পড়াশুনা এবং চাকুরীর সুবাদে ঢাকায় কেটেছে বিশ বছর। আমার সুখ দুঃখের অনেক স্মৃতি এই শহরের সাথে জড়িত ।  মনে আছে হাইকোর্টের বিচারপতিদের সামনে সামনি দেখা বা অন্য কোনো কারণেই  হউক, শুক্রবারের জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য প্রায়শই ছুটে যেতাম হাইকোর্ট মসজিদে। জুম্মার নামাজ পড়াতেন মৌলানা রফিক নামের এক ইমাম সাহেব। অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠে পবিত্র কোরান তেলাওয়াত করতেন। ‘শান্তি’ এবং ‘সমর্পন’ এই দুটি শব্দের উপরই যে ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে তা ব্যাখ্যা  করতেন কোরান ও হাদিসের আলোকে। পুরো খুৎবা জুড়ে থাকতো আত্মশুদ্ধি, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের (সা) প্রতি মহব্বত। ধর্মীয় রাজনৈতিক বক্তব্যের ধারে কাছেও ভিড়তে দেখিনি উনাকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম তার বক্তব্য। নামাজ শেষে উনার মুনাজাত ও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। মুনাজাতে এমন এক আবহ তৈরী করতেন যাতে মনে হতো আল্লাহ্পাক তার রহমতের দরজা খুলে দিয়ে আমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন। মুনাজাতের সময়ে হাইকোর্টের বিচারপতিসহ মুসল্লিদের  আমি ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠতে দেখেছি। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হতাম অদ্ভুত এক প্রশান্তি নিয়ে। এর পর গড়িয়ে গেছে অনেক বছর। দেশ বিদেশের অনেক মসজিদেই এখন নামাজ পড়ি। অনেক সময় লম্বা মোনাজাতেও অংশ নেই, কিন্তু সেই প্রশান্তি আর খুঁজে পাই না।
ইবাদতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং তার নৈকট্য লাভের চেষ্টা। এর আনুষ্টানিক এবং অনানুষ্ঠানিক দুটো দিকই আছে। দুটোই সমানভাবে অপরিহার্য। যুগে যুগে অনেক সুফী সাধকরা স্রষ্টায় বিলীন হবার আশায় অনানুষ্ঠানিক ইবাদতকে অনেক সময় বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টার প্রেমে মগ্ন হবার পারলৌকিক সুর। যে সুর পৌঁছে যায় মানুষের মনের গহীন কোণে, মনে করিয়ে দেয় জীবনের অনিবার্য পরিণতি, সেই সাথে মজবুত করে ঈমান। এসব গানে আত্মউপলব্দি, স্রষ্টায় নির্ভরতার ভিত আরো শক্ত হয়ে উঠে। চন্দনা মজুমদার  যখন লালন সাঁইয়ের গান ধরেন,
” আমি পড়েছি অকুল পাথারে
দাও এসে চরণতরী
এসো হে অপারের কান্ডারি।
পতিত পাবন নাম তোমারগো সাই
পাপী তাপি তাই তে দেয় দোহাই,
ফকির লালন বলে তোমা বিনে আমি ভরসা কারে করি
এসো হে অপারের কান্ডারি।”
আমি তখন পার্থিব জীবনের তুচ্ছতাকেই অনুভব করি গভীরভাবে, মৌলানা রফিক সাহেবের সেই মুনাজাত তখন নুতন করে ভেসে আসে অন্য কোনো সুরে। পরম করুনাময়ের কাছে জীবনের সব সীমাবদ্দতা নিয়ে সমর্পন এবং তার করুণা পাওয়ার নামজানাহীন এই অনুভূতি আমার কাছে ইবাদতের সমর্থকই মনে হয়। এই অনুভূতি  ব্যাখ্যা করার ভাষা আমি খুঁজে পাই না।  বুঝতে পারি ভিজে আসছে আমার দুই চোঁখের পাতা। তবুও ‘অপারের কান্ডারী’র  করুণা লাভের এই আকুতি আমি তন্ময় হয়ে শুনে যাই।

-টরন্টো থেকে

ছবি:-সৌজন্যে yumurtaliekmek.com

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন