কাজের সূত্রে মাঝে মাঝে যেতে হয় টরোন্টোর বিভিন্ন হাসপাতালে। লক্ষ্য থাকে কোনো রুগীর সাথে সাক্ষাৎ করা, কখনো সেই রুগীর হয়ে ডাক্তার, নার্সদের সাথে কথা বলা আবার কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট রুগীর ডিসচার্জ প্ল্যানিং এ অংশ নেয়া। বলা বাহুল্য, এগুলো কেস ম্যানেজমেন্ট কাজেরই অংশ। এসব কাজ এখানে না করলেও কারোরই স্বাস্থ্য সেবা বিঘ্নিত হবে না। এদেশে মিছিল, বিক্ষোভ করে মৌলিক অধিকার আদায়ের দরকার পড়ে না। অধিকার তার বিধিবদ্ধ, নিরবিচ্ছিন্ন গতিতেই সবার দোর গোড়ায় এসে হাজির হয়। সবার জন্য সমান ভাবেই। কিন্তু এখানেও কিছু মানুষ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের কারণে বুঝতে পারেন না যে তাদের প্রাপ্য, আইনগত বা সামাজিক সুবিধাগুলো ঠিকমতো পাচ্ছেন কিনা। মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে আমাদের কাজ হচ্ছে সেই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা কার্যক্রমের প্রবাহ নিশ্চিত রাখা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি এসব মানুষদের অনেকেরই আত্মীয় স্বজন কেউ নেই, নেই কোনো অবলম্বনও। তবুও এদের জীবন চলে জীবনের গতিতেই। দুঃখ কষ্ট, জরা ব্যাধি, সব কিছুতেই এরা নির্বিকার। মাথার উপর ছাদহীন অনিশ্চিত জীবন, তবুও কোনো আক্ষেপ নেই। নিরাশার অন্ধকারেও এরা খুঁজে বেড়ায় অজানা কোনো এক সুখের আলো।

সুখ শব্দটি আসলেই আপেক্ষিক। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সুখ নিয়ে নানাবিধ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। এ নিয়ে লেখালেখি, গবেষণাও হচ্ছে বিস্তর। Bertrand Russell, Deepak Chopra, Eckhart Tolle, Tony Robbins, Robin Shorma, Rhonda Byrne, Bob Proctor এর মতো ‘Motivational’, “Life Coaching” এর বিশেষজ্ঞরা সুখ ও সুখের অনুষঙ্গ নিয়ে রচনা করেছেন অসাধারণ কিছু বই। সন্দেহ নেই, যে কেউ উদ্দীপ্ত হতে পারেন এসব বই পড়ে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় সুখ কি তা বুঝার জন্য এসব বই না পড়লেও কিছু যায় আসে না। সুখের মর্মার্থ বুঝার আরো অনেক বাস্তব মাধ্যম রয়েছে। হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়া এর মধ্যে একটি। আরো ভালো হয় হাসপাতালের “Palliative Care” ইউনিট ঘুরে আসতে পারলে, জীবন-মৃত্যু যেখানে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতোই দুলে। একসময়ের দুর্দান্ত জীবন কাটানো মানুষগুলো যেখানে প্রতীক্ষায় থাকেন পরপারের ডাকের। আমরা অনেক সময় সামান্য না পাওয়াতেই হতাশায় ডুবে যাই, ভাবি বেঁচে থাকার সার্থকতা কি। নিজেদেরকে সহসাই নামিয়ে ফেলি দুর্ভাগা মানুষের দলে। কখনো ভাবি না, যে মানুষটি টরন্টো ওয়েস্টার্ন হাসপাতালের নবম তালায় জটিল ‘Ogilvie Syndrome’ নিয়ে ছুটোছুটি করছে অথবা যে রুগী সেন্ট মাইকেল হাসপাতালের নিউরো সার্জারী ক্লিনিকে ‘Hydrocephalus’ রোগের কারণে মাথার ভিতরে টিউব স্থাপন করে অতিরিক্ত তরল পদার্থ শরীরের অন্য অংশে প্রবাহিত করার সার্জারির চেষ্টা করছে, তাদের কাছে সুখের সংজ্ঞা কি হতে পারে। দুনিয়াতে আল্লাহ্পাকের সবচেয়ে বড় নিয়ামত হচ্ছে সুস্থ্য শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা। এর অবর্তমানে জীবনে সুখের বাকি সব উপকরণ নিতান্তই অর্থহীন। আপেলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা Steve Jobs যথার্থই বলেছিলেন, “What is the most expensive bed in the world? Sick bed…You can employ someone to drive the car for you, make money for you but you cannot have someone to bear the sickness for you. ………. When a person goes into the operating room, he will realize that there is one book that he has yet to finish reading – Book of Healthy Life.”।

জীবনভর প্রাচুর্যের পিছনে ছূটে চলা স্টিভ জবস মৃত্যুশয্যায় শায়িত থেকে যে উপলব্দি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তা আমাদের কাছে হয়তো খুব একটা অজানা নয়। রুনা লায়লার গানের মতোই মাঝে মাঝে আমাদেরও, “সুখ তুমি কি, বড়ো জানতে ইচ্ছে করে”। কিন্তু বিত্ত-বৈভবের অন্নেষনে বিভোর আমরা এ নিয়ে খুব একটা ভাবি না । অথবা ভাবি এমন এক সময়ে যখন কোনো ভাবনাই আর কাজে আসে না । জীবন ও জগৎ হয়তো তখন সব ভাবনার উর্ধে।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন