সপ্তাহান্তের ছুটিতে একটি ইংরেজি ছবি দেখছিলাম। নাম ‘The Lighthouse’। ২০১৯ সালে কানাডা -আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে এই সাদা কালো ছবিটি নির্মিত হয়। এটি চিত্রায়িত হয়েছে কানাডার অন্যতম প্রভিন্স Nova Scotia’র Cape Forchu এবং Yarmouth এ। একই নামে বিখ্যাত রহস্য উপন্যাসিক Edgar Allan Poe এর একটি বই রয়েছে যদিও ছবিটির মূল কাহিনীর সাথে Edgar Allan Poe এর The Light House গল্পের মিল খুবই সামান্য। ছবিটির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন Willem Dafoe ও Robert Pattinson। এরা Light House বা বাতিঘরের দুই রক্ষক। ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে এই দুজনকে ঘিরে যারা প্রত্যন্ত এক দ্বীপে ঝড়ের কারণে আটক পড়েন এবং ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এটি একটি ভৌতিক ছবি। হরর বা ভৌতিক ছবি আমার আগ্রহ বা পছন্দের বিষয় নয়। বলাবাহুল্য ছবির বিষয়বস্তুর চাইতে এর শিরোনামটিই আমার কাছে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, ভাবিয়েছে নুতন করে।
Light House আশা, স্বপ্ন ও দিক নির্দেশনার প্রতীক। Light House থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় বিক্ষুব্ধ নৌপথে, সমুদ্রে দিশাহারা নাবিকরা সযতনে এড়িয়ে চলেন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাসমূহ, খুঁজে পান পথের দিশা, নির্বিগ্নে পৌঁছুতে পারেন নিজের গন্তব্যে। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা GPS এবং অন্যান্য প্রযুক্তির উদ্ভবের কারণে এর গুরূত্ব কিছুটা কমে গেলেও Light House এর মর্যাদা এখনো কমেনি। হাজারো নাবিকদের কাছে এটি এখনো “Beacon of Hope“। সাতত্রিশ মাইল (২০ নটিক্যাল মাইল) দূরে থেকেও এর আলো দেখে এখনো নাবিকরা তাদের Navigational Route খুঁজে পান।
শুধু নৌপথ বা সমুদ্রের নাবিকদের জন্যই নয়, আমাদের পরিবারে, সমাজেও এরকম কিছু মানুষ আছেন যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও স্থির দন্ডায়মান Light House এর মতোই অবিচল থাকেন, আলোকিত করে যান আমাদের যাত্রাপথ। একটু ভাবলে সংখ্যায় বেশি না হলেও এরকম অনেক দৃষ্টান্তই খুঁজে পাওয়া যায়। আমার নিজের পরিবারেও এরকম একজন আছেন। উনি আমাদের ছোট চাচা। সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অসময়ে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব। উনি EPCS (তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) অফিসার হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে তার কর্মজীবন শুরু করেন। জীবনভর এই মানুষটি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দক্ষতার সাথে কাজ করে গেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে থেকেও অতি সাধারণ, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। কোনো বাহুল্য দেখিনি কখনো। নৈতিকতার ভিত্তি ছিল অকল্পনীয়। সৎ ও চৌকষ কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ সচিবালয়ে চাচার একটি বিশেষ পরিচিতি ছিল। আমি নিজে দেখেছি সচিবালয়ে চাচার অফিস কক্ষে প্রবেশের আগে অন্য কর্মকর্তাদের ভীতসন্ত্রস্থতা। সৎ, ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিত্বের হয়তো এমনিই ঝাঁঝ থাকে। দলবাজি বা রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে পদোন্নতি বা মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টার পরিবর্তে ন্যায়নিষ্টতার সাথে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়াটাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। সেজন্যই হয়তো যথাযথ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সচিব হতে পারেননি। এনিয়ে কষ্ট পেলেও কখনো আক্ষেপ করেননি। আমাদের এই ছোট চাচার সাথে আমাদের সম্পর্ক তুলনাবিহীন। আমাদের তিন ভাইয়ের লেখাপড়ার হাতেখড়ি চাচার কাছেই। আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য চাচার উৎসাহ ছিল নিরন্তর। পারিবারিক দুর্যোগে, সুদিনে, দুর্দিনে আব্বার পাশে সবার আগে ছুঁটে আসতেন আমাদের এই ছোটচাচা। আব্বা চলে যাওয়ার পর থেকেই চাচা ধীরে ধীরে মনোবল হারিয়ে ফেলেন। গত এক বছরে অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এখন বেশ অসুস্থ। সবাই দোয়া করবেন যাতে আল্লাহ্পাক চাচাকে সুস্থতা দান করেন। Light House এর এই Beacon যাতে তীব্র আলো ছড়িয়ে যেতে থাকেন। সেই আলোয় আমরা যাতে অতিক্রম করতে পারি আরো সুদীর্ঘ পথ।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে