পর্ব ২-

‘রেইকি’ অর্থ মহাজাগতিক প্রাণশক্তি। একে কসমিক এনার্জিও বলে। আমাদের শরীরের রয়েছে সাতটি প্রধান শক্তি চক্র। কসমস বা মহাজগৎ থেকে এই প্রধান সাতটি চক্র প্রাণশক্তি বা এনার্জি নিরন্তর আহরণ করে চলছে। এবং সেখান থেকেই শরীরের সাতটি এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডে (Endocrine gland) সেই এনার্জি বা শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা যে সুস্থ থাকি তার কারণ হল মুখ্য সাতটি এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডে নিরন্তর শক্তি প্রবাহ। যখনই কোনো চক্র এবং সংশ্লিষ্ট এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডে কোনো কারণে এই প্রাণশক্তি প্রবাহ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়, তখন সেই গ্লান্ডে বা গ্রন্থি প্রাণশক্তির অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এবং তার ফলে সেই বিশেষ গ্রন্থির সাথে যুক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সাময়িকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে এর ফলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন ‘রেইকি’র প্রয়োগে প্রাণশক্তি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে অসুস্থ শরীর আবার সুস্থ হয়ে ওঠে।

মানুষের শরীরে সাতটি চক্র আছে – মূলাধার চক্র, স্বাধিষ্ঠান চক্র, মনিপুর চক্র, অনাহত চক্র, বিশুদ্ধি চক্র, আজ্ঞা চক্র, সহস্রাব চক্র। এই চক্রের প্রত্যেকটি একেকটি এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডের সাথে সংযুক্ত। ‘রেইকি’র কাজ হল মহাজগতের বিশাল শক্তিকে শরীরের চ্যানেলের মধ্য দিয়ে আহ্বান করে চক্রের মধ্যে প্রবাহিত করা। চক্র থেকে শক্তি সঞ্চারিত হয় এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডে। সাতটি চক্রের মধ্যে প্রথম তিনটি চক্র আধ্যাত্মিক চক্র, পরের তিনটির যোগাযোগ পৃথিবীর সাথে। এবং মাঝেরটি সোলার প্লেক্সাস বা মনিপুর চক্র যুক্ত হয়েছে আমাদের হার্ট বা হৃদয়ের সাথে। মহাজগত হতে শক্তি আহরণ করে আধ্যাত্মিক চক্র হয়ে তা প্রবাহিত হয় হার্ট বা হৃদয়ে। এবং ‘রেইকি’ বিশ্বাস করে, হাত হচ্ছে হার্টের এক্সটেনশন। কাজেই মহাজগত হতে আহরিত শক্তি গিয়ে জমা হয় হাতের দশটি আঙুলের প্রান্তে। বৃদ্ধি পায় আঙুলের শক্তি, যে শক্তি দিয়ে সে আরোগ্য করায়।

‘রেইকি’ বিশ্বাস করে রোগের চিকিৎসায় মানুষের শরীরের সাতটি (পিটুইটারি, পিনিয়াল, থাইরয়েড, থাইমাস, প্যানক্রিয়াস, গোনাডস এবং অ্যান্ডিনালা) গ্লান্ডের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। গ্লান্ড থেকে ক্ষরিত হরমোনই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে কার্যক্ষম রাখে। ‘রেইকি’ চিকিৎসার বিশেষত্ব এই যে ‘রেইকি’ শক্তিকে চক্র ও গ্লান্ডের মাধ্যমে সঞ্চালিত করে শরীরকে ফিরিয়ে দেয় সুস্থতা। উল্লেখ্য যে, ‘রেইকি’র সাথে অন্য কোনো ধরণের চিকিৎসার বিরোধ নেই। ‘রেইকি’ চিকিৎসায় শরীরের বিষাক্ত টক্সিন বেরিয়ে যায়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করে। আর্থ্রাইটিস, পুরুষ ও নারীর ইনফার্টিলিটি, হার্ট ডিজিজ, ডিম্বাশয়ের টিউমার, মাসিক ঋতুজনিত অসুস্থতা, শ্বেতস্রাব, এ্যালার্জি, হাপানি, খিটখিটেপনা, ডিপ্রেসন ইত্যাদি রোগে ‘রেইকি’ সাহায্য করে। ‘রেইকি’ মাষ্টার রোগীর চিকিৎসা করে না। চিকিৎসা করে মহাজগতের বিশাল প্রাণশক্তি বা ” Universal life force energy “। ‘রেইকি’ মাষ্টার সেই শক্তিকে রোগীর শরীরের চ্যানেলাইজ করে দেন মাত্র। অর্থাৎ রোগী নিজের শক্তি ব্যবহার করে নিজেই নিজের রোগ সারান। মানুষের শরীরের মূল সাতটি এনার্জি সেন্টার বা চক্রের দরজা খুলে যায় ‘রেইকি’ প্রশিক্ষণে। তখন অনেক বেশি পরিমানে ইউনিভার্সেল লাইফ ফোর্স এনার্জি সে মহাজগত হতে আহরণ ও বিতরণ করতে পারে। এই প্রাণশক্তি বা এনার্জি ক্রাউন চক্র (পিনিয়াল গ্লান্ড) দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। তারপর শরীরের উর্ধ্বাংশের অন্যান্ন এনার্জি সেন্টারের ভিতর দিয়ে তার কিছুটা এসে পৌঁছায় হার্ট এবং সোলার প্লেক্সাসে৷ বাকি এনার্জি হাতের ভিতর দিয়ে এসে পৌঁছায় আঙ্গুলে এবং হাতের তালুতে। সেই হাত যদি রোগীর শরীরের নানা জায়গায় আলতোভাবে রাখা যায় তা’হলে হাতের তালু থেকে কসমিক এনার্জি সরাসরি প্রবেশ করে রোগীর যন্ত্রণা বা অসুস্থতার জায়গায়। এর ফলে যন্ত্রণা উপশম হয়, অসুস্থতা সেরে ওঠে। শরীরের যন্ত্রণা বা ব্যাধির অর্থই হল শরীরের ঠিক জায়গায় এনার্জির ঘাটতি। ঘাটতি হয়েছে বলেই যন্ত্রণা হয়েছে। এনার্জি সব সময় ‘হাই’ লেবেল থেকে ‘লো’ লেবেলে প্রবাহিত হয়। সাধারণত ‘রেইকি’ মাষ্টাররা চিকিৎসার সময়ে রোগীর শরীরের সাতটি চক্র এবং চব্বিশটি বিন্দুতে হাতের তালু স্পর্শ করে কসমিক এনার্জির ট্রান্সফার ঘটান। এতে করে সারা শরীর তাজা হয়ে ওঠে এবং ব্যথা বেদনার উপশম হয়।

‘রেইকি’ চিকিৎসায় চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত মেলবন্ধন না ঘটবে ততক্ষণ পর্যন্ত এনার্জি প্রবাহ দ্বারা নিরাময় সম্ভব নয়। অর্থাৎ ‘রেইকি’তে যিনি ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন তার সম্পূর্ণ ইচ্ছা না থাকলে এনার্জি ফ্লো সম্ভব নয়।

‘রেইকি’ শেখার জন্য একজন ‘রেইকি’ মাষ্টারের কাছ হতে শিক্ষা নিতে হবে। প্রথমে দুই দিন তিনি শেখাবেন কিভাবে শরীরের সাতটি সুরঙ্গ বা চ্যানেল খুলে ফেলা যায়। এই দু’দিনের পর টানা একুশ দিন ধরে চলবে “শুদ্ধিকরণ”  (Cleansing of mind and body)। শরীর ও মন শুদ্ধ করার জন্য প্রতিদিন বাহাত্তর মিনিট করে “সেলফ রেইকি” নিতে হবে। একুশ দিন পর প্রথম গ্রেড বা ফাষ্ট লেবেল পূর্ণ হবে। অর্থাৎ টুয়েন্টি পারসেন্ট এনার্জি আমরা কসমস হতে আহরণ করে নিয়ে আসতে পারবো আমাদের হাতের তালুতে। বাকি আশি শতাংশ আমরা পাবো ‘রেইকি’ প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় গ্রেডে। দ্বিতীয় পর্যায়েও ‘রেইকি’ মাষ্টারের কাছ হতে শিক্ষা নিয়ে একটানা একুশ দিন প্র্যাকটিস (বাহাত্তর মিনিট) করতে হবে। ‘রেইকি’র জন্য প্রয়োজন শরীর ও মনের শুদ্ধিকরণ। মনের শুদ্ধিকরণ অর্থাৎ নেগেটিভ থিংকিং ছেড়ে পজেটিভ থিংকিং করা। নেগেটিভ (ঋণাত্মক) চিন্তাপ্রবাহ আমাদের প্রতিটি সুরঙ্গকে আটকে রাখে। একমাত্র পজেটিভ ( ধণাত্মক) চিন্তাপ্রবাহের নিরন্তর অনুশীলনই মনের শুদ্ধিকরণ ঘটাতে পারে। এরই পাশাপাশি শরীরের শুদ্ধিকরণ ঘটাবে প্রতিদিনের নিজের শরীরে ‘রেইকি’ প্রয়োগ। যে কোনো বয়সে যে কোনো ধর্মের, যে কোনো শিক্ষার যে কেউ হতে পারে ‘রেইকি’ চ্যানেল। ‘রেইকি’ কখনোই মূলধারার চিকিৎসা পদ্ধতির বিরোধিতা করে না। ‘রেইকি’ চিকিৎসকরা রোগীকে কেবলমাত্র তাদের উপর নির্ভর করতে বলে না।

‘রেইকি’র প্রধান সূত্র হল কুচিন্তা ত্যাগ করে নিরন্তর শুভ চিন্তার পথে জীবন যাপন করা। দীর্ঘ দিন নেগেটিভ চিন্তার ফলে আমাদের শরীরের এনার্জি গ্রহণের সবকটি পথ বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক যেমন পাইপে ময়লা জমাট বেঁধে পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে ময়লা পরিস্কার করলেই আবার পানি প্রবাহে বাঁধা দূর হয়ে যায়। একইভাবে negative thought -এর পরিবর্তে positive thought – এর প্রতিনিয়ত ব্যবহারটি খুলে দিতে পারে আমাদের কসমিক এনার্জি গ্রহণের সবক’টি প্রবেশ দ্বার। তাই নিম্নোক্ত পাঁচটি সূত্রকে “প্রিন্সিপাল অব রেইকি” বলা যায়।

১) আজকের জন্য আমি এই নিখিল বিশ্বের কাছ হতে যা পেয়েছি তার জন্য সৃষ্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
২) আজকের জন্য আমি কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবো না।
৩) আজকের জন্য আমি একেবারেই রেগে যাবো না।
৪) আজকের জন্য আমি আমার প্রতিটি কাজ সৎভাবে করবো।
৫) আজকের জন্য আমি প্রতিটি প্রাণীর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবো।

‘রেইকি’ এখন শুধু ভারত বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। আমেরিকা ও কানাডাতেও ‘রেইকি’র শিক্ষক রয়েছে।

চলবে, পঞ্চম পর্বে সমাপ্ত।
পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ইমিগ্রেশন- পর্ব ১১
পরবর্তী নিবন্ধতুমি আসবে বলে
কামাল উদ্দিন
লেখক পরিচিতি: কামাল উদ্দিন (জন্ম: ১৯৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে "বাংলা সাহিত্যে" স্নাতকোত্তর (১৯৮২) সম্পন্ন করেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ফটোগ্রাফি চর্চা করেন। বেগার্ট ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি থেকে ডিপ্লোমা-ইন-ফটোগ্রাফি (১৯৯০) এবং বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি'র (বিপিএস) যোগ্যতা বোর্ড থেকে ১৯৯০ সালে "সিনিয়র গ্রেড ফটোগ্রাফার" "লাইসেনসিয়েটশীপ" (এলবিপিএস) অর্জন করেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রকাশিত বই "সহজ আলোকচিত্র" ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং "আলোকচিত্র সহজ ও উচ্চতর" (২০০২ সালে) ভারত হতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জ সুধীজন পাঠাগারে অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক হিসাবে নয় বৎসর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য। " কামাল হাসান" ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করেন। তিনি "কথন" আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা ও এক বৎসর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন