আজ দিনটা ছিল অপূর্ব। ঝকঝকে বিকেলটা কাটিয়েছি অসম্ভব সুন্দর এক সৈকতে। নীলের নানা বর্নে সেজেছিল প্রকৃতি। ভালোবাসাবাসির সন্ধ্যাটা ঘনিয়ে আসামাত্র বিশালাকায় পূর্ন চাঁদ ছড়িয়ে দিল তার রূপার গুড়োর মত আলো আর সেই আলোকে ঝিকমিকে হেসে উঠল সমুদ্রসম জলাধার। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় স্নান করে আমিও সাময়িকভাবে ভুলে গেলাম আমার হিনমন্যতা। তবে পাগল করা সেই জোছনা কিছুক্ষনের মাঝেই দখল করে নিল রাগান্বিত মেঘের দল। তাদের ঝগড়া দেখতে দেখতে শুরু হল আকাশের কান্না। সেই সাথে অন্যধরনের এক অবষাদে পূর্ন হল মন। ভুল বুঝবেন না, হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ে বড় হওয়া আর যে কোনও বাঙালীর মতই আমি বৃষ্টিবিলাসী। কিন্তু আজকের জোছনা ও মেঘের লুকোচুরি খেলাটা আজকের বিশ্বেরই প্রতিফলন।

প্রচন্ড পানির আঘাত সহ্য করে গাড়ী চালাতে চালাতে খুব রাগ হল স্বজাতির উপরে। মনে হল, এই করোনা ভাইরাস যেন আগামী পাঁচ বছরেও আমাদের ছেড়ে না যায়। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ যেন মরে সাফা হয়ে যায়। পৃথিবীর উপরে চাপটা যেন কমে আসে। মানুষ হিসেবে নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ, নগন্য ও নিন্মস্তরের বলে মনে হল আজ। চিন্তা করছিলাম, আজকের বিশ্বের এই সংকটময় মুহূর্তেও বর্নবিদ্বেষের মত মানবতৈরী হিংসার কারনে একে অপরকে নির্মমভাবে মেরে ফেলছি।প্রথম বিশ্বের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী মানুষের যদি এই মানসিকতা হয়, তবে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাহীন মানুষের থেকে আর কি আশা করা যায়?

আচ্ছা একবারও কি ভেবে দেখেছেন? বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা সাড়ে সাত বিলিয়ন। আর জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩৮৯০ টি। এখন বলেন, মানুষের তো প্রজনন নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা আছে, বাঘের নাই। মানুষের শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি, সম্পদ, আবেগ সবই বাঘের চেয়ে বেশি।তার উপরে বাঘ মানুষকে খায়, বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু বাঘকে খায় না। তবু বাঘের সংখ্যা মানুষের চেয়ে এত কম কেন? বাঘ কিন্তু অন্য আরেকটা বাঘকে মিথ্যা কথা বলে না, দুর্নীতি করে না, যুদ্ধ করে না, রাজনীতি বোঝে না। একজন বাঘ আরেকজন বাঘের চেহারা, গায়ের রং নিয়ে তামাশা করে  না বা খোঁচা দেয় না। আর আমরা “আশরাফুল মাখলুকাত” হয়ে এই সবগুলিই করি। একজন পূর্নবয়স্ক মানুষ যখন নি:শ্বাস না নিতে পেরে “মা-মা-মা” বলে কেঁদে ওঠে, আমরা তখন নিজেদের গায়ের বর্ন ফর্সা করার উদ্দেশ্যে কাঁচা হলুদের রস মেখে গোসল করে  “ফেয়ার এন্ড লাভলী” দিয়ে সেই খুনীর গায়ের রং এর মত নিজেদের রং করতে চাই। একজন সতেজ মানুষের দেহ যখন নিথর হয়ে পড়ে আমরা সেই ঘটনা ভিডিও করি আর ফেইসবুকে দেখে স্যাড ইমোজি দিয়ে দু:খ প্রকাশ করে হিন্দী মুভি দেখতে বসি যেখানে আজ পর্যন্ত আফ্রিকার বংশোদ্ভুত ৯০% চরিত্রকে হেয় করে দেখানো হয়েছে।আজও আমাদের দেশে এই মানুষদের “নিগ্রো” বলে ডাকা হয়। আর আমরা নাকি সভ্য শালীন মানুষ!!

আমাদের কি বেঁচে থাকার কোনও অধিকার আছে? পৃথিবীতে এত বেশি মানুষ হয়ে গেছে যে এখন আর জীবনের কোনও দাম নাই। করোনা ভাইরাসও আমাদের কোনও শিক্ষা দিতে পারে নাই। কিসের এত দম্ভ আমাদের? কিসের এত সামাজিক নিয়ম, কিসের এত অহংবোধ? সামান্য অর্থের জন্য আমরা যে কতখানি নিচে নামতে পারি তা আমাদের বাংলাদেশিদের চেয়ে বেশি কে জানে? আজকের এই বিশ্বসংকটের মুখে আমরা যখন নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত যে পৃথিবীর প্রতিশোধ যে কতখানি কঠিন হতে পারে তা সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারনাই নেই। আমরা এখনও পরিবেশের দিকে না তাকিয়ে যে যার মত আবর্জনা তৈরী করে যাচ্ছি। আমাদের তরুন সমাজ সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে এতই ব্যাস্ত যে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে এদের বিন্দুমাত্র ধারনা নেই।আর আমরা কত সামান্যেই আমাদের আসল বর্ণ প্রকাশ করে ফেলি।

আমার খুব লজ্জা লাগছে আজকের পৃথিবীর সদস্য হিসেবে। কত তুচ্ছ মানুষ আমি কিন্তু আমার ভোগ্য বস্তুর সংখ্যাটা কত বড়। কতখানি অক্সিজেন, খাবার, বাসস্থান দখল করে আছি আমি। আমার বাসা বানাতে কতগুলো বাঘকে গৃহহীন হতে হয়েছে সেই হিসেব কি আমি রাখছি? বারাক ওবামাকে কাঁদতে দেখলাম মিডিয়ায়। তাঁর মত মানুষের যদি অসহায় হয়ে কাঁদতে হয় তাহলে আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের কি হবে? আর একশ বছরের মাঝে আমরা সবাই মিলিয়ে যাব মাটিতে, কিন্তু গল্প হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের জেনারেশন এই করোনাভাইরাসের জন্য। গল্পটা যেন এমন না হয় যে, পৃথীবির মানুষের শত শত অন্যায়ের প্রতিশোধে সেই সময়ে প্রকৃতি অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে। সেটি হবে বড় লজ্জার বিষয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন