ফ্লোরিডা থেকে:-

পরের দিনও প্রচন্ড জ্বর ছিল , দিনটা কেমন গেছে টের পাইনি, পরে শুনেছি অপ্রকৃস্থের মত প্রলাপ বকেছি, বাংলায় । সে কিছু বোঝেনি, মায়ের কথা উল্লেখ করেছি আর একটা শব্দ, সম্ভবত কোন একটা নাম , এসেছে বার বার। সে পাশে থেকে টাওয়েল ভিজিয়ে আমার জ্বরের সাথে লড়াই করেছে নি:সঙ্গ কক্ষে । না আমি তার কেউ নই । কিন্তু সে আমার কাছে এক শাশ্বত স্বর্গীয় নারী যার দেখা শুধু গাছ- পাখী- নদী-জলের এই পৃথিবীতেই মেলে। এরই মাঝে আমি ঘুমিয়ে পড়লে এক ফাঁকে যেয়ে যাবার টিকেট বদলে এনেছে। সিদ্ধ করে এনেছে গরম গরম আলু যার রয়েছে গন্ধ ক্ষুধা উদ্রেক কারী ঘ্রান , আর ক্যানড ফিশ্ । ক্ষুধা বোধ করেছিলাম কিন্তু মুখে দিয়ে কোন রুচি বোধ করলামনা। সময়টা ছিল কঠিন। দোকান গুলো যেমন ছিল গড়ের মাঠ এবং তীব্র খাদ্য সংকট , তেমনি ওষুধের দোকান গুলো ছিল শূন্য। হাসপাতাল গুলোর প্রায় একই দশা। এত বড়, এত সুন্দর ,এত ধনী দেশ অথচ মানুষ তখন দিন কাটাচ্ছিল অনাহার অর্ধাহারে , বিশেষত পেনশন ভোগী বৃদ্ধ মানুষ গুলো।
পরের দিন জ্বর ছেড়ে গেল , মাথাটা হাল্কা বোধ হল, শরীরে বল ফিরে পেলাম । বললাম “তুমি আমাকে তোমাদের শহর ঘুরিয়ে দেখাবে ? ” সারাটা বিকেল ঘুরলাম পাশাপাশি । ভারী সুন্দর একটা পার্ক , পাশে বয়ে গেছে কলকলে পাহাড়ী ঝরনা । যেখানেই শব্দ করে নদী বয় সেখানেই আমি হারিয়ে ফেলি আমাকে । আমার সত্তায় নদী ছোটে চিরন্তন। আমি নদীর তীরে নিয়েছি প্রথম শ্বাস, নদী আমার অঘোরে প্রলাপ বকার শব্দ। মা , নারী, নদী ও মাতৃভূমির সতত মেটামরফোসিস চলে আমার সত্তায় , চাইকোভস্কীর সুর যেমন এক লয় থেকে অন্য লয়ে রূপান্তরিত হয়ে সৃষ্টি করে সম্মোহনী আবর্তন।
নদীর গুন্জন ,পাখীর কূজন, গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের মৃদুমন্দ শব্দ আর তার ধীর ,পরিশীলিত
কন্ঠস্বরের ওঠানামা শুনতে শুনতে আমি হাঁটছিলাম কি উড়ছিলাম বুঝে উঠতে পারিনি। বিশ্ব সংসার মুগ্ধ হয়ে ছিল । রাতের নীরবতার অনিন্দ্যতায় ফুলে যেমন পাপড়ি গুলো খুলে খুলে আসে আকাশ -তারার উষ্ণতায়, তেমনি কি এক অবোধ্য বোধ কোকোন বন্দী প্রজাপতির মত ডানা মেলতে চাইছিল আমার মধ্যে । আমার তাকে ভালো লাগছিল অসম্ভব ।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম যেখানে আর পথ নেই সামনে যাওয়ার , আছে উঁচু একটি দেয়াল , সুতরাং হয় নদীতে নামা, নয় দেয়াল টপকানো ,নয় পিছনে ফেরা । সিদ্ধান্ত হল দেয়াল টপকাবো। আমাদের দিক থেকে তত উঁচু নয় দেয়ালটি , যতটা উঁচু অন্য দিকে, যেদিকে নামব , কারন সেখানে রয়েছে ঢালু । দেয়াল টপকানো পুরুষের জন্য বিশেষ বড় কোন কাজ নয় , বিশেষ করে বানর প্রজাতির সাথে যাদের আছে ঘনিষ্টতা । আমি দেয়ালে উঠে লাফ দিয়ে নেমে গেলাম । দাঁড়ালাম দেয়াল ঘেঁষে ওকে সাহায্য করার জন্য। সে দেয়ালে উঠেছে ঠিকই কিন্তু ভয় পাচ্ছে ঝাপ দিতে, সম্ভবত স্কার্ট পড়ার কারনে কাজটি তার জন্য তত সহজও ছিলনা। আমি দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে , আর সে দেয়ালের উপড়ে । তাকিয়ে আছি , ও ইতস্তত করছে। তারপরে আমি খুব যত্ন করে কোলে নিয়ে নামিয়ে আনলাম।
কয়েকটি মুহুর্ত সে ছিল আমার সংস্পর্শে , না দেয়াল ,না মাটি; এই বিশাল বিশ্বে যে শূন্যতা আমাদের ঘিরে আছে অনন্তকাল ধরে এবং যা থাকবে অনন্ত কাল, যার কোন শুরু নেই, শেষ নেই, গ্রহ,নক্ষত্র,ধুমকেতু যে শূন্যে সাঁতরায় , আমি এক মানব মাটিতে পা রেখে শূন্যে ধরে আছি এক মানবীকে , যার সৌন্দর্য পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে অতিক্রম করে পরিনত হয়েছে এক শাশ্বত শুদ্ধতায়। পড়ে যাওয়ার ভয়ে অসম্ভব নিবিড়তায় আকড়ে ধরে আছে সে । অবোধ্য এক বিদ্যুৎ জন্ম হল তার শরীরে , তা আমার শরীরে সংক্রমিত হয়ে জাগিয়ে তুলল আমার প্রতিটি দেহকোষ , প্রতিটি কণা তারপর ধীরে ধীরে আমার পা বেয়ে প্রোথিত হল মাটিতে । মাটির পৃথিবীতে লাগল শিহরন। এই সেই ফাউস্টের চিৎকার করার মুহূর্ত : “খামুস মুহূর্ত ! তুমি সুন্দর !”
মেফিস্টোফিলিসের সাথে ফাউস্টের চুক্তি স্বাক্ষর করার
সময় ঘনিয়ে এসেছিল। যতদূর মনে পড়ে শর্ত ছিল যে মহা প্রজ্ঞাবান ফাউস্ট তার আত্মাকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে দেয়ার বদলে যখনই যা চাইবে , পাবে তাই। তার কোন ইচ্ছাই অপূর্ন থাকবেনা। যেমনটা প্রতিশ্রুত স্বর্গে , যেমনটা প্রতিশ্রুত মার্কসের সাম্যবাদী সমাজে ( প্রত্যকে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে , প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে: সামর্থ্য এবং প্রয়োজনের পরিমাপক কে ? )
হঠাৎ ফাউস্ট বুঝতে পারল চাওয়া মাত্রই যদি সব পাওয়া যায় , তবে সেই জীবনকে সুখী বলা হবে কিসের সাথে তুলনা করে? রাত যদি না থাকে দিন কে চেনা যায় কেমন
করে ? আর দিন যদি না থাকে কি করে হয় রাত? সুখ কি ,যদি না থাকে দু:খ? আর দু:খই কি সুখ ছাড়া ?
বুলগাকভের শয়তান ভোলান্দ খুব দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলে সেই একিই কথা : “যদি ছায়াই না থাকলো শুধু আলোতে তুমি কি দেখতে পাবে ?”
ফাউস্ট বুঝতে পারলো যে সেই জীবন সুখের হতে পারেনা, সেখানে একঘেয়েমীর কৃমি কুরে কুরে খাবে। তাই সে যুক্ত করলো নতুন শর্ত । “যদি আমি কখনও এমন মুহূর্তের সম্মুখীন হই যা আমার মনে হবে চরম সুখের মুহূর্ত
ঠিক সেই মুহূর্তটিতেই যেন থেমে যায় সময়, সেই মুহূর্তটিতেই তুমি আমার জীবন কেড়ে নেবে।”
শয়তান বলল , “আমি কি করে জানবো সেই মুহূর্তের কথা?”
যখন তুমি শুনবে আমার চিৎকার , ” খামুস মুহূর্ত ! তুমি সুন্দর!”
সেই চরম মুহূর্তে যদি সময়কে থামিয়ে দেয়া হয় , তবে তো সে মুহূর্ত আর শেষ হবেনা। সেই চরম সুখের মুহূর্তটিই হয়ে যাবে চিরন্তন মহাকাল।
না আমাদের মুহূর্ত থেমে থাকেনি ,আমি বিহবলতা
কাটিয়ে পৃথিবীর কন্যাকে নামিয়ে রেখেছি অতি যত্নে পৃথিবীর বুকেই, পূজারী যেমন তার দেবীকে দেয় সমস্ত ভালোবাসা, আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি আমি কি দিয়েছিলাম তাকে।
ও অনেকক্ষণ কোন কথা বলেনি। আমরা হেঁটেছি হাত ধরে পাশাপাশি । কি ভাবছিল বা বোধ করছিল আমি জানিনে । হয়তো কিছুই নয় । হয়তো অনেক কিছু? মহাকাল তার বুকে ধরে আছে কত অনুভূতি, কত অশ্রু, আমরা সেই মহা সমুদ্রে তার খোঁজ পাবো কি করে ? আর আমিই কি ভাবছিলাম তা হয়তো তালাবদ্ধ আছে মগজের কোথাও , কিন্তু চাবিটি ?
” একটুকু ছোয়া লাগে একটুকু কথা শুনি ” এই কি সেই ছোয়া ? এই কি সেই কথা যা কখনই বলা হয়না ? আর যা বলা হয়না তাকে কি শুনতে হয় হৃদয় দিয়ে?
আবার কথা শুরু হল । কত কথা । কবিতার কথা , কবিতা ও ভালোবাসার কথা ,ন্যায় অন্যায়, শোষনহীন সমাজের কথা । দূরের কোন এক দেশের কথা যে দেশে অকপট পানকৌড়ি জলে সাঁতরায় , হাওয়া খেলা করে শর্ষের হরিদ্রায়, আমনের ধান গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে প্রেমিক পুরুষের মত, নদী গুলো বুকে বয়ে নিয়ে যায় রং বেরংয়ের হাওয়া ভরা পালে ভালোবাসা , যে দেশে মা পথ চেয়ে থাকে নক্ষত্রের প্রদীপ হাতে।
হাটতে হাটতে পৌঁছলাম পেত্রজাভোদস্কের ওনেগা হ্রদের তীরে , বেশ সুন্দর , বেশ বড় । ওনেগা আমাকে পাগল করে দিল। গ্রীষ্মের মৃদু মন্দ বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ এসে মাথা কুটছিল কত শত লক্ষ বছরের এক মস্ত পাথরে যার ওপরে সে বসেছিল নগ্ন ধবল পা ভিজিয়ে আর হাত দিয়ে ছিটাচ্ছিল জল এদিক সেদিক । ওনেগার বুক কি আমার বুক? সেই এক জোড়া ধবল পা স্বচ্ছ জলে ডোবানো তাকি আমার বুক-জলে ডুবানো?
সে ছিল আনমনা । নল খাগড়াগুলো মাথা নাড়ছিল বতাসে, আর ওনেগা বিশাল বিস্তীর্ণ এক কম্পিত বুক
নিয়ে শুয়ে ছিল নীল আকাশের দিকে মুখ করে ।
পরের দিন খুব সকালের ট্রেনে চলে গেল সে ।
আমি ফিরে এলাম লেনিনগ্রাদে। গ্রীষ্ম চলে গেল। ক্লাশ শুরু হলো নতুন বছরের। আস্তে আস্তে এগিয়ে এল নানা রং হাতে সোনালী শরৎ , তারপরে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, বৃষ্টি , তুষার , শীত। লেনিনগ্রাদের হিংস্র শীত যা বুকের শূন্যতাকে জমাট করে পরিবর্তিত করে দেয় সাদা সাদা বেলুগায়, যা খুব ধীরে সাঁতরায় বুকের গহীন সমুদ্রে ।
তারপর সেই দেশ ভেঙে গেল, খন্ড খন্ড হয়ে , যেমন আয়না পড়ে ভেঙে যায় , যেমন স্বপ্ন হত্যা করে ভেঙে যায় ঘুম ….
চলবে
মে ২৩, ২০১৫-মে ১৪,২০১৬
পাদটিকা :
ফাউস্ট : গ্যাটের চরিত্র
ভোলান্দ : মেফিস্টোফিলিসের প্রাচীন নাম, বুলগাকভের “মাস্টার ও মার্গারিতা ” উপন্যাস থেকে
বেলুগা- বিশালাকৃতির সাদা তিমি

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন