(কিছু কাল্পনিক/কিছু সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা)
পর্ব -২

আমার সব কিছুতেই ভয়। আমি  ভয় ,দ্বিধা, সংকোচ নিয়ে বড়ো হয়েছি।  ছোটকালে  কোনো কিছু সাহস করে বলতে বা করতে গেলে ভয় পেতাম, কী  জানি কে কী  বলে, কী জানি আমি এ কাজটি করতে পারবো কি ? 

আমি গাছে উঠতে ভয় পেতাম; আস্তে আস্তে উঠা শিখলাম। মা বলতেন, নারিকেল গাছে উঠার চেষ্টা করবি না; ভাবতাম সবাই পারে,আমি কেন পারি না ? একদিন সাহস করে গাছের মাঝামাঝি উঠে নেমে আসলাম। মা তো খুব রাগ; তোকে বলি নারিকেল গাছে উঠবি না।  আমি বললাম আর উঠবো না, এ দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে উঠতে  চেষ্টা করতাম।  আরও কয়েক দিন চেষ্টা করে একবার গাছে উঠে গেলাম এবং ডাব নিচে পেল্লাম।  মা দেখে বললো , তোর এত সাহস দরকার নেই।  আর উঠবি না কখনও; কিন্তু আমি গাছে উঠা শিখেছি, আর তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।   

ছোট  বয়সে রাজা  রানীর গল্প  , বিষাদ সিন্ধু, শহীদে কারবালা, লখ্খিনদার বেহুলা,  রাহিম বাদশাহ রূপবানের গল্প শুনতে ও পড়তে ভালো বাসতাম ।   আমার কাকা  আলী মিয়া গ্রামে   গান , যাত্রা, মেলায় যাইতেন  । তিনি বিভিন্ন সময় কোথায় ও গেলে   আমি ও  যেতাম  । সে যুগে সময় সময় গ্রামে পুঁথি পাঠ:  শহীদ কারবালা  , গাজীকালু , বিষাদ সিন্ধু ও  কবি গান হতো।   তাছাড়া   পূজাপার্বন,  যাত্রা গান , সার্কাস, হিন্দুদের  বিয়ে অনুষ্ঠান , দূর্গা পূজা, মেহরণ গ্রামের   রথ যাত্রা অনুষ্ঠানে আমরা কয়েকজন মিলে যেমন :  শাহ আলম , নুরুল ইসলাম , আবুল খায়ের, অলি মিয়া সহ দেখতে  যেতাম। নুরুল ইসলাম মিয়া নৌকার ব্যবস্থা করতেন, সবাই ঘর থেকে ভাত, তরকারি নিয়ে  নৌকায় বসে শেয়ার করে খেতাম এবং নৌকা দিয়ে মেহরণ  হিন্দুদের রথ যাত্রা দেখতে যেতাম।  রথ আজ ঘরে উঠানো হবে , হিন্দুরা রথ থেকে বাতাসা বা জিলাবি দিতেন।  এই সামান্য জিনিসেই আমরা কত না আনন্দ পেতাম।  দুঃখের বিষয়, আমাদের এই গ্রূপের নুরুল ইসলাম আর আমি ব্যতীত বাকি সবাই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে ।     

আলী কাকা জোরে জোরে গান গাইতেন; অনেকে  উনার গান গাওয়া পছন্দ করতেন  এবং আমরা অনেক মজা করতাম।      

সে যুগে গ্রামে কারো কিছু হারানো গেলে বা কেউ অসুস্থ হলে চুপি চুপি কানাকানি করে বলতো এই দেখ, “ওই লোক বোধ হয় নিয়েছে বা ওই লোক বোধ হয় তাবিজ করেছে” । কিছু হলেই হুজুরের পানি পড়া বা তদবিরের জন্য দৌড়াতো ।  ” হুজুর এই দেহেন আঁর হুলাডার কি রহম পেটটা বড়ো অইছে, কিছু খাইতে হারে না; একটু হানিহড়া দেন।  ” হুজুর চিনামাটির প্লেটে কালী দিয়ে দোয়াকালাম লিখে পানি দিয়ে ধুয়ে খেতে দিতো এবং সঙ্গে একটা তাবিজ ও দিতো।  এই পানি পাড়ায় কারও কোনো উপকার হতো কিনা, জানিনা ; তবে হুজুর হাদিয়া পেতেন।     

   আমাদের গ্রামে   কারো কিছু হারানো গেলে অথবা কারো অসুখ বিসুখ হলে,  জিনের তদবির  করা শুনলে কাকার সঙ্গে যাইতাম এবং অন্ধকার ঘরে আমরা বসে থাকতাম; কবিরাজ ,  জিনের  সঙ্গে  কথা বললে  শুনতাম আর ভয় পেতাম। ছোট্ট কালে আমি বিশ্বাস করতাম যে বোধ হয় সত্যিকার  জিন অন্ধকার ঘরে এসেছে এবং বিকট আওয়াজে কথা বলে এবং ঘরের চারিদিকে গাছ  নড়ে । ওই সময় গ্রামে কোনও বিদ্যুৎ ছিল না,  এমনিতেই একটু অন্ধকার  হলে রাতে কিছু দেখা যেত না এবং অল্পতেই ভয়  পেতাম।তাছাড়া ভুত না দেখলেও ভুতের ভয় তো অবশ্যই ছিল। কাকা বলতো ও জিন আমাদের কিছু করবে না বলে সাহস দিতো। এ কি আসল না নকল জিন তা নিয়ে অনেক তর্ক হতো, কেউ বলতো আরে  এই লোক এক ভন্ড, ও নিজেই গলার স্বর দুই রকম করে কথা বলে।  তাছাড়া বাহিরে কেউ হয়তো আওয়াজ করে এবং ভয় দেখায়।  ওকে জিনের হাদিয়া দিতে হতো: সে বলতো জিন আনতে টাকা এবং মিষ্টি লাগে; নতুবা জিন আসবে না।         

ছোটকালে আমি প্রায়- ই  দাদির নিকট ঘুমাইতাম, দাদি অনেক ধরণের রাজা রানীর গল্প  শুনাতো, তার মধ্যে ভুত পেত্নীর  গল্প ও থাকতো।  রাজা রানীর গল্প শুনতে ভালো লাগতো, তবে ভুতের গল্প শুনতে ভালো লাগলেও ভয় পেতাম।  

আমাদের বাড়ির রশিদ ভাইয়ের শালা মধু কে  এক  সন্ধ্যায় তার বাড়ির সামনে থেকে ধরে নিয়ে জিনের মুল্লুকে তিন কি চার দিন রেখেছে  ।   এক ভালো জিন গোপনে ওকে বলেছে ,” কিছু খেও  না, যদি খাও তোমাকে আর ফেরত দেবে না।“    শেষে ওকে এক বিকেলে জিন  বাড়ির সামনে রেখে গেছে।  যতবার মধু আমাদের বাড়িতে আসতো, আমরা ঘিরে ধরতাম এবং এই গল্প না শুনে ছাড়তাম না। হায়রে কি মজার গল্প, আজ ও মনে মনে হাঁসি।   

স্কুলে পড়ি এক বাড়িতে লজিং থাকি, পাশের রুমে  মাওলানা  সাহেব (মাদ্রাসার মোদার্রেস) , রাতে প্রায়ই  কার সঙ্গে হুজুর  রুমে জোরে জোরে কথা বলেন।  কথার আওয়াজ ও ভিন্ন রকম।  একদিন আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ” হুজুর রাতে আপনি জোরে জোরে কার সঙ্গে কথা বলেন, আমিতো কাউকে আপনার রুমে দেখি না।  ” হুজুর বলে তুমি শুনেছ ? 

জ্বি, শুনেছি।  

হুজুর বলেন, আমার কিছু জিন  ছাত্র আছে , ওরা রাতে আমার কাছে পড়তে আসে।  একটু ওযুর সঙ্গে থাকবে, আমি বলে দেব, তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।  আমি শুনে ভয়ে কাঁপা শুরু করেছি।  হুজুর বলেন  তোমাকে একটা তাবিজ লিখে দেব  যাতে ভয় না পাও।  আমি বললাম, ” হুজুর, ওযু করে ঘুমাবো।  কিন্তু রাতে তো ওযু থাকে না।  ”  ঠিক আছে , আমি তো আছি, কোনো অসুবিধা হবে না।  আমি ভয় পেয়ে গেলাম।  বাড়ি এসে বাবাকে এ সব বললাম, বাবা বলে এগুলি তুই বিশ্বাস করিস না, ও হয়তো ঘুমে এটাসেটা বলে।     

আমাদের গ্রামের গোরফান কাকা বাড়ি বাড়ি তেল , নুন, খেজুরে ঘুড়, এটা সেটা বিক্রি করতেন। হায়রে কি মজা !  আমরা ছোটকালে চাল ,পাট দিয়ে মুরলি  , কদমা , এটা সেটা  কিনে খাইতাম।  সেই গোরফান আংকেল আজ বহুদিন না ফেরার দেশে চলে গেছেন।         

  আমাদের বাড়ির এক  ছেলে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র, মসজিদের সামনের পুকুরে গোছল করতে গিয়ে আর পাওয়া যায় নি।  পুকুর ঘাটে তার কাপড়  ছিল ; কিন্তু সে নাই।সে সব সময় একা একা গোছল এবং  পুকুরে সাঁতার কাটে।  কিন্তু সেদিন নিখোঁজ, সারা গ্রাম এবং এলাকা মাইকে এনাউন্স করে কেউ তার খোঁজ পায় নি।  এক দিন পরে তার লাশ পুকুরে ভেসে উঠেছে।  যে ছেলে ছোট কাল থেকে পুকুরে একা একা গোছল, মাছ ধরে, সাঁতার কাটে, তার পুকুরে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া এক আশ্চর্য্য ঘটনা। এটা সত্যি দুঃখ জনক।     

শুনেছি, এই ঘটনাকে  কেন্দ্র করে গত দশ বৎসরের স্থায়ী মসজিদের  ইমাম বলেন, আমি এই মসজিদের হুজরাতে  রাতে ঘুমাই ; মসজিদের দুই দিকে কবর, আমি এখানে রাতে মসজিদ থেকে বের হয়ে একা একা পায়খানা প্রস্রাব করতে যাই এবং অনেক সময় রাতের অন্ধকারে এখানে ভয় পাই;  তিনি ভয়ে এই মসজিদের ইমামতি ছেড়েই   চলে গেলেন  ।  

এখন ও আমাদের গ্রামে কোনো কিছু হারানো গেলে, বাটি পড়া ও তুলারাশি লোক দিয়ে হুজুর চোর ধরতে চেষ্টা করেন । তুলারাশি লোক বাটি নিয়ে কারও ঘরে বা এখানে সেখানে দাঁড়ালে বুঝতে হবে এখানে কিছু আছে। তার পরেই শুরু হয় ঝগড়া এবং এক পর্যায়ে হাতাহাতি। চোর তো আর ধরা হয় না , এ নিয়ে ঝগড়া হতে দেখেছি । 

 গতবার আমি দেশে গ্রামে গিয়ে আমার মোবাইল ফোন হারিয়েছি।  আমি বেডে ফোন রেখে বাহিরে গিয়েছি : ফেরত এসে  ফোন পাই নি। খোঁজাখোঁজি করে শেষে আশা ছেড়ে দিয়েছি।  কেউ একজন এসে বলেন, হুজুরের কাছে গেলে বের করে দিতে পারবেন।  আমি বললাম , কি ভাবে ?    উনি বলেন বাটি পড়া বা আঙুলের নখে হুজুর কালী পড়া দিলেই, কে নিয়েছে বেরিয়ে যাবে ; তবে এ নিয়ে ঝগড়া হতে পারে ।  আমি বললাম বাটি পড়া বা নখে কালি দেয়ার দরকার নেই, আর ঝগড়ার ও দরকার নেই।   

আমাদের গ্রামের দক্ষিনে গুলবাহার ; আমাদের গ্রাম এবং গুলবাহারের মাঝামাঝি দাগার মুড়া ( আম বাগান) , এই আম গাছ সরকারি খাস ভূমিতে এবং প্রতি বৎসর অনেক আম ধরে যা এলাকার লোক  খায়। অসংখ্য পাখি সে যুগে এই গাছে বাস করতো, আমরা ছোট বয়সে পাখির কলরব শুনার জন্য গিয়ে বসে থাকতাম।  শীতের মৌসুমে সব চেয়ে বেশি পাখি এই গাছগুলিতে দেখা যেত, কেউ বলে সাইবেরিয়ান অতিথি পাখি। শীতের মৌসুম শেষ হলে এই অতিথি পাখিদের দেখা যেত না।    আমের মৌসুমে একটু ঝড় হলে গাছের নিচে কাঁচা/পাকা আম কুড়াতে যেতাম।  তবে অনেক সময় পাশের গোলবাহারের ছেলেপেলেরা আমাদের যাওয়ার আগেই কুড়িয়ে নিয়ে যেত।

শফিফুরা চৌধুরী বাড়ির ছেরু মিয়া ও ছলি মিয়া দুই ভাই ; এরা দুই ভাইয়ের দুটি ঘোড়া ছিল; সুদিন মৌসুমে ওরা এই দাগার মুড়ার নিকট থেকে মধুপুর পর্যন্ত খাস ভূমির উপর দিয়ে ঘোড় দৌড়ের প্রতিযোগিতা করতেন এবং আমরা অসংখ্য লোক দেখে আনন্দ পেতাম ।  কিন্তু আজকাল এই দাগার  মুড়া বা খাস জমির  চিহ্ন ও দেখি না ; এ সব খাস জমিতে আমরা খেলতাম, লোকজন গরু, ছাগল ছড়াতো।     

এক রাতে আমি একা একা  এই দাগার   মুড়ার  নিকট দিয়ে বাড়ি যাইতেছিলাম।  অন্ধকার রাত্রি, আমি এমনিতেই একটু ভীতু, জোরে জোরে হাঁটছি, মনে হচ্ছে  পেছনে কেউ হাঁটতেছে।  পিছন ফিরে কাউকে দেখি না।  যত জোরে হাঁটি, ততই মনে হচ্ছে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে  ।  আমার নিঃস্বাস জোরে জোরে বের হচ্ছে , কিন্তু আমি বুঝতে পারতেছি, কেউ একজন আমার পিছনে।  আমি এখন ভয়ে পিছনে তাকাতে সাহস পাই না।  আমাদের বড়ো বাড়ি থেকে একজন আমার বিপরীতে আসতেছে দেখে একটু সাহস পেলাম।  যেই লোকটা কাছাকাছি আসতেছে, আমি আর কারো হাঁটার আওয়াজ পাচ্ছি না।  শেষে সে আমাকে বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে বলে এখানে এই দাগার মুড়াতে কিছু একটা থাকে।  আমি তো শুনে ভয়ে হার্ট এটাক হওয়ার মতো অবস্থা।  

আমাদের বাড়ি থেকে “মনসা  ” বেশি দূরে নয়।  হিন্দু ধর্ম মতে মনসা, সাপ দেবী, নাগ পঞ্চমী নামেও পরিচিত  । সে যুগে মাঠে এই মনসাতে অনেক মুলি বাঁশের ঝোপ ছিল বা হয়তো এখনও আছে।  হিন্দু ধর্ম মতে  চাঁদ সদাগর অত্যন্ত প্রতাপশালী  প্রতিপত্তি ছিল এবং তার ছেলেরা নদীতে নৌকা নিয়ে ব্যবসা করতো।  চাঁদ সওদাগর  মনসাকে দেবী হিসাবে পূজা করতে রাজি হতো না। চাঁদ সওদাগর কিছুতেই মনসার পূজা করবে না ; মনসা অভিশাপ দিয়ে  তার ছেলেদের নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলে  এবং তাকে পূজা করার জন্য চাপ দিলে ও চাঁদ সওদাগর কিছুতেই রাজি না।  মনসা বলে  আমার পূজা না করলে তোমার একমাত্র  ছেলে লক্ষিন্দরকে ও বিয়ের রাত্রে সাপে কেটে মেরে ফেলবে। চাঁদ সওদাগর বলে আমি এমন ভাবে ঘর তৈরী করবো,তোমার সাপ কিছুতেই  ঘরে ঢুকতে পারবে না।  সওদাগর রাজ্ মিস্ত্রিদের বলে দিলো , ঘরে কোনও ছিদ্র সাপ ঢুকার মতো রাখা যাবে না।  কিন্তু রাতে মনসা স্বপ্নে রাজ্ মিস্ত্রিদের দেখালো, তোমরা ঘরে ছিদ্র রাখবে যাতে আমার সাপ ঢুকতে পারে।  অগত্যা ওরা একটিমাত্র ছিদ্র রেখে হালকা করে ঢেকে রাখে।

লক্ষিন্দরের ও বেহুলার বিয়ের রাতে মনসার সাপ ঢুকতে পারছে না।  মনসা রাজমিস্ত্রী কে বলে তোমরা  আমার কথা অমান্য করে ঘরে কোনও ছিদ্র রাখো নি।  রাজ্মিস্ত্রি বলে হ্যাঁ, মোম দিয়ে ঢেকে রাখছি। ঘরে ঢুকে বিয়ের রাতে সাপ  লক্ষিন্দরকে কেটে মেরে  ফেলে।

লক্ষিন্দরের স্ত্রী বেহুলা মনসার নিকট গিয়ে পূজা করে চাঁদ সওদাগরের ছেলেদের বাঁচিয়ে নিয়ে আসে।  এই মনসা মুড়াতে প্রতি বৎসর হিন্দু পূজা, ঘুড়ি উড়ানো,বাঁশি, আরও অনেক কিছু নিয়ে মেলা বশত , আমরা অনেক সময় পূজার সময় এই স্থানে গিয়ে পূজা দেখেছি এবং এটা সেটা কিনেছি ।  শুনেছি কেউ একজন বাঁশ কেটে ঘর বানিয়েছিলো এবং ঘরে অসংখ্য সাপ দেখেছে ।  ওখানে সাপ আছে কিনা জানিনা; তবে অনেক গর্ত দেখেছি।  লোকে বলতে শুনেছি, এখানে মনসার অভিশাপ দেয়া সাপ রয়েছে।  প্রতি বৎসর মেলায় ছেলেপেলেরা ঘুড়ি, বাঁশি ও অন্যান্য খেলনা  খরিদ করতো ।  সেই যুগে চার পয়সা,দুই আনা থাকলেই এটা সেটা কেনা যেত। পার্শে উজানী গ্রামে মনসার ঘর ও কিছু চিহ্ন ছিল বা আছে বলে লোকের ধারণা।     

গ্রামে গঞ্জে বা চরের জমি নিয়ে গুম , খুন, জোর করে দখল এ সব সে যুগে বা এ যুগের  নিত্য  ঘটনা ।   দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার সব সময় ছিল এবং আজ ও আমাদের সমাজ থেকে দূর হয় নি। 

আমি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র।  একবার আমাদের ফতেপুর এক জমি দখল নিয়ে মারামারি দেখতে  অনেকের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার মতো অনেক ছেলেরা ভয়ে কাঁপতেছিলো; কেউ কেউ কান্নাকাটি ও করেছে। সে যুগে  আমাদের এলাকাতে লাঠিয়াল টাকা দিয়ে পাওয়া যেত।  ওরা অনেক শক্তিশালী;  লাঠি , দা , কুড়াল, যার যা সম্ভব নিয়ে গিয়ে জমি দখল করিয়ে দিতো।  আমি বাড়ির আরো কয়েকজন মারামারি দেখতে গিয়েছিলাম।  এক পক্ষ জমি দখল করেছে এবং ওপর পক্ষ জীবনের ভয়ে জমিতে যায় নি; যার ফলে কোনো রকম অঘটন ঘটে নি।    

১৯৬৪ সন, আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র; লজিং থাকি  বাঘবেড়, ত্রিপুরা, ভারত  বর্ডারের কাছে । লজিং মাস্টার এয়ারফোর্স, করাচী, পাকিস্তান   কাজ করেন এবং দুই ছেলে এক মেয়ে আমার ছাত্র/ছাত্রী।     লজিং থেকে কলেজ ৭-৮ মাইল দূরে, সকাল ৮টা   বাজে  কলেজ রওয়ানা হই।  গোমতী নদী খেয়া পার হতে চার পয়সা করে দুইবারে আট পয়সা লাগতো ।  সে যুগে গোমতী নদী অত্যধিক খরস্রোতা ছিল।  অনেক সময় নদী পার হতে এত ভয় হতো, যে কোনো সময় নদীতে ফেরি তলিয়ে যাবে। 

এই নদী সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলছে , বর্ষার মৌসুমে পানির স্রোত দেখলে ভয় পেয়ে যেতাম।  এই নদীর উৎস ত্রিপুরা পাহাড়ি অঞ্চল ;  প্রতিবেশী ভারত বর্ষার মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে সুদিন মৌসমে ধরে রেখে কৃষি কাজের জন্য।  সে সময় প্রায় প্রতি বৎসর সুবর্ণপুর/ কুমিল্লা শহর  এলাকা নদী পার ভেঙে  শহর, গ্রাম, ও মাঠের , কৃষি নষ্ট হতো । 

১৯৬৪/১৯৬৫  সনে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান বনাম  ফাতেমা জিন্নাহ (মৌলিক গণতন্ত্র)  যে নির্বাচন হয়েছিল ; তাতে আয়ুব খান ভোট  প্রচার কালে কুমিল্লা এক জনসভায় আসলে  এখানকার কিছু  প্রতাপশালী লোক গোমতী নদীর ভাঙ্গন থেকে কুমিল্লা শহর রক্ষার জন্য  আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে  জরুরি ভিত্তিতে নদী  সংস্কার করা হলে,  নদী ভাঙা থেকে কুমিল্লা রক্ষা পায়।   

আমি “বাঘবেড় ” যে গ্রামে ছিলাম , ওই গ্রাম থেকে ত্রিপুরা বর্ডার হাঁটার পথ , এই পথ দিয়ে সে সময় প্রতিরাত চোরাচালান, ভারত থেকে টেন্ডু পাতা, মশলা, শাড়ি, গরু পাচার হতো।  রাত/ভোরে  বাহিরে বের হলেই লোকজনের আনাগোনা নজরে পড়তো।  

ভারত/পাকিস্তান চরম উত্তজনা এবং যে কোনও সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।

  একদিন আমি এবং আমার ছাত্র শাহজাহান সাহস করে  হাঁটতে হাঁটতে বর্ডার  পার হয়ে ত্রিপুরার ভিতরে  প্রবেশ করেছি ।  স্থানীয় লোকজন আমাদের দুইজনকে দেখে সতর্ক করে বলে, ”  তোমরা নিশ্চিয়ই পাকিস্তানের লোক , এ ভাবে  ঝুঁকি নিয়ে বিপদে পড়বে “।  টহলদার লোকদের চোখে পড়লে জীবন বাঁচানো কঠিন হবে। আমরা দুজনে যেভাবেই হক বর্ডার পার হয়ে সাওয়ালপুর দরগাহতে ঢুকে কিছু সময় অপেক্ষা করে বাড়ি আসি এবং এই  দুঃসাহসের  জন্য তিরস্কার শুনতে হয়েছে।    

১৯৬৮  সনে  আমি মতলব থেকে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা যাব।  আমি সন্ধ্যার দিকে চাঁদপুর লঞ্চ ঘাটে গিয়ে বেঙ্গল ওয়াটার বা কোনো বড়ো লঞ্চ ঢাকা যাওয়ার না পেয়ে ভাবছি মতলব ফেরত যাবো অথবা চাঁদপুর কোথায় ও রাতে কয়েক ঘন্টা থেকে ভোরের লঞ্চে যাবো।  আমার মতো আরো কিছু যাত্রী লঞ্চ ঘাটে ঢাকা যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ।  এ দিকে আবহাওয়া ভালো না, নদী গ্রমনের জন্য   তিন  নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেয়া হয়েছে।  একটা ছোট লঞ্চ ঢাকা যাবে বলে হুঁশিয়ারি সংকেত অমান্য করে তৈরী হচ্ছে দেখে আমি ও বেশি কিছু চিন্তা না করে অন্যদের সঙ্গে লঞ্চে উঠে কেবিনে বসলাম। হালকা বাতাস, সারেং হুঁশিয়ারি সংকেত অমান্য করে লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর প্রচন্ড ভাবে ঝড় শুরু হয়েছে এবং সারেং লঞ্চ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।  মানুষের চিৎকার এবং লোকজনের অর্থনাদ, ছুটাছুটি দেখে আমি ভয়ে জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছি।  ভাবছি একেতো রাতের অন্ধকার, ওপর দিকে লঞ্চ ডুবে গেলে বাঁচার সম্ভবনা খুবই কম।  আমি একটা ভেলা ধরে বসে আছি যদি লঞ্চ ডুবে যায় অযথা বাঁচার জন্য চেষ্টা করতে হবে।    লোকজন কেউ কারো কথা শুনে না , নিচে ডেকের যাত্রী উপরে এসে পড়াতে প্রচন্ড ভিড় ও লঞ্চ বাতাসে দুই দিকে ঝুঁকে  যাচ্ছে।  সারেং বা লঞ্চের কর্মচারীরা যতই বলে আপনারা নড়বেন না ; কিন্তু কেউ কারো কথা শুনে না।  সারেং অনেক চেষ্টা করে নদীর কিনারে লঞ্চ ভিড়িয়ে দিলে লোকজন মাঠে উঠে যায়।  এ অবস্থাতে বেঁচে যাওয়া এক আশ্চর্য্য  কেরামতি বলে আমরা অনেকেই মনে করলাম।  কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর বাতাস থেমে গেলে সারেং পুনরায়  লঞ্চ ছেড়ে আমাদের ঢাকা  নিয়ে যায় ।  

সমাপ্ত

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৌড়, আরও জোরে আরও…
পরবর্তী নিবন্ধঅবুঝ কিশোর
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন