পর্ব -২
অনেক দিন আগের কথা,এক ব্যাবসায়ী বাংলাদেশ থেকে কানাডার গ্রীষ্মের কোনো এক সময় ভেঙ্কুভার, নোভাস্কোশিয়া, আলবার্টা হয়ে টরন্টো এসে মন্তব্য করেছিল ,”আমিতো কানাডায় শীত আর বরফ দেখছিনা বরং সারা কানাডা সবুজ আর বিভিন্ন রং বেরঙের ফুলের সমারোহ দেখছি ।মনে হয় এ দেশকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । এখানকার রাস্তাঘাট,NIAGARA WATER FALLS এর বিউটি,আর বড়ো বড়ো শহর ও গ্রামের দৃশ্য দেখে ভাবছি ,এতো এক স্বপ্নের দেশে বেড়াতে এসেছি । আমি বললাম , আপনি সত্যি বলছেন, সে জন্য এ দেশে লক্ষ লক্ষ পর্যটক প্রতি বৎসর গ্রীষ্মে আসে । ভদ্র লোক খানিকটা হেসে সায় দিলেন।
এখানে পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য কোনো গাছ কেউ কাটতে পারেনা, এগুলি সবই মিউনিসিপালিটি এক্তিয়ার ।এই দেশকে সুন্দর রাখার জন্য প্রতিটি মানুষকে নিয়ম মেনে চলতে হয়। এখানে রাস্তা ঘাটে কোনো ময়লা, কফ, থুথু, অপ্রয়োজনী কাগজ, প্লাস্টিক ব্যাগ, সফ্ট ড্রিংক বোতল ফেলা যায়না, । যেখানে সেখানে রাস্তায় বা জঙ্গলে পায়খানা প্রস্রাব করা যায় না । নিজেদের প্রয়োজনে, রেস্টুরেন্ট, বা শপিং প্লাজায় পাবলিক টয়লেটে যেতে পারেন । আপনি যাই কিছু রাস্তায় ফেলবেন, পিছন থেকে একজন রিপোর্ট করে দিলে, আপনাকে পুলিশ ৫০০ ডলার জরিমানা করে দেবে। আজকাল সর্বত্র ক্যামেরা বসানো আছে, জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাবেন না। বাসায় আপনার ঠিকানায় ক্যামেরার ছবি সহ বিল চলে আসবে। বিল পছন্দ না হলে অবশ্য কোর্টে যেতে পারেন। জজ অনেক সময় ফেভার করে বিল একটু কমিয়ে ও দিতে পারে ।
গ্রীষ্মে এখানে অতি দ্রুত প্রতিযোগিতা দিয়ে গাছ পালা বাড়ে, বাড়ির চারি দিকে ঘাস কেটে সুন্দর করে রাখার জন্য এক জাতীয় মেশিন (লন মোয়ার)দিয়ে ঘাস কেটে দিতে হয়। এ দেশের লোক ফুল পছন্দ করে, প্রতিটি বাড়ির সামনে নানান ফুলের গাছ লাগানো হয়। তাছাড়া প্রতিটি বাড়ির পিছনে সবজি বা ফলের বাগান করার ব্যবস্থা আছে। আপনার পছন্দ মতো বাগান করবেন, নিজে খাবেন ও বন্ধুদের দিবেন ।
কানাডার শীতকাল (উইন্টার) অত্যধিক ঠান্ডা এবং বরফে ঢাকা থাকে । এ সময় স্নো ব্লোয়ার (MACHINE) দিয়ে আপনার বাড়ির সামনের বরফ পরিষ্কার না করলে অনেক সময় ঘরের দরজা খোলা যায় না ।এখানে প্রতিটা মানুষকে কাজ করতে হয়। এটা বাংলাদেশ নয়, চাকর বা চাকরানী দিয়ে কাজ করাবেন। তা ছাড়া ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং এবং বাড়ি রেনোভেশনের কিছু কাজ জানতে হয়। একজন লোক ডেকে কাজ করালে একশত থেকে দুই শত ডলার বিল বা অবস্থা বুঝে তার ও বেশি দিতে হয় । সে জন্য এখানে সবাই কিছু হাতের কাজ জানে।এ দেশ ৬/৭ মাস ঠান্ডা থাকে, তা ছাড়া দেশের উত্তর অংশ, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, Yukon টেরিটোরি অত্যধিক ঠান্ডা ও বরফে ঢাকা থাকে । এ সব পরিস্থিতিতে ও আমাদের ছেলে মেয়েরা দৈনিক দশ /বার ঘন্টা দাঁড়িয়ে এক টানা কাজ করে দেশে ডলার পাঠায় বা নিজেদের পড়াশুনার খরচ যোগায় । মে থেকে সেপ্টেম্বর পয্যন্ত আবহাওয়া কমফোর্টেবল যাকে গ্রীষ্মকাল বলে ।
আমাদের বাংলাদেশ ট্রপিকাল ক্লাইমেট, সারা বৎসর অল্প, বিস্তর বৃষ্টিপাত হয়। যে কোনো গাছ লাগালে, অল্প যত্নে বেড়ে উঠে । ইচ্ছে করলে আপনারা বাংলাদেশকে অতি সহজে সবুজ গাছ,ফুলে বা ফলের গাছ লাগিয়ে সাজিয়ে দিতে পারেন।
আমাদের ছেলে মেয়েরা দেশের বাহিরে গেলে অন্যান্য দেশের ছেলে মেয়েদের চেয়ে ও বেশি কাজ করে । এখানে উল্লেখ্য যে , ২০১২ সনে আমি হজ্জে সৌদি আরব গিয়েছিলাম ।মক্কা, মদিনা ও জেদ্দার পথে আমাদের ইয়ং ছেলেদের মরুভুমির প্রচন্ড রোধে রাস্তার দুই পার্শে গাছে পানি দিতে ও রাস্তায় ঝাড়ু দিতে দেখেছি । বাস থেকে নেমে ,সুযোগ পাইলেই ওদের খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করেছি । এদের অনেকেই হাইলী এডুকেটেড। অনেক টাকা এজেন্ট বা দালালকে দিয়ে কোনো রকমে কাজ ম্যানেজ করেছে। অনেকেই দুঃখ করে বলেছে ,”যে টাকা খরচ করে এসেছি তা উঠাতে কয়েক বৎসর লাগবে। ” তা ছাড়া তাদের পাসপোর্ট কোম্পানি রেখে দিয়েছে,উপায় নেই, কাজ করে কন্ট্রাক্ট শেষ করে পাসপোর্ট নিয়ে চলে যেতে হবে বা অন্যত্র কাজ ম্যানেজ করতে হবে ।” মরুভূমির তাপমাত্রা (৪৫ থেকে ৫০ সেলসিয়াস )সম্পর্কে আপনাদেরকে আর কি বলবো । ওরা ও মানুষ, ওদের দুরবস্থার কথা ভাবতে গিয়ে,ভূপেন হাজারিকার গানের সেই লাইন ক’টা মনে পড়লো: “মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু…” ।
আমেরিকার সব চেয়ে ধনী ও শিক্ষিত হলো ইহুদীরা । দেশের অর্থনীতির একটা বিরাট অংশ ওদের হাতে । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এরা ইউরোপে সর্বস্ব হারিয়ে খালি হাত পা নিয়ে রেফিউজি হিসেবে এসে নিজেরা আমেরিকার কলে কারখানায় , বা যেখানে সেখানে কাজ করে ছেলে মেয়েদের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। আজ এদের ছেলে মেয়েরা সব চেয়ে বড় শিক্ষিত ও ধনী । বৈজ্ঞানিক Albert Einstein ওদেরই একজন যাকে সারা পৃথিবীর লোক জানে।
এ দেশে স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি গুলিতে ভলান্টিয়ারিং প্রাকটিক্যাল কাজের প্রোগ্রাম থাকে । বিশেষ করে এখানকার হসপিটালে ঢুকলে দেকবেন সব ভলান্টিয়ার ছেলে মেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আপনাকে সাহায্য করার জন্য। আপনাকে দেখা মাত্র হাসিমুখে বলবে ;”May I help you sir/madam?” ওদের হাসি হাসি কথায় আপনার রোগ অর্ধেক সেরে যাবে। ছেলে মেয়েরা তাদের নিজস্য ফিল্ডে ভলান্টিয়ারিং কাজ করতে বাধ্য । ভলান্টিয়ারিং কাজ না করলে জব স্কিল কি ভাবে দেখাবে? উদাহরণ স্বরূপ: একজন মাস্টার ডিগ্রী প্রাপ্ত লোক এ দেশে টিচার হতে চাইলে তাকে ব্যাচেলর অফ এডুকেশন করতে হয়। অন্তত এক বৎসর স্কুলে ভলান্টিয়ারিং((বিনা বেতনে) কাজ করে, তার পর পার্ট- টাইম কাজ (সপ্তাহে কয়েক দিন) অন্তত ৫/৭ বৎসর বা তার ও বেশি, ভাগ্য ভালো হলে পরে একটা ফুল টাইম কাজ পেতে পারে । তদবির করবেন, ও সব এ দেশে চলে না। অবশ্য এক্সেপশন স্টুডেন্ট/এক্সেপশন চান্স সর্বত্রই থাকে ।
আমাদের দেশে ছেলে মেয়েরা শুধু পড়া শুনা করে (রিলাক্স লাইফ), যদি অন্তত মাসে দুই ঘন্টা ও ভলান্টিয়ারিং গ্রাম বা শহরের নিজ নিজ এলাকায় পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজ করতো, তাতে দেশের পরিবেশ ফিরে আসতো । গ্রাম বা শহর সুন্দর এবং জনগণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সতর্ক থাকতো । ছাত্র/ছাত্রীদের ভালো/মন্দ সব ধরণের কাজের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার । নিজে নিজের কাজ করলে অবশ্যই আনন্দ ও পাওয়া যায় । সবাই একটু কাজ করলে দেশ মশা মাছি থেকে মুক্ত এবং রাস্তা ঘাট, দোকান সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু/ চিকুনগুনিয়া বা ম্যালেরিয়া রোগের ভয়াবহতা রয়েছে। প্রতি বৎসর হাজার হাজার মানুষ মশার আক্রমণে মারা যায় । মাছির জন্য রেস্টুরেন্ট বা মিষ্টির দোকানে ঢুকাই যায় না, যে হেতু চারি দিকের পরিবেশ নোংরা, আবর্জনা। আমাদের ছেলে মেয়েরা পড়া শুনার সঙ্গে সঙ্গে তার চারি দিকের পরিবেশ কি ভাবে সুন্দর পরিষ্কার / পরিছন্ন থাকবে সে দিকে একটু লক্ষ রাখলে, তার পাশের মানুষটি ও ভালো থাকবে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ধর্মের অঙ্গ।
আমরা সর্বদা গৌরব বোধ করি আমাদের ছাত্র সমাজকে নিয়ে।স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ছাত্র/ছাত্রী যে অবধান রেখেছে, জাতি কোনো দিন ভুলে যাবে না। দেশকে সুন্দর, পরিষ্কার পরিছন্ন ও রোগমুক্ত করার জন্য আমাদের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সমাজ এগিয়ে আসবে, এই আশাকরি।