মানুষকে আল্লাহ্পাক বিপুল সম্ভাবনার অধিকারী করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। অন্তর্নিহিত এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ অসাধ্য সাধন করেন। পৌঁছে যান উৎকর্ষতার সর্বোচ্চ সোপানে। আবার  অধিকাংশ মানুষই আমরা  নিজের ভিতর লুকিয়ে থাকা অপরিমেয় এই ক্ষমতা অনুধাবন, পরিচর্যা  বা প্রয়োগের ধারে কাছেও যেতে পারিনা। ফলে সুখ, সম্মৃদ্ধি বা অর্জনের পাল্লা খুব একটা ভারী হয়ে উঠে না ।  প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির হিসাব মিলাতে মিলাতেই অনেকেই চলে আসি জীবন সায়াহ্নে। মানুষকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হলেও এই ক্ষমতা নিমেষে নিস্শেষ হওয়ার মতো কিছু  সহজাত বৈশিষ্ট মানুষ তার সাথে করেই নিয়ে আসে। ‘Impulse’ বা তাড়না অথবা বৃহত্তর অর্থে প্রবৃত্তি এরকমই একটি বিষয়। পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গাতেই আত্মশুদ্ধি এবং প্রবৃত্তি দমনের তাগিদ এসেছে অনেকভাবে।  সূরা ‘সাদ’ এর ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ অতএব তুমি মানুষের মাঝে সুবিচার করো এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করোনা। প্রবৃত্তির অনুসরণ তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।” সূরা শামস এর ৯-১০ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, “অতএব যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে সেই সফল, আর যে নিজেকে কলুষিত করেছে সেই ব্যর্থ। “ সূরা কাসাসের ৪৯-৫০ আয়াতেও প্রায় সমার্থক সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, “ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে যে  নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে ?”  পবিত্র কুরআন ছাড়াও রাসূলে পাকের (সা) অনেক হাদিসেও একই বিষয়ের অবতারণা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে। বলা যেতে পারে ইসলামে আত্মশুদ্ধির জন্য প্রবৃত্তি দমনের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের গন্ডি ছাড়িয়ে সমসাময়িক মনোস্তত্ত্বেও  ‘Self Restraint’ এবং “Impulse Control“ এর মতো বিষয়গুলো গবেষণার নুতন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই বিষয়ে বিখ্যাত একটি গবেষণা হচ্ছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী  Walter Mischel  এর ‘The  Marshmallow Experiment’। অধ্যাপক ওয়াল্টার ৪-৫ বছরের কিছু বাচ্চাদের সামনে  Marshmallow রেখে বলেছিলেন যারা এখনই marshmallow খাবে তারা পাবে একটি আর যারা একটু অপেক্ষা করে দেরীতে খাবে, তারা পাবে দুটো। দেখা গেলো বেশিরভাগ বাচ্চাই তাদের সামনে রাখা marshmallow তখনই খেয়ে ফেলে। অল্প কয়েকজন বাচ্চা অনেক ধৈর্য্য নিয়ে পনেরো মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করে দুটো marshmallow নেয়ার জন্য। অধ্যাপক ওয়াল্টার এবং তার টিম এই বাচ্চাগুলোকে পূর্ণ বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত অনুসরণ করে দেখতে পেয়েছিলেন যে যারা নিজেদের তাড়নাকে সংযত বা আত্মনিয়ন্ত্রন করতে পেরেছিলো, পরবর্তীতে তারাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অধিকতর সফলতা অর্জন করে ।
‘Bible of  Psychiatry’ বা মনস্তত্বের বাইবেল খ্যাত Diagnostic &  Statistical Manual এর পঞ্চম সংস্করণে এই impulse control কে একটি বিশেষ রোগে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “it is a class of psychiatric disorders characterized by impulsivity – failure to resist a temptation, an urge or an impulse.”  খুব সহজ বাংলায় বিশ্লেষণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় প্রবৃত্তি/ঝোঁক বা তাড়নার বশবর্তী হয়ে ভালো  মন্দ বিবেচনা বা পরিণতি চিন্তা না করেই কোনো কিছু  করা বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর স্পৃহা । সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পশু পাখি, জীব জন্তুর সাথে মানুষের পার্থক্য বোধহয় এখানেই । জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং প্রবৃত্তি দমনের তাগিদ মানুষের আছে, জন্তু-জানোয়ারের নেই। থাকার কথাও নয় । থাকলে তারাই সৃষ্টির সেরা জীব হতো, মানুষ নয় । এই প্রবৃত্তি বা তাড়না নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনেও অবক্ষয় ও অঘটন ঘটার সম্ভাবনাই বেশি । পরকালের অন্তহীন জীবনে এর পরিণামের প্রসঙ্গ আপাতত না হয় বাদই দিলাম।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন