ৩ ঘর পরেই চেরাগ দাদাদের ঘর, চেরাগ দাদার সাথে আমার আব্বার রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও উনাদের মাঝে ছিল পারস্পরিক সৌহার্দ আর ভালোবাসার বন্ধন, জীবনে কোনো গুরুত্তপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে চেরাগ দাদা আব্বার কাছে ছুটে আসতেন,, চা পান করতে করতে আমাদের পড়ার ঘরে বসে অথবা উঠানের পেয়ারা গাছের ছায়ায় বসে আব্বার সাথে পরামর্শ করতেন দিনরাত। উনাদের মাঝে ছিল সুন্দর বুঝাপড়া। চেরাগ দাদা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট অফিস কর্মচারী , ১৯৯৭ সালের একদিন সকালে উনি আব্বার সাথে কি জানি বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে বসে আছেন, আমি পাশেই বসে অংক করছিলাম। দাদার পেনশনের টাকা নিয়ে হেড অফিসের সাথে কি সমস্যা চলছিল, উনি এসেছিলেন আব্বার কাছে একটা আবেদন পত্র লিখিয়ে নিতে যাতে হেড অফিস থেকে উনার থাকাগুলোর একটা সমাধান হয় এবং মাসে মাসে কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই উনি যেন উনার পেনশনের টাকাটা পেয়ে যান। আব্বা সব শুনে দাদাকে বললেন, চাচা আমি এখন খুব ব্যাস্ত আছি তবে আপনি যদি শরীফকে সব কিছু বুঝিয়ে বলেন, আপনার পেনশনের নাম্বারটা দিয়ে যান এবং হেড অফিসের এডড্রেসটা দিয়ে যান, শরীফ আপনার দরখাস্তটা লিখে আগামী কালকে ঢাকার ঠিকানায় ছেড়ে দিবে।
আব্বার কথা শুনে চেরাগ দাদা আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন, আমি তাকাচ্ছিলাম আমার আব্বার মুখের দিকে, আব্বার চুখে মুখে কেমন জানি এক প্রশান্তির ছায়া ছিল, যা আমাকে বলে দিচ্ছিলো যে আমি পারবো, নিশ্চই আমি পারবো।
পরদিন আব্বার কথামতো চেরাগ দাদার চিঠি আমি ঢাকার হেড অফিসের ঠিকানায় পোস্ট করে দেই, আশ্চর্যজনকভাবে পেনশনের টাকা সংক্রান্ত চেরাগ দাদার সমস্যা সহজেই মিটে যায় এবং উনি মাসে মাসে উনার পেনশনের টাকাগুলো ঠিক মতো পেতে থাকেন।
এ ব্যাপারটার পর থেকে প্রতি মাসে পেনশনের টাকা আসলে, গ্রামের হেতিমগঞ্জ বাজার থেকে টাকাগুলো তুলে নিজের ঘরে যাবার আগে চেরাগ দাদা আমাদের ঘরে আসতেন, পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, আমার হাতের বাজে ১০০ টাকার কড়কড়ে একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, নাতি তুমি অনেক বড় হবে তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া রইলো। ওই সময়ে একটা ক্রিকের বল কিনতে করছি পড়তো মাত্র দশ টাকা তাই আমার জন্য প্রতি মাসে চেরাগ দাদার দেয়া ১০০ টাকা মানে অনেক কিছু ছিল। তার চেয়ে বড় ব্যাপার ছিল উনার ভালোবাসা আর আমার নিজের যোগ্যতার প্রতি পাওয়া আত্মবিশ্বাস। চেরাগ দাদা ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের ভেতর কোন এক সময়ে মারা গেছেন ঠিক মনে নাই কিন্তু বাঁচার আগে পর্যন্ত উনি আমার জন্য অনেক দোয়া করে গেছেন। উনার দোয়া এখনো রয়েছে আমার জীবন জুড়ে। তাই উনি যখন মারা যান উনাকে বহনকারী খাটিয়ার এক প্রান্ত আমি বহন করেছিলাম, আমি সেটা করেছিলাম উনার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখানোর জন্য।
আমরা আমাদের জীবনে অনেক কিছুই করি, তবে মানুষকে যথাযথভাবে সম্মান আর ভালোবাসা দেখানোর ব্যাপারে আমরা উদাসীন থাকি সব সময়। উদাসীন থাকি ভালো কাজ করতে, উদাসীন থাকি সমাজ, মানুষ আর দেশের প্রতি নিজেদের করণীয় কাজগুলো ঠিকমতো করে যেতে।
মনে রাখবেন, আপনি যেই হন না কেন, যত শক্তিশালী হন না কেন, প্রকৃতির নিয়মে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে,, চলে যাওয়ার আগে এমন কোনো কিছু করে যান যাতে চলে যাওয়ার সেদিনটাতে আপনার/আমাদের লাশকে যেন প্রিয়জনেরা সম্মান করে,,
ভালোবাসা আর সম্মানে আমাদের লাশটাকে বহনকরে নিয়ে যায় শেষ দিনের, শেষ ঠিকানায়।