২০শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৮
দুপুর ২টায় বাংলাদেশ বিমানের ডিসি-১০ যখন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ে ছেড়ে আকাশে ভাসলো, সেদিন সেই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি যে যা্ত্রা শুরু করলাম তার শেষ কোথায়। সেই পথচলা এখনো চলছি। হয়তো আর কোনো দিনও ফিরে যাওয়া হবে না। ফিরে যাওয়া হবে না সেই রূপসা নদীর পাড়ে, মোল্লা বাড়ীর স-মিলে বা নতুন বাজারের সেই মাছের ঘরে। চা-সিগারেট আর পানের সেই  জমিয়ে আড্ডায় আর কখনো বসা হবে না। বসা হবে না পানির কোল ঘেঁসে সেই সুন্দরী কাঠের গুড়ির উপর, সন্ধ্যা বেলা কেউ হয়তো আর অপেক্ষা করবে না “মালাই বাবু”র জন্য। আজও সেখানে রূপসা নদীর পাড়ে আগের মতই সন্ধ্যা নামে, কিন্তু আমাদের সেই আড্ডাটা আর আগের মতন নেই। সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছি অনেক চেনামুখ।

সেদিন এটা বুঝতে পারিনি এই সব কিছুই একদিন হারিয়ে যাবে। বিমানটি আকাশে ডানা মেলার সাথে সাথে ডানা মেলেছিলো আমার স্বপ্ন। সেই পাঁচ ঘন্টার বিমান যাত্রায় কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার স্বপ্নরাজ্যে তা মনে পড়লে আজো নিজের অজান্তে হাসি। সেই স্বপ্ন ভাঙলো বিমানবালার আগমনী বার্তায় – “আমরা অল্পক্ষনে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছাবো।”

পা রাখলাম দুবাই এর মাটিতে। শুরু হলো জীবনের আরো একটি অধ্যায়ের। ভেবেছিলাম ৩/৪ বছর কাজ করে বেশকিছউ পেট্রোডলার কামিয়ে দেশে ফিরে যাবো, থাকবো নিজের দেশে। সেই চেনা মুখ, সেই মাটি আর সেইসব মানুষের মাঝে। যাদের সাথে গড়ে উঠেছিলো হৃদয়ের বন্ধন। কিন্তু সবকিছুই স্বপ্ন রয়ে গেল। নিজেকে আজ ভিক্টর হুগোর “লা মিজারেবল” মনে হয়।

শুরু হলো মরুভূমির বুকে পথচলা। পার হতে থাকলো সময়। সাফল্যও এলো।  কিন্তু তখনো বুঝতে পারিনি হারিয়ে যাচ্ছি মরুভূমির মাঝে, হারিয়ে ফেলছি ফিরে আসার পথের ঠিকানা। সময়ের সাথে চলতে চলতে একসময় এক থেকে দুই আর দুই থেকে চার হয়ে গেছি। তখন আর “আমি নেই” – “আমরা”। যখন ফিরে তাকিয়েছি ফিরে যাবার জন্য তখন বুঝতে পারলাম, অনেক দেরী হয়ে গেছে। পিছনে ফেলে আসা পথের চিহ্ন কখন যেন বালির মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমার জন্য নয়, আমাদের জন্য এখন শুধুই সামনে চলতে হবে। তখনো বুঝিনি আমার আর ফিরে যাওয়া হবে না সেই হারানো দিনগুলিতে। শুরু হলো “আমাদের” জন্য নতুন দেশের সন্ধান – নর্থ আমেরিকা।

যাযাবরের নতুন ঠিকানা, কানাডায় শুরু হলো আরেকটি অধ্যায়ের। মরুভুমীর লু-হাওয়া থেকে একেবারে হিমাংকের নীচে। পরিবর্তনটা যেন অনেকখানি। শুধু আবহাওয়াতে নয়, পরিবেশ ও পারিপার্শিকতায়ও। দাসত্ব থেকে স্বাধীনতা – মুক্তির আনন্দ আরো একবার। কিন্তু এবারেই প্রথম অনুভব করলাম যে, নিজের অজান্তেই নিজের শেঁকড়টা উপড়ে ফেলেছি।

“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” – এই জাতীয় সংগীতটা সবচাইতে বেশী ভালো লাগছিলো সেই দিন, যেদিন শপথ নিলাম কানাডিয়ান হিসাবে। যখন মুখে গাচ্ছিলাম “O Canada” তখন মনের গভীরে কোথায় যেনো বাজছিলো “আমার সোনার বাংলা”। বারে বারে মনে হচ্ছিলো এটুকুও হারিয়ে ফেললাম আজ। কেন এমন হলো? নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন রাখি, যার উত্তর আজো খুঁজে পাইনি।

সব চলার পথেরই একটা শেষ থাকে, কিন্তু একজন যাযাবরের পথের শেষ কোথায়?

জীবনানন্দ দাসের ভাষায়ঃ
“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”

কিন্তু এই নর্থ আমেরিকায় সমস্ত দিনের শেষে ক্লান্ত বনলতা সেনের কাছের যেন মুখোমুখি বসার মত সময়টুকুও নেই। সেও যেন আজ ফকির আলমগীরের সখিনা।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন