একসময়ে আজকের কুমিল্লার নাম ছিলো কমলাংক। কুমিল্লা জেলা বলতে পূর্বে কোনো জেলাও ছিল না। কুমিল্লা ছিলো ত্রিপুরা জেলারই এক বিস্তৃত ঐতিহ্যবাহী এলাকা। কুমিল্লা অঞ্চলে আজকের মতো বাঁশ-বেত ও ছনের (খড়ের চালের) কুঁড়েঘর তখনও ছিলো, তবে পরিমাণে অনেক অনেক বেশি। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন লোকের ঘরে শোভা পেতো কাঠের কারুকাজ। আর উচ্চবিত্ত পরিবারের দালানে শোভা পেতো নানা ধরনের আল্পনা ও খোদাই করা হতো দেবদেবী সম্বলিত নানান চিত্র।
বিরাট বিরাট ইটের তৈরি মসজিদে অংকিত আল্পনা ও মন্দিরের সুউচ্চ চূড়া আজও আমরা কুমিল্লার আনাচে-কানাচে দেখতে পাই। পোড়া মাটির শিল্পকর্ম বা ভাস্কর্য এবং ময়নামতি বৌদ্ধ বিহারের ঐতিহ্যবাহী অমর কীর্তির ধ্বংসাবশেষ তো আজও বিদ্যমান। মসজিদ, মন্দির, মঠ, বৌদ্ধবিহারসহ সর্বত্র খোদাই করা নানা বর্ণের নানা রঙের আল্পনা আজও কি আমাদের মন কেড়ে নেয় না? তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে কিংবা তারও আগে এতো সুন্দর শিল্পমন ও ধারণা কোথায় পেয়েছিলো মানুষ! এদের ওস্তাদ কে?
যোদ্ধার ছবি, পুঁথির পাটা, দেব-দেবীর কাল্পনিক চিত্র ও লীলাখেলা, দেয়ালের গায়ে নানা ধরনের ছবি আঁকা, পাতিলে নকশা আঁকা, ঢাকনা বা শরায় ছবি আঁকা — এক কথায় কারুকার্যময় মৃৎ শিল্পের এক দারুণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী কুমিল্লা।
রঙ্গিন মাটির পুতুল বা কাঠের পুতুল ও খড়ম এবং বেতের পাটি কুমিল্লা অঞ্চলের এক অবিস্মরণীয় শিল্প। পাথরে খোদাইকৃত নকশাও ছিলো বিস্ময়কর।
খাঁদি ও কুটির শিল্পের জন্য কুমিল্লার যে সুখ্যাতি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। এছাড়াও কুমিল্লায় এককালে ভালো ইস্পাতের কাজ হতো। একথা আমাদের শুনিয়ে ছিলেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। তার লেখা ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য’ বইতে ঢাকা প্রভৃতি পূর্ববঙ্গের নানা স্হানের পিতলের বাসন, কলিকাতার পিতলের বাসন ও পিতলের দেব বিগ্রহ, নবদ্বীপের মুর্তি, শামপুর, কুমিল্লা প্রভৃতি স্হানের ইস্পাতের কাজের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।
কুমিল্লা অঞ্চলের এখনকার খাবার-দাবারের সাথে সেকালের খাবার-দাবারের খুব বড় রকমের কোনো পার্থক্য গ্রামীণ কুমিল্লায় পরিলক্ষিত হয় না। শাক, শুটকি, ভর্তা ইত্যাদি সেকালেও ছিলো, একালেও আছে। শিক্ষিত ও নগরবাসী হবার কারণে এবং মূলত অর্থনৈতিক কারণেই খাবার-দাবারে কিছুটা বৈষম্য দেখা দিয়েছে। তবে মেজাজে রুচিতে বোধ হয় এখনও আগেরই মতো।
সামগ্রিকভাবে সভ্যতা বলতে যা বুুঝায় তাতে কুমিল্লার একটা পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষ্মণীয়। লক্ষনীয় চিত্রবিদ্যার অবলুপ্তি ও সেকাল একালের বৈষম্য। খাবার-দাবারের কথা তো বলাই হলো। কুমিল্লার রশমালাইর নাম শুনলে জিহ্বায় পানি আসেনা এমন লোকের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য।
এখন এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, পরিধেয় বা বস্ত্র পরিধানে বা বস্ত্রের ধরন-ধারনেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। কুমিল্লার বিখ্যাত ময়নামতির শাড়ির কথা তো আমরা ভুলেই গিয়েছি। টাঙ্গাইলের শাড়ি এখন সে স্হান দখল করে নিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এককালে ময়নামতি শাড়িরও টাঙ্গাইলের শাড়ির মতো কদর ছিলো। সুনীতি বাবুর মতে – ঢাকার জামদানী, টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ির সাথে কুমিল্লার ময়নামতি শাড়িও খ্যাতি লাভ করেছিলো। কুমিল্লার জনগন এ নিয়ে গর্ববোধ করতেই পারে।
ধান-পান, পাট কুমিল্লার ঐতিহ্য। এ সকল জিনিস সেকালেও উৎপন্ন হতো, আজও হয়। তবে পরিমাণে খুবই কম। যুগ বদলের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছে সব! শীতল পাটি, কাঠের খড়ম, কাঠের তৈরি বেলুনী ও পিরা, হুক্কা ইত্যাদি তৈরির অহংকারও কুমিল্লার রয়েছে। তবে শীতল পাটি সর্বজন ব্যবহার্য বলেই হয়তো তার এতটা সুখ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। শ্রীহট্ট বা আজকের সিলেট জেলার সুক্ষ মাদুর বা পাটির সাথে কুমিল্লার তৈরি শীতল পাটিও এককালে ইতিহাসে স্হান করে নিয়েছিল, এ কথা ভুলে গেলে কুমিল্লার প্রতি অবিচার করা হবে।
কুমিল্লার সামাজিক বিধি ও ধর্ম-কর্ম পালনের ঐতিহ্যে কিছুটা পরিবর্তন এলেও গ্রাম্য বিবাহের রীতি, অতিথি আপ্যায়ন, পালাপার্বণের দাওয়াতাদি, যামাই ষষ্ঠী, হালখাতা, পুজা-অর্চনা, বিশেষত স্বরসতী ও দুর্গা পুজা এখনও সেকেলে হয়ে যায়নি।
বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফলের এবং উৎসবের দাওয়াত বুড়ো জামাতারা পর্যন্ত পাবার আশা করে। দাওয়াত না পেলে আজও অভিমান করে থাকে। নানা ধরনের পিঠা আজও কুমিল্লার একটি অনন্য ঐতিহ্যের স্বাক্ষ্য বহন করে।
কাঁথা শেলাই শিল্প না ঐতিহ্য? আপনাদের সাথে মনের মিল হবে কিনা জানিনা, তবু বলি, কাঁথা প্রয়োজনীয় জিনিস। শীত নিবারক অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। কবি জসিমউদ্দিনের নকশীকাঁথা না হলেও কাঁথা সেলাই এবং এর বহুল ব্যবহার কুমিল্লায় ছিলো। পরিমাণে কম হলেও, সেই কাঁথা এখনো আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। সে পরিচয় হলো, উপরে কাঁথা নিচেও কাঁথা। লেপতোশকের প্রচলনে অবশ্য কাঁথার ব্যবহার ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে।
লাঠি খেলা বিলুপ্তির পথে। হা ডু ডু খেলাও কম হয়ে থাকে। ঘুঙুর পায়ে গাজীর গীত আর হয়না গ্রামে গ্রামে। ছাদ পেটানোর সময়কার জারীগানেরও যেন নির্বাসন হয়ে গেছে। অথচ, এদিক দিয়ে কুমিল্লা বেশ এগিয়ে ছিল। আরও অনেক খেলা ও পল্লীভিত্তিক গান হারিয়ে গেছে কুমিল্লা থেকে। এসেছে নতুন নতুন খেলা ও রকসংগীত। প্রাণখুলে বিয়ের আসরে পুঁথি পাঠের বদলে এসেছে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি ব্যান্ডদলের সঙ্গীত। তবু গ্রামের পথে চলতে চলতে এখনও শুনতে পাই, ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না’।
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলার অন্যান্য স্হানের মতো ত্রিপুরা অঞ্চলেও বিভিন্ন রীতির কীর্তন, বাউল ও ভাটিয়ালি গান, শ্লোকবলা এবং তা সুর করে পড়া, কবিগান, পাঁচালী যাত্রা, জারীগান, মুসলমানী মারফতিগান, মুরশেদী গান, মর্সিয়াগান, সুর করে পুঁথিপাঠ ইত্যাদির প্রচলন ছিল।
ইসলামী উৎসবগুলোর ঐতিহ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা বেশ ধুমধাম করে পালিত হয়। ঈদ মানে খুশি বলেই হয়তো তা করা হয়ে থাকে। তবে মহরম পালনেও আমরা কম যাই কীসে? শবে মিরাজ, শবেবরাত ও শবে কদরকেও আমরা বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সরস্বতী পুজা, দুর্গা পুজা, বুদ্ধপুর্ণিমাও বাংলাদেশে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, আচার-আচরণে, বিভিন্ন বস্তু ও বিষয় অবলম্বনে, অন্তত ভারত বিভাগের পূর্বপর্যন্ত কুমিল্লা তার একটা নিজস্ব মেজাজ ও ঐতিহ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এখন হয়তো কতক গুলো বিষয় একেবারে লোপ পেয়েছে, কতক গুলো হয়তো লোপ পেতে বসেছে। আবার কিছু জিনিসকে আগলে ধরে রেখে আমরা হয়তো চেষ্টা করছি আগামী দিনের ইতিহাসে কুমিল্লাকে একটা উজ্জ্বল স্হান পাইয়ে দেবার জন্যে। এটি অবশ্যই একটি আশার কথা। অতীতের ওপর ভর করেই তো বর্তমান দাঁড়ায়। যার অতীত নাই তার বর্তমান থাকে কী করে?