“সব কিছুর আগে, আল্লাহ ছিলেন, যদি কিছুই না থাকত, তবু আল্লাহ থাকতেন। আমি বেঁচে ছিলাম, আমি মরে গেছি, আমি যদি কখনও বেঁচে না থাকতাম, তাহলে কি হতো? “-গালিব

জীবনের কোন কিছুই ভয় পাওয়ার নয়, যদি ও আমরা অনেক কিছুতেই ভয় পাই।
ভয় জীবন সাফল্যের হত্যাকারী; বিপদ, মন্দ, বেদনা ইত্যাদি জীবনে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত । ভয় বিভিন্ন স্তরে বা সময়ে আসে , একে এড়িয়ে চলা যায় না।

শিশুদের জীবনে ভয় ঢুকানো হলে ওদের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি বাধার সৃষ্টি হয় । ছেলে মেয়েদের কোমল বয়সে মা বাবার কেউ মৃত্যু, বিবাহ বিচ্ছেদ অথবা সাংসারিক অভাব অভিযোগ আসলে; ওদের জীবন হতাশা, ভয়ভীতির মধ্যে গড়ে উঠে। ছেলে মেয়েরা মুক্ত স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ পায় না। একটি গাছের চারা লাগানো হলে,অযত্নে যে ভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পায় না বা দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠে; তেমনি ভালো পরিবেশে না দিলে,শিশুর বাড়ন্ত জীবন ও ভালো হয় না। একটি অনাথ শিশুকে কুড়িয়ে এনে ভালো পরিবেশ ও সু-শিক্ষা দিলে সমাজে বড়ো হওয়ার সুযোগ পায়।

মৃত্যুর ভয়: একদিন আমরা সবাই মারা যাবো; মৃত্যুর চিন্তা মানুষকে দুশ্চিন্তা,কু- প্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে। জন্মিলে মরিতে হবে, মৃত্যু এড়িয়ে বেঁচে থাকার উপায় নেই। কেউ যদি মনে করে ” আমি তো মরেই যাবো ” বেশি পরিশ্রম করে এতো কিছু করে কি লাভ?

এই পৃথিবীতে যত আবিষ্কার, যত উন্নতি মানুষ করেছে, তারা কি বেঁচে আছে ?

প্রতিটি মানুষকে জন্মিলে মরিতে হবে এ বাস্তব সত্য এড়িয়ে থাকতে পারবে না। প্রতিটি মানুষ এই পৃথিবীর একে অন্যের সঙ্গে মিলে মিশে লেখাপড়া, চাকুরী , ব্যবসা বানিজ্য করে নিজের ছেলেমেয়ে, পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকাই জীবনের মূল্য।

আমরা একদিকে মৃত্যুর ভয় করি, ওপর দিকে মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়ে অন্যকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে বাহবা নেই এবং ডান হাতে বাম হাতে ঘুষ, দুর্নীতি করে রাতারাতি বড়ো লোক হওয়ার চিন্তা করি।

রোগ, অসুস্থতা, দুর্বল স্বাস্থ্য মানব জীবনকে প্রভাবিত করে।

একজন লোক যদি সারা বৎসর অসুস্থ্য থাকে, তার কাছ থেকে ভয় ভীতি, হতাশা ছাড়া আর কী আশা করা যেতে পারে ?

অসুস্থ্য, অক্ষম লোক কাজ করার প্রবণতা হারিয়ে মাগো বাবাগো, আমি মরে যাবো, এই চিন্তা করে; তাকে দিয়ে বিশেষ কিছু আশা করা সম্ভব না। কিন্তু অনেকে অসুস্থতা নিয়ে ও পরিশ্রম করে অনেক কিছু করে ।

টেরেন্স স্ট্যানলি ফক্স কানাডিয়ান অ্যাক্টিভিস্ট যিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের জন্য একজন জাতীয় নায়ক এবং অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। ১৮ বছর বয়সে ক্যান্সারের কারণে তার ডান পা হারানোর পর, টেরি ফক্স ক্যান্সার গবেষণার জন্য সচেতনতা এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য কানাডা জুড়ে দৌড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার ম্যারাথন ইভেন্টের মাধ্যমে, এক প্লাস্টিক পা নিয়ে হেঁটে কানাডার এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্ত গিয়ে ক্যান্সার গবেষণার জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার সংগ্রহ করে মরে ও অমর হয়ে রয়েছেন।

চাকুরিচ্যুত হবার ভয়: ভয় কর্ম জীবনে কাজের কর্মক্ষমতা এবং গৃহ জীবনকে ও প্রভাবিত করে। জীবিকা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় নিজ এবং পরিবারকে দুশ্চিন্তার মুখে ঠেলে দেয়। অনেকে ভয় ভীতি নিয়ে কর্মোদ্যম হারিয়ে জীবনে হতাশায় ভোগে । একটা লোক কাজের বিনিময়ে যে রোজগার করে, তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া, দৈনন্দিন সংসার ও অন্যান্য খরচ করে। যদি এই রোজগারে কোনো প্রকারে বাধার সৃষ্টি হয়, তাতে সংসারে অভাব দেখা দেয় এবং এই অভাব কাটিয়ে উঠতে হলে অন্যের কাছ থেকে ধার বা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিতে হয়।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিয়তার ভয়: আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, আজ ভালো; কিন্তু কাল ভালো থাকবো কী ?

আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা গ্রামে গঞ্জে স্কুল কলেজে পড়াশুনা করে। ওরা নিজেরাও জানে না বা মাবাবা ও জানে না, ” আমার ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ কি” ?

আমি একবার গ্রামের এক স্কুলে ১০ম শ্রেণীর সব ছেলে মেয়েকে আলাদা, আলাদা ভাবে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম , ” তোমরা বড়ো হয়ে কে কী হতে চাও “। ওদের সবাই উত্তর দিয়েছিলো ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হবে। এটা আমাদের ছেলে মেয়েদের মুখস্ত বুলি , ওরা জানে না একটা ছেলে বা মেয়ে কতটুকু ভালো হলে এই সুদূর গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে পড়াশুনা করে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। তাছাড়া ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার কী একমাত্র পেশা যা শুধু কাম্য হওয়া উচিৎ?

স্কুল টিচার ছেলে মেয়েদের হয়তো বুঝিয়ে বলে বা বলে না, জীবনে অনেক ভাবেই সাফল্য আসতে পারে । আমাদের সময়ে স্কুল জীবনে পরীক্ষায় লিখতে দিতো “তোমার জীবনের লক্ষ্য,(Aim in life ) কী ?

আমাদের দেশে ব্যবসা করে অনেকে বেশ ভালো অবস্থায় আছ। কানাডায় একজন দক্ষ প্লাম্বার বা সার্টিফাইড ইলেক্ট্রিসিয়ান ঘন্টায় ৫০ ডলার থেকে ৭০ ডলার রোজগার করে। কিন্তু একজন ইঞ্জিনিয়ার সে অনুপাতে অনেক কম বেতন পেয়ে থাকে। যারা হাতের কাজে ভালো যেমন একজন গাড়ির মেকানিক, তার পয়সার অভাব নেই। যারা অফিস আদালতে কাজ করে হ্যান্ড টু মাউথ কোনো রকমে সংসার চালায়। এদের অনেকেই পয়সা জমিয়ে কয়েক বৎসরে একবার দেশে যায় অথবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লোন নিয়ে দেশ থেকে এসে কয়েক বৎসরে শুধ সহ পরিশোধ করে।

আমাদের দেশের ডাক্তার এখানে পুনরায় পড়াশুনা না করলে এই পেশায় যেতে পারে না। অনেকে দেশ থেকে এসে পড়াশুনা না করে অন্য পেশায় বা ব্যবসা করে। যারা বাংলাদেশ থেকে পড়াশুনা শেষ করে সরাসরি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বা ইমিগ্রেশন নিয়ে আসে , তাদের জন্য MCAT দিয়ে হয়তো ইউনিভার্সিটি ঢুকে পড়াশুনা করা সহজ।

আমাদের দেশের কিছু কিছু ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য পেশার লোক এ দেশে এসে ” রিয়েল এস্টেট” এর উপর পড়াশুনা করে এ লাইন নিয়ে ব্যবসা করে বেশ ভালো অবস্থায় আছে।

পৃথিবীর লোক সংখ্যা ৭ বিলিয়ন এর কাছাকাছি। এত (white color job) চাকুরী কোথায় পাবে ?

আজকাল পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবসার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

সিদ্ধান্ত নেয়ার ভয়: আমরা অনেকেই জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাই। এই কানাডাতে দেখেছি, কেউ একটি কাজ থেকে অন্য কাজে ভালো সুবিধা পেয়ে যোগ দিয়ে সুবিধা করতে না পেরে চাকুরী হারিয়ে শেষে পরিবারের জন্য সাময়িক বিপদ টেনে এনেছে ।

কানাডার সরকার কাজ চলে গেলে অন্য কাজ না পাওয়া পর্যন্ত একটা নিদৃষ্ট সময় বেকারত্বের ভাতা দিয়ে থাকে।

আমরা অনেক সময় অন্যের উপর নির্ভর করি; সব সময় ওপর ব্যক্তির নিকট থেকে ভালো কিছু পেতে নাও পারেন। অন্যের উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা বা সৎ উপদেশ আপনাকে দেবে কী?

অনেকেই দেখবেন মুখে মুখে সামনে আপনার প্রশংসা এবং পিছনে কুৎসা রটাবে ;আপনাকে পছন্দ কতজন করে ?

কানাডার মতো দেশে এ ধরণের দু’মুখু লোক খুব কম পাবেন।

কে আপনাকে ভালো বললো বা মন্দ বললো তাতে আপনার কী যায় আসে ?

আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখে, আপনি ভালো কিছু করতে পারলে, কেউ না কেউ আপনার প্রশংসা করবে।

অজ্ঞতা বা জ্ঞানের অভাব: এমন কাজে ঝুঁকি নিচ্ছেন যে কাজ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। শেষে এ নিয়ে বিপদে পড়লেন। মূলতঃ এর জন্য যে যোগ্যতা দরকার, সে ভাবে তৈরী হয়ে ঝুঁকি নিলে ভালো হয়।

আজকাল অনেকেই রাজনীতিবিদ হতে চান , কিন্তু একজন নেতা হতে হলে যে যোগ্যতা দরকার তা নেই। লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে দুটি কথা বলার সাহস নেই, অথচ নেতা হতে চান; তা ছাড়া আপনার লুক্কায়িত স্বপ্নই বা কী ?

দরিদ্রের ঘরে জন্মেছেন, পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই বাধা অতিক্রম করার মতো সাহস ও ধর্য্য আছে কি?

উপরে যত কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তন্মধ্যে দারিদ্রতা, ব্যক্তি, পরিবার,কমিউনিটি বা একটা জাতির জন্য বড় হুমকি । বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ রয়েছে যারা বিশ্বব্যাংকের দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে । দারিদ্রতার তাড়নায় বাধ্য হয়ে মানুষ নিজের সন্তান পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করে। বিশ্বের অনেক দেশে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ আশ্রয়হীন, খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। এরা ও আপনার, আমার মতো মানুষ, এদের মাথার উপর ছাদ নেই ,ক্ষিদার তাড়নায় ডাস্টবিন থেকে ময়লা খাবার তুলে খেয়ে জীবন বাঁচায়; এদের খবর কে রাখে?

পৃথিবীতে অহরহ যুদ্ধ হচ্ছে, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলো, সম্পূর্ণ পরিবার পথের ভিখারি হচ্ছে , এ যুদ্ধ কি জন্য ?

যুদ্ধের ফলে ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্ন দেশের পথে ঘাটে, জঙ্গলে, লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ, না খেয়ে আশ্রয়হীন, বস্ত্রহীন ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে।

সাফল্যের ভয়: সাফল্যের কোনো নিজস্ব মাফ কাঠি নেই , আপনি কী হতে চান?

আপনি একজন গায়ক হতে চান ?

কিন্তু আপনার গান শিক্ষার জন্য যে পরিমান পরিশ্রম দরকার, আপনার ধর্য্য নেই; জীবনে সাফল্য একদিনে আসে না ; এর জন্য বৎসরের পর বৎসর পরিশ্রম প্রয়োজন । কেউ সারা জীবন পরিশ্রম করে জীবনে দুঃখ নিয়ে মারা যায়; আবার কেউ সঠিক ভাবে অল্প পরিশ্রমে ও ভালো করে।

ক্রমশ :

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“রেইকি”-স্পর্শচিকিৎসা-পর্ব ৩
পরবর্তী নিবন্ধ“রেইকি”-স্পর্শচিকিৎসা-পর্ব ৪
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন