জানা অজানা মনের কিছু কথা

তিথির_নীল_কষ্ট

ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশের মাঝে থোকায় থোকায় তুলোর মত ভেসে থাকা মেঘমালা তিথির খুব পছন্দের। আজ সকাল থেকেই আকাশের এই রূপ তিথিকে দারুণ ফুরফুরে করে তুলছিল। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে, মেয়েকে সকালের খাবার খাইয়ে, নিজের জন্য এক কাপ চা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারটায় একটু গা এলিয়ে বসে ও। সকালের এই সময়টুকু একান্তই ওর।

তিথির এই ব্যালকনি থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়, ঠিক যতদূর চোখ যায়। উঁচু দালানে থাকার এই এক সুবিধা, চাইলেই অনেক দূরে, অনেক উপরে আর অনেক নিচের সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করা যায়! তিথির কাছে মনে হয়, এই শহরের যে পাশ টায় ওর বাস, সেটাই সবচেয়ে সুন্দর। একদম চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর। তাই চোখ আর মনের শান্তির জন্য এই ব্যালকনি এখন ওর সবচেয়ে প্রিয়।

স্বামী-সন্তান নিয়ে প্রায় চার বছর হতে চলল, তিথি প্রবাসী হয়েছে। নিজের দেশ, মা-বাবা, ভাই-বোন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ছেড়ে এই দূর পরবাসে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করা খুব সহজ ছিল না তিথির জন্য! সেই বিভীষিকাময় শুরুর সময়টা ভাবলে, এখনো কেমন অস্থির লাগে ওর! রনিত শুধু ছেলেমানুষি বলে হেসেই উড়িয়ে দিত! তখন নিজের উপর খুব রাগ হলেও, এখন তিথি বোঝে ঐ সময় টাতে ওর যা হতো, তার সবই ছিল মানসিক অস্থিরতা থেকে সৃষ্ট আচরণের কিছু বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

ছয় বছরের সংসার, দুইজনের চাকরি, প্রাপ্ত সাহায্য -সুবিধা, আরাম-আয়েশ সবকিছু ছেড়ে, ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ের হাত ধরে আর নয়টি লাগেজ ব্যাগ সম্বল করে এই অজানা দেশের পথে পা বাড়িয়েছিল ওরা। বিদেশের জীবন যাপন নিয়ে তেমন কোন স্পষ্ট ধারণাও ছিল না। বাচ্চা দুইটার সুন্দর ও নিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর সামাজিক নিরাপত্তা ভাবনা জুড়ে ছিল ইতিবাচক আশা।

নতুন করে আবারও শুরু করাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়! জীবনের তাগিদে রনিতও ব্যস্ত হয়ে গেল চাকরি খোঁজা আর অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে। দুইটা বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব ও পুরো সংসারের সব কাজ নিয়ে একেবারেই খেই হারিয়ে ফেলত তিথি। সকাল থেকে রাত এক নিমিষে শেষ হয়ে যেত যেন! কাজের অনভ্যস্ততা আর অক্ষমতায় নিজের ভিতর কুঁকড়ে যেতে থাকল।

সারাক্ষণ বাসার ভিতর থাকতে একটুও ভাল লাগত না তিথির! বাইরে বলতে, ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া! বৈরী আবহাওয়া( যেমন ঠাণ্ডা, তেমন তুষারপাত), সাথে সবসময়ের জন্য ছোট বাচ্চা, সবকিছু ঠিকঠাক না চেনা এগুলোই ছিল মূল কারণ। তার উপর ছিল ইংরেজীতে কথা বলা আর বোঝার দ্বন্দ্ব! নিজেকে এত বেমানান মনে হত, যে লজ্জাও লাগত নিজের কাছেই!

কারও সাথে কথা বলার জন্য তিথির মন খুব চাইত! রনিতের তো সময়ই ছিল না ওর জন্য! দেশেও কাউকে খুলে সব বলতে পারছিল না, আর বলেই বা কি লাভ হত! খুব কাছের এক বান্ধবীর সাথেই যা একটুআধটু কথা বলত, সামনাসামনি কথা বলা আর ফোনে কথা বলা কি এক হয়! কাছাকাছি বা আশেপাশে নিজেদের কমিউনিটির লোকজন ছিল না যে তা নয়, কিন্তু পরিচিতিই গড়ে ওঠে নি তখনও! তাছাড়া কে কেমন হবে! কে কি ভাববে, এই সব শংকা তো ছিলই! তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছে সবসময়।

ফেলে আসা দিনগুলি খুব বেশী মনে হত সে সময় তিথির। চাকরি, নিজের স্বাধীনতা সবকিছু ভেতর টা মুচড়ে দিত ওর। কি ছিল, আর আজ তার কি হয়েছে এই ভেবে দিশেহারা হয়ে যেত ও। প্রবাসে এসে নিজেকে এতটাই অযোগ্য মনে হত, যে কারনে সবসময় কুঁকড়ে থাকত।

ছোট খাট বিষয় নিয়ে রনিতের সাথে ঝগড়া যেন হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিত্যদিনের ব্যাপার! তিথির মনে হত, রনিত ওকে একটুও বুঝতে চাইছে না! আসলে, রনিতও যে একটা অস্থির সময় পার করছিল, তা যেন বুঝেও বুঝত না তিথি। সবসময় মেজাজ তাই খিটখিটে হয়ে থাকত দুজনেরই। প্রায়শই বাচ্চদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার আর বকাবকিও করত ও। ওদের ভয় পাওয়া মুখ আর অসহায়ত্ব তিথিকে আরও দিশেহারা করে দিত।

জীবনের প্রতি মায়া দিন দিন কমে আসছিল! মরে যেতে ইচ্ছে হত প্রায়ই! দেশে ফিরে যাওয়ার আকুলতা আর কান্নাকাটি ছিল দৈনিক। এমনি এক অস্থির সময়ে, রনিতের উপর রাগ করে একাই দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তিথি। খুব নাজুক একটা সময় যাচ্ছিল যেন! এমনি একদিন সেই বান্ধবীর সাথে কথা বলতে নিয়ে মনের সবকিছু খুলে বলে তিথি। এতদিনের না বলা জমানো কষ্টগুলো, দুঃখ-হতাশাগুলো, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাগুলো নিমিষেই যেন ভাগ হয়ে গেল!

সেইদিন প্রিয় সেই বান্ধবী যেন দেবদূতের মত হাজির হয়েছিল তিথির জীবনে। তিথি ভুলেই গিয়েছিল যে ওর বান্ধবী দীর্ঘদিন ধরে মনো সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করছিল, সে পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী। বান্ধবীর সহায়তায়, তিথি এই প্রবাসেও কিছু বন্ধু সুলভ ভাল মনের মানুষের খোঁজ পেল, যারা যেকোনো মনো সামাজিক সমস্যায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

তিথি প্রতিদিন অল্প অল্প করে কথা বলতে শুরু করল ওর বান্ধবীর সাথে। সে ওকে বুঝাতে সক্ষম হলো ওর সমস্যার শুরুটা কি বা কেন বা কোথা থেকে হয়েছিল! হঠাৎ করেই জীবনের এহেন পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরেই তিথির মধ্যে এসব আচরণ দেখা দিচ্ছিল। অতিরিক্ত স্ট্রেস, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, হতাশা ওকে হারিয়ে দিচ্ছিল দিনেদিনে।

প্রথম বছর টাই তিথির জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন। এরপর প্রিয় বান্ধবীর সহযোগিতা আর নিজের প্রচেষ্টায় তিথি নিজেকে অনেক পালটে ফেলেছে। আগের মত আর ঘাবড়ে যায় না এখন। অনেকের সাথে জানাশোনা হয়েছে, নতুন অনেক বান্ধবীও বানিয়েছে, যাদের সাথে গল্প করতে পারে। বাইরে যাওয়া, বাজার করা, বাচ্চার স্কুল কোথাও আর সমস্যা হয় না কথা বলতে। সব কাজ এক হাতে করেও, অনেক সময় থেকে যায় হাতে। যার মধ্যে কিছুটা সময় ওর একান্তই নিজের।

এখন সবকিছুর মধ্যেই পজিটিভিটি দেখতে পায় তিথি। তিথিও নতুন জীবন শুরু করতে যাবে, খুব তাড়াতাড়ি! ও নিজকে কথা দিয়েছে, ভেংগে পরার আগে চেষ্টা করে যাবে প্রতিনিয়ত নিজেকে দাঁড় করাতে। যেকোনো মানসিক প্রয়োজনে, সাহায্য নিবে আর অন্যদেরও সহযোগিতা করবে। আর রনিত! আছে আগের মতই ব্যস্ত! জীবন যুদ্ধ নিয়ে! তবে অবসরে সময় বের করে তিথি আর বাচ্চাদের জন্য, পালটে নিচ্ছে নিজেকে।

******তিথির মত এমন সমস্যা, প্রবাস জীবনে এসে অনেকেই বোধ করে। কেউ সামলে নেয়, কেউ বা নিতে পারে না! কেউ বলতে পারে, কেউ বা পারে না। সময় থাকতে সাহায্য নেয়া আসলে একান্ত প্রয়োজন। অনেকে হয়তো সাহায্য না নিয়েই, সময় টা পার করে দিয়েছেন, চালিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে আর জীবনের চাকাকে! কিন্তু, মনের কোন এক কোণে চাপা কষ্ট টাকে হয়ত বয়ে নিয়েই চলেছেন, এখনও!

সোমাদত্ত

2 মন্তব্য

  1. Thanks Ms. Soma for your therapeutic story. We all by default have coping mechanism while dealing with a problem, but there are times when that coping capacity fails we might be in crisis and that is when you must seek support. I am glad that Tithi’s friend showed up in time.
    It’s always easier and interesting when information come through a story. You have literary knack in your writing. keep writing.

  2. আমার আশা আর প্রত্যাশা গুলো ঠিক এমনি। যেকোন ভাবেই কিছু একটা করার! যদি তা হয় লেখা দিয়ে, তবে তাই। আমি বিশ্বাস করি, সচেতনতাই হতে পারে প্রতিকারের প্রথম ও প্রধান ধাপ। তাই এই চেষ্টা।
    আপনার মূল্যবান মন্তব্য, আমার পাথেয় হয়ে থাকবে সবসময়। ধন্যবাদ।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন