জগৎ সংসারে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। সব কিছুই বদলায়। বদলে যায় দিন, বদলায় মানুষ, মানুষের জীবন। কাজী নজরুল ইসলামের গানের মতোই ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়- আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়’। পরিবর্তনশীল সময়ের পরিক্রমায় কিছু মানুষ দ্রুত পৌঁছে যান সমৃদ্ধির চূড়ায় আবার কিছু মানুষ জীবনের সব দীনতা, হীনতা, সীমাবদ্ধতা নিয়েই হেটে যান অবিরাম। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের সুবাদে এরকম অনেকের সাথে পরিচয় হয় আমাদের। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই শিখি তাদের কাছ থেকে। মানুষ জীবনকে যে কত বিচিত্র রকমের লেন্স দিয়ে দেখে তা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ না করলে হয়তো কখনো উপলব্ধি করতে পারতাম না। অবাক হয়ে ভাবি, আসলেই, “Human mind is an unfathomable reservoir of mystery”। এসব মানুষের কেউ কেউ মাঝে মাঝে যখন জীবনের ডালা খুলে বসেন, তখন এদের যাপিত জীবন, জীবন উপলব্ধি নুতন করে ভাবায় আমাদের।

করোনাপূর্ব কোন এক সময়। বসে আছি টরোন্টোর উডবাইন ও ডানফোর্থ এভেন্যুর Coffee Time এ। নুতন ক্লায়েন্ট ইনটেক। স্বাভাবিক ভাবেই এই ক্লায়েন্টের রেফারেল এসেছে টরোন্টোর মানসিক স্বাস্থ্য সেবার কেন্দ্রীয় সেবা সমন্বয়কারী সংগঠন ‘Access Point’ থেকে। টরোন্টোয় উপযুক্ত যে কেউ বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য, আসক্তি বা বাসস্থানজনিত সেবা পেতে চাইলে এই সংস্থায় আবেদন করে কাঙ্খিত সেবা পেতে পারেন। মাসের পর মাস অথবা বছর ধরে জমিয়ে রাখা সমস্যা এক দেড় ঘন্টার ইনটেক আলোচনায় পুরোপুরি অনুধাবন সম্ভব নয়। তবুও চেষ্টা থাকে স্বল্প সময়ে মূল ও আনুষঙ্গিক সমস্যা, সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ জানা, অগ্রাধিকারিকরণ এবং সেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দু তিনটে বিষয়ে একসাথে কাজ করার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে একমত হওয়া। যাহোক আলোচনা শেষে বুঝতে পারলাম স্টিফেন (ছদ্মনাম) মোটামুটি মানসিক, শারীরিক ও আসক্তিজনিত বিভিন্ন সমস্যার এক বড়সড়ো বান্ডিল নিয়েই আমার কাছে এসেছে। এটিও বুঝতে পেরেছিলাম যে অনেকদূর যাওয়ার একটি দৃঢ় প্রত্যয়ও রয়েছে তার মধ্যে। প্রথম দিকে Harm Reduction Approach নিয়ে স্টিফেনের সাথে কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে স্টিফেন সংযুক্ত হয় টরোন্টোর Rapid Access Addiction Medicine ক্লিনিক, St Michael hospital এর Trauma Counselling সার্ভিসের সাথে। সেবা গ্রহণ শুরু করে একজন মনস্তত্ববিদের (Psychiatrist) কাছ থেকে। নিদৃষ্ট কিছু লাইফ স্কিলস বিষয়ক কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করে স্টিফেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তার উপযোগী বাসস্থান খুঁজার কাজও। দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে একই সময়ে দীর্ঘদিন ধরে অত্যধিক মাদক সেবনের পরিণতিতে স্টিফেনের ‘Rectum’ এর কার্যকারিতা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় bowel movement । কারণ অনুসন্ধানের জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে টরোন্টোর বিখ্যাত একটি হাসপাতালে অসংখ্য পরীক্ষা, নিরীক্ষা চলে। অবশেষে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেন ‘Total Abdominal Colectomy Surgery’ র মাধ্যমে সম্পূর্ণ কোলন ফেলে দিয়ে স্টিফেনের Rectum এর refunctioning শুরু করতে হবে। ছয় ঘন্টার জটিল, সফল সার্জারির পরে সাত আট মাসে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে স্টিফেন। সার্জারি পরবর্তী প্রয়োজনীয় সেবার জন্য Respite Care Home ও তাকে থাকতে হয়েছে দু মাস। স্টিফেন আমাকে সব সময় একটি কথা বলতো, “ I want to live fully so that I can die happy. Just be with me.”। আমার সৌভাগ্য ছিল তার জীবনের জটিল এই সময়গুলোতে আমি তার পাশে থাকতে পেরেছিলাম। স্টিফেন এখন পুরোপুরি সুস্থ, স্বাভাবিক একজন মানুষ। তার বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে টরোন্টোর একটি supportive housing এ। আসক্তির প্রবণতা পুরোপুরি না কমলেও আগের তুলনায় তা এখন নিতান্তই সামান্য। সংকটে কিভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, সেই Coping Mechanism ও তার আয়ত্তে। দুশ্চিন্তা এবং বিষন্নতা কোনোটাই এখন তার জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে না। বেশ কিছুদিন হলো স্টিফেন কেস ম্যানেজমেন্ট সহায়তা থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছে,- আমরা যাকে বলি ‘service graduation’ । স্টিফেনের ভাষায় “ I rediscovered new purpose of life”। সব সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা ঠেলে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, একাগ্রতায় এবং প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির বলে একজন মানুষ যে কতটা এগিয়ে যেতে পারে এই মানুষটি তার বাস্তব প্রমাণ।

ইসলামে মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুখাত বা সৃষ্টির সেরা। পবিত্র কোরআনের সূরা আল ইসরা’র ৭০ নম্বর আয়াত ও সূরা আত তিন’এর ৪ নম্বর আয়াতে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্পাক মানুষকে এমন কিছু বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা দিয়েছেন যা অন্য কোনো প্রাণীকে দেয়া হয়নি। এই বিশেষ ক্ষমতার বলেই হোঁচট খেতে খেতেও মানুষ উঠে দাঁড়ায়, প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ জেনেও নেলসন ম্যান্ডেলার ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ এর মতোই পাড়ি দেয় সুদীর্ঘ পথ। Rock Bottom এ পৌঁছে যাওয়া মানুষও গভীর খাদ থেকে উঠে আসে অদম্য মনোবলে। নীরবে, নিভৃতে সৃষ্টি করে সফলতার নুতন ইতিহাস। কেউ কোনোদিন জানতেও পারেনা কতটা পথ পাড়ি দিয়ে তারা তাদের উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে। প্রবল বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়ানো, হার না মানা, হাল ছেড়ে না দেয়া এসব মানুষেরা আসলে কাজ করেন বাতিঘরের মতোই। নিজের অজান্তেই পথ চলার প্রেরণা যোগান আরো হাজারো মানুষকে। এসব মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয় দিন বদলের গল্প।

 

2 মন্তব্য

  1. Khub bhalo likhechen hasan bhai. ektu deri kore porchi, tai comment korte deri holo. প্রবল বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়ানো, হার না মানা, হাল ছেড়ে না দেয়া এসব মানুষেরা আসলে কাজ করেন বাতিঘরের মতোই। নিজের অজান্তেই পথ চলার প্রেরণা যোগান আরো হাজারো মানুষকে।” ar amader uchit shomoi kore ei shomosto unsung hero derke shamne tule dhora, karon mainstream shob shamoi eder khabor rakhe na. kono karo na hole, ei bekti certainly my inspiration and my hero.

  2. মুকুল ভাই, কাজটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু সব কিছুর শেষে যখন দেখি একজন মানুষ কিছুটা হলেও আশার আলো দেখে অথবা পথের দিশা খুঁজে পায় তখন এই পরিতৃপ্তির সাথে অন্য কোনো অর্জনের তুলনা মেলাতে পারিনা। এইসব মানুষ অনুপ্রেরণার উৎস. চেষ্টা করেও লেখাটিকে সংক্ষিপ্ত করতে পারিনি। তারপরেও পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন, সেজন্য অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকুন।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন