দেড় বছরের প্রবাস জীবনে এতটা করুণ চিত্র আমার চোখে পড়েনি। মনে হচ্ছে এদের সাথে পরিচয় না হলেই ভালো হতো, অন্তত কিছু হতাশা আর কিছু মন-যাতনা থেকে মুক্ত থাকতাম।এই প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের সাথে কথা বলে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করছিলাম। আপনজনদের দেশে রেখে তারা একা একা শ্রমিক হিসাবে প্রবাসে অমানবিক কর্মঘন্টা, নিরানন্দ জীবন , সত্যিই বড় কষ্টের ।

দুবাইয়ে “ডে টু ডে” নামে বহুজাতিক কোম্পানির সুপার মার্কেটের একটি ব্রাঞ্চে ৩২ জন বাংলাদেশী সেলসম্যান হিসাবে চাকরি করেন। সকাল ৯ টা থেকে রাত ১২ টা প্রতিদিন ১৫ ঘন্টা করে ডিউটি (লাঞ্চ টাইমে ২ ঘন্টার বিরতি) । সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নাই। ওভার টাইম নাই (তাদের বলা হয়েছে চাকরি ছেড়ে দেয়ার সময় তাদের একবারে ওভার টাইম দেয়া হবে) । প্রতিদিন ১৫ ঘন্টা ডিউটি করে কোনো মানুষের পক্ষে শারীরিক বা মানসিক কোনভাবেই সুস্থ থাকা সম্ভব নয়।সুন্দর বিকেল কিংবা চাদনী রাতে আড্ডা কোনটাই উপভোগ করা হয় না। তারা যেন কৃত্রিম শৃঙ্খলায় বন্ধী। আমরা যারা দুবাই এর মতো সভ্য (সভ্য বলছি কারণ এখানে সবাই নিয়ম মেনে চলে বা মানতে বাধ্য হয়) সমাজে বাস করি তাদের কাছে এটা অকল্পনীয়। একই কোম্পানিতে অনেক ফিলিপিনো চাকরি করেন তারা সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশীদের ভিসা বন্ধের পাশাপাশি রিলিজ ট্রান্সফারও বন্ধ থাকায় সর্ব ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে । তাদের প্রাপ্য মিনিমাম অধিকার থেকেও বঞ্চিত। তারা যেন তাদের প্রাপ্য অধিকার টুকু চাইতেও ভয় পায়।দুবাইয়ের শ্রম আইন অনুযায়ী ,শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি ও রাষ্ট্রিয় ছুটি প্রদান করা,দৈনিক ৮ঘন্টা কর্মঘন্টা ও অতিরিক্ত সময় এবং যে কোন ছুটির দিনে কাজ করলে ওভার টাইম দিতে বাধ্য থাকিবে। দিনে সর্বোচ্চ ২ ঘন্টার ওভার টাইম করতে পারবে।

UAE Labour Law

Article 65: The maximum number of ordinary working hours for adult workers shall be eight hours per day, or forty eight hours per week.
Article 67: The ordinary working hours, the additional period shall be deemed an overtime
Article 69: Effective overtime working hours may not exceed two hours per day
Article 70: Friday shall be the ordinary weekly rest for all workers

আমি ঘুরে ঘুরে কেনা কাটা করছি আর তাদের সাথে গল্প করছি। আমি অবাক হয়ে তাদের কথা শুনছি। তারা প্রতেকেই চার পাচটা ভাষায় কথা বলতে পারে(বাংলা ,হিন্দি, উর্দু , ইংলিশ এবং আরবী)।দেড় বছরে একটা আরবী ওয়ার্ড ও বলতে শিখি নাই আর তারা কাস্টমারের সাথে আরবিতে কথা বলে যাচ্ছে অনগর্ল। তাদের অসাধারণ প্রতিভা না দেখলে বিশ্বাসই করা যেতো না। এজন্য তাদের বেশ সুনাম ও আছে। আগে আরো বেশি বাংলাদেশী ছিলেন , অনেকে একটানা দাড়িয়ে ডিউটি করতে করতে অসুস্থ হয়ে দেশে চলে গেছেন। পরিবারের কথা উঠতেই কেমন যেন কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা কিন্তু অবাধ্য চোখগুলো সিক্ত করে তুলছে।

বাংলাদেশের রিজার্ভ ফান্ড ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, পার ক্যাপিটা ইনকাম ১৩০০ ডলার এর বেশি। যার বড় অবদান এই প্রবাসী শ্রমজীবি ভাই বোনেরা। যাদের ইনকামের ৮০% ই দেশে পাঠান। আশা রাখি আমাদের সব প্রবাসী শ্রমজীবি ভাইদের কষ্ট জড়ানো ঘামের মূল্যায়ন পাবে এবং সাম্য স্বাধীনতা, ন্যায্যতা, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে একটি মানবিক সুন্দর বাংলাদেশ। প্রত্যাশা করি সেদিন আর কারো প্রবাসী হয়ে অমানুষিক শ্রম দিতে হবে না।

অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ: লালন ফকিরের ভাষায়
“আপন ঘরে বোঝাই সোনা,
পরে করে লেনা দেনা”_ —-লালন ফকির

 

2 মন্তব্য

  1. প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটি কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
    আগামীতে এই রকম আরো কাহিনী জানতে চাই।
    আপনার এই লেখা বিদেশ গমনিচ্ছুক আনেক বাংলাদেশীর আনেক প্রশ্নের জবাব দিবে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন