অধিক জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে গত ২রা জুন, ২০২২  কানাডায় অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল ইলেকশন হয়ে গেলো। 

ডলি বেগম আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।নিকটতম প্রার্থীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুন ভোটের ব্যাবধানে দ্বিতীয় বারের মতো এম পি পি  (মেম্বার অব প্রভিন্যিল পার্লামেন্ট) নির্বাচিত হলেন ।জয়, জয়,ডলি বেগমের জয়। কানাডার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বাঙ্গালীর মুখে মুখে শুধু ডলি বেগম। কে এই ভাগ্যবান  বাবা যার মেয়ের নাম বাঙ্গালীদের মুখে মুখে?  

 সিলেটের মৌলভীবাজারে জন্ম নেয়া এই ডলি বেগম শিশু অবস্থায় বাবা মায়ের সাথে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কানাডাতে চলে আসেন। এরপর, স্কুল, ইউনিভার্সিটি পড়া শেষে  রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ডলি বেগম রাজনীতিতে ঢুকার পূর্বে এ দেশে  সমাজ কল্যাণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে এ  প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এ পথে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অনেকেই তাঁকে স্বরণ করে এগিয়ে যাবে।  

কানাডা এক  বহু জাতিক রেফিউজি দেশ।  এ দেশে সারা পৃথিবীর লোক শান্তিপূর্ণ ভাবে বাস করে; এদের  শরীরের গঠন এক রকম নয় ।   কারো বৃহত্তর শরীর, লম্বা নাক, সাদা  বা কালো রঙ,আবার করো ছোট চ্যাপ্টা নাক, ছোট শরীর;   হেজেল, নীল বা সবুজ চোখ সহ মাঝারি বাদামী থেকে হালকা বাদামী, কালো  বা স্বর্ণকেশী চুল।   সমস্ত কালো আফ্রিকান/ আমেরিকান প্রাকৃতিকভাবে মিশ্র কোঁকড়ানো চুল । এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের লোকদের ভাষা ও  অ্যাকসেন্ট  ভিন্ন ভিন্ন রকম  যেমন ব্রিটিশ ইংলিশ আর কানাডিয়ান ইংলিশ স্পিকিং লোকদের কথাবার্তা ভিন্ন রকম।  সবার শিকড় বাহিরে, কে অরিজিনাল কানাডিয়ান বলা মুশকিল; ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করলে বলে ” I  AM  BORN  CANADIAN “।  সরাসরি মুখ বন্ধ করে দিলো ; হয়তো তার পেরেন্টস বাংলাদেশী বা শ্রীলংকান বা ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানী বা অন্য কোনো দেশ। কাজেই নিজের দেশের একজন এম পি পি  ( মেম্বার অফ প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট )পাওয়া অনেক ভাগ্যের কথা; যদিও আমাদের দেশের মতো কেউ চাকরি (ব্যবসা ) তদবিরের জন্য ধারে কাছে ও যায় না বা তার অফিসে ভিড় জমায় না।  এ দেশে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী বহু যুগ থেকে শিকড় গেঁড়ে আছে এবং সংসদে ওদের লোক পাওয়া যায়। এমন কি সোমালিয়ান(মিনিস্টার হোসাইন) এবং আফগানিস্তানি (মিনিস্টার মিসেস মারিয়াম )  ও এদিক থেকে বেশ এগিয়ে আছে।      

কানাডার  ১০টি প্রভিন্স এবং তিনটি টেরিটরির  মোট লোকসংখ্যার (৩৬ মিলিয়ন)   ৩৮% অন্টারিও প্রদেশে, ২৩ % কুইবেক, ১৩%ব্রিটিশ কলোমবিয়া, ১২ %আলবার্টা।   বাকি লোক অন্যান্য প্রদেশ ও  তিন টেরিটোরিতে  বাস করে।  YELLOWKNIFE 0.12%,NUNAVUT  0.01% ও YUKON  0.01% বাস করে।  অতিরিক্ত বরফ ও  শীতের দরুন এই তিন টেরিটোরিতে  লোক সংখ্যা একেবারেই কম।  

প্রতিটি প্রদেশ ও টেরিটোরির নিজস্ব স্বায়ত্তশাসন (AUTONOMY ) থাকায় বিভিন্ন সময় নিজেদের সুবিধামতো ইলেকশন করে  থাকে।

প্রিমিয়ার  মিস্টার ড্যাগ ফোর্ড, অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল কনজারভেটিভ পার্টি থেকে আরেকটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন ।

মে মাসের তিন তারিখ থেকে ২রা জুন পর্যন্ত মোট ২৮ দিন বিভিন্ন পার্টি ও স্বতন্ত্র ব্যাক্তিগনের জন্য সরকারিভাবে ভোট প্রচার করার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল।  ২০১৮ থেকে ২০২২, এই চার বৎসর কনসারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় ছিল এবং যেহেতু ড্যাগ ফোর্ড মোটামোটি ভালোই চালিয়েছেন , অনেকেই ধারণা করেছিল আবার ও কনজারভেটিভ ক্ষমতায় আসতে পারে এবং বাস্তবেও তাই হলো।    

এ দেশে রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা নির্বাচনী অর্থায়নের জন্য প্রবিধানের (REGULATION)মুখোমুখি হতে হয়; কোনো দল বা ব্যক্তি কত অর্থ প্রচার কাজে খরচ করবে তা সরকার লক্ষ   রাখে এবং ইলেক্শনের পর তাকে সরকারের নিকট জানাতে হয় । রাস্তায় বের হলে বিভিন্ন লোকের পোস্টার রাস্তার পাশে নজরে পড়েছে, তবে দু/একজনকে বাড়িতে এসে দরজা নক করে কাগজ দিয়ে যেতে দেখেছি। আমার বাড়ির সামনে কোনো পোস্টার লাগানো হয় নি।  

সকল ভোটারের জন্য ভোট দান সহজ করার জন্য, এ দেশে  অগ্রিম ভোট দান এবং মেইলের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার মতো বিকল্প নিয়ম রয়েছে এবং সে জন্য অনেকেই অগ্রিম ভোট দিয়ে থাকে। আমি নিজেও অগ্রিম ভোট দেয়া পছন্দ করি এবং দিয়েছি।     

অন্টারিও প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভরা টানা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার জিতেছে, এবং ৮৩ টি রাইডিংয়ে নির্বাচিত হয়েছে।এটি আগের নির্বাচনের চেয়ে বেশি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ৬৩ টিরও বেশি।

এনডিপি আবারও সরকারী বিরোধী দল গঠন করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে কারণ তারা দ্বিতীয়-সর্বাধিক আসন পেয়েছে , তবে দলের নেতা মিসেস আন্দ্রেয়া হোরওয়াথের (ANDREA HORWATH)পক্ষে এটি যথেষ্ট ছিল না, যিনি সরাসরি ঘোষণা করেছেন  যে তিনি তার চতুর্থ নির্বাচনী চক্রে সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পরে নেতা পদ থেকে পদত্যাগ করবেন।  দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দেয়ার পর আন্দ্রেয়া যখন বুঝতে পেরেছেন তাঁর দ্বারা সরকার গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না, বিলম্ব না করে সরাসরি জনগণের নিকট নিজের অক্ষমতা ব্যাক্ত করলেন।  আন্দ্রেয়া কোনোরকম কারণ দেখাতে চাইলেন না এবং অন্যকে নেতৃত্ব দিয়ে সরে পড়বেন বলে অঙ্গীকার করলেন।  আন্দ্রিয়া হার্ডওয়ার্কিং লেডি এবং জনগণের স্বার্থে পার্লিয়ামেন্টে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন এবং ভালো নেতৃত্বের জন্য তাঁর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে  ।  তাছাড়া সে নিজে পাশ করা স্বত্তে ও পার্টির স্বার্থে নেতৃত্ব ধরে রাখতে চাইলেন না।  তাঁর এই সুন্দর দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অনেক শিক্ষণীয় আছে ।   

স্টিভেন আলফনসো দেল ডুকা(STEVEN ALFONSO DEL DUCA)  একজন কানাডিয়ান রাজনীতিবিদ যিনি ৭ ই মার্চ, ২০২০ সাল থেকে অন্টারিও লিবারেল পার্টির নেতা। লিবারেলদের জন্য এটি আরেকটি খারাপ প্রদর্শন ছিল – দলের নেতা স্টিভেন দেল ডুকা( ভন- উডব্রিজ রাইডিং থেকে ) জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন এবং নেতা পদ থেকে সরাসরি কোনো কারণ না দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। 

গ্রিন পার্টির নেতা মাইক শ্রেইনার (গুয়েলফে রাইডিং থেকে)  পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে গ্রীন পার্টি থেকে তিনিই   একমাত্র লিডার পাশ করেছেন; ভোটার কনসারভেটিভ ,লিবারেল এবং NDP (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিভ পার্টি ) পছন্দ করে।  

কানাডার রাজনীতিতে কোনোরকম মারামারি (রক্তক্ষরণ) দেখা যায় না।  জনগণ চাইলো না বা সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে সরে পড়েন এবং অন্য কিছু করে জীবনযাপন করেন।  এদের অনেকের  যথেষ্ট সাপোর্ট থাকা স্বত্তে ও  নিজের মানসম্মান নিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন।  কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এ দৃষ্টান্ত দেখা যায় না, গদিতে একবার বসলে বিনা রক্তপাতে আর নামতে চায় না ।  

সমাপ্ত

 

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাচনিকের নবীন বরণ
পরবর্তী নিবন্ধপদ্মার জয়
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন