জগৎ সংসারে অনেক কিছুই ঘটে যায় মানুষের অজান্তে। যা ঘটে তার খুব সামান্য অংশই আমরা দেখতে পাই। অনেকটা হারিকেনের আলোয় পথ চলার মতোই। আমরা যা দেখি, যা জানি তার তিনগুন ঢাকা পড়ে থাকে আঁধারে। এই আঁধারের রহস্যভেদের সময় এবং ক্ষমতা কোনোটাই মানুষকে দেয়া হয়নি। দেখা না দেখা ভুবনের কারিগর এই দুটো বিষয় নিজের হাতেই রেখেছেন। প্রাণ সঞ্চার করে তিনিই মানুষকে দুনিয়াতে পাঠান, আবার নিদৃষ্ট মেয়াদান্তে সেই প্রাণ (রূহ) বের হয়ে ফিরে যায় তারই কাছে। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের এই সময়টুকুতে মানুষ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তা হচ্ছে তার ভাগ্য। কার ভাগ্যে কখন কি ঘটবে তা নির্ধারন করেন “ইলমুল গায়েব ওয়া শাহাদা”। আক্ষরিক অর্থে যিনি ‘সমস্ত দৃশ্যমান ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা’। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরার ৪৯ টি আয়াতে প্রায় ৪৮ বার যে ছোট বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছে  তা হচ্ছে ‘ইলমুল গায়েব ওয়া শাহাদা’। অনেক সময় একই সূরায় বিষয়টি এসেছে একাধিকবার। যেমন সূরা আনআম এর ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “গায়েবের সকল জ্ঞানের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। তিনি ছাড়া এ বিষয়ে আর কেউ জানে না”। একই সূরার  ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,  “প্রকাশ্য ও নিগূঢ় রহস্যময় প্রতিটি বিষয়েই তিনি সবকিছু জানেন” । মানুষের জানা- অজানার বাইরের যে জগৎ,  সে জগতের প্রতিপালক অনেক কিছুই নির্ধারণ করে রেখেছেন নিদৃষ্ট সময়ের জন্য। মানুষের জন্য কখন কোন বিষয়টি মঙ্গলজনক তার চূড়ান্ত ফয়সালাও তারই হাতে। এ বিষয়ে সূরা বাকারায়  (আয়াত ২১৬) বলা হয়েছে, “ আসলে তোমরা যা অপছন্দ করছো, তাই তোমাদের জন্য ভালো হতে পারে আর যা পছন্দ করছো, তা হতে পারে তোমাদের জন্য খারাপ। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা জানেন তোমরা তা জানো না”। সেজন্য আপাতদৃষ্টিতে যা Challenge মনে হয়, সেটাই অনেক সময় Blessings হয়ে ধরা দেয়। তাৎক্ষণিক বুঝতে না পারলেও এই কুদরত অনুধাবন করা যায় যথাসময়ে। আমার নিজের বেলায়ও তেমনটিই ঘটেছে।

আমার কানাডায় আসার প্রথম দিকের কথা । তখন টরোন্টোতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কাজের জন্য সুপরিচিত এক প্রতিষ্টানে ছোট এক পদে কাজ শুরু করি । কাজটি রাতজেগে করার জন্যই নির্ধারিত। আমার জীবনে রাতজেগে করা প্রথম কাজ এটি । আর দশজন অভিবাসীর মতো আমিও তখন কাজের ধরণ ও ক্ষেত্র পাল্টে যাবার কারণে মনকে স্থির করতে পারছিনা। পরিষ্কার মনে আছে প্রথম দিন নির্ধারিত ডেস্কে ব্যাগ রেখে চেয়ারে বসতেই সামনে ঝোলানো নোটিশ বোর্ডে ছোট এক কাগজের টুকরায় দৃষ্টি আটকে গেলো। কোন এক সহকর্মী ছোট করে ‘Serenity Prayer’ লিখে বোর্ডে পিন দিয়ে আটকে রেখেছেন। সহজ বাংলায় এই প্রার্থনার অর্থ দাঁড়ায়, “ হে দয়াময় !  যা আমি পরিবর্তন করতে পারবোনা, তা মেনে নেয়ার প্রশান্তি আমাকে দাও। যা আমি পরিবর্তন করতে পারবো তা করার সাহস দাও এবং প্রজ্ঞা দাও যাতে এই দুইয়ের মধ্যে আমি পার্থক্য নিরুপন করতে পারি”। এতো বছর পরে আমি আজো ভেবে পাইনা ঠিক ওই সময়ে ঠিক ওই লেখাটিই আমার চোঁখে পড়লো কেন। কে জানে সেই অদৃশ্য কারিগর হয়তো আমাকে কোনো ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন। দ্বিধাদ্বন্দ্ব দিয়ে শুরু হলেও আমি খুব দ্রুত অনুধাবন করতে পেরেছিলাম যে আল্লাহ্পাক এই জায়গাটি আমার রিজিকের ক্ষেত্র হিসেবে নির্ধারিত রেখেছেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আলহামদুলিল্লাহ, তিন বছরেই কযেকটি ধাপ অতিক্রম করে আমি আমার কাঙ্খিত অবস্থানে পৌঁছে যাই। মানুষের মনে আশা জাগানো, নুতন দিনের স্বপ্ন দেখানোর এই কাজটিই এখন আমার কাছে পরিতৃপ্তির বিষয়। হাল ছেড়ে দেয়া, বিষন্ন, আশাহীন একজন মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর যে আনন্দ, সেই আনন্দ টাকা দিয়ে মাপা যায়না। বস্তুগত অন্য কোনো অর্জনের সাথে এই আত্মসন্তুষ্টির তুলনা সম্ভব নয়।  কর্মব্যস্ত দিনশেষে ঘরে ফেরার সময় যখন ভাবি যে আজ অন্তত একজন মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য কিছুটা হলেও খুঁজে পেয়েছে অথবা প্রেরণা পেয়েছে আরো একটি দিন বেঁচে থাকার, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের ‘চ্যালেঞ্জ’ তখন রূপান্তরিত হয়ে যায় ‘ব্লেসিংস’ এ। নিজের অজান্তে তখন মনের মধ্যে জন্ম নেয় আশ্চর্য্য এক প্রশান্তি। কে জানে, স্রষ্টার অপার করুনা হয়তো তখন প্রশান্তির বৃষ্টি হয়েই নামে আমার চারিপাশে।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

(ছবি:- সংগৃহিত)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন