কানাডাতে আসার প্রথম দিকে পড়াশুনা কি করবো, ভালো চাকরি-বাকরি কিভাবে পাবো ইত্যাদি নিয়ে যখন ব্যস্ত, তখন সাথে করে আনা টাকাও শেষ হতে চলেছে, এবং ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে আসা তাই দ্রুত সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের টাকাও পাওয়া যাবে না। সেই জন্য খুঁজতে থাকলাম তথাকথিত odd জব, যাকে আমি বলি জীবন রক্ষাকারী জব। কারণ ওই মুহূর্তে ওটাই জীবনে রক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
আমেরিকায় অবস্থানরত এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি রেস্টুরেন্ট জবের রেসুমে বানিয়ে, স্যান্ডউইচ বানিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রতিদিন বেরিয়ে পড়ি কাজের সন্ধানে। তো একদিন হারবার ফ্রন্ট এলাকায় কোকোবেরি ক্যাফে নামক এক ক্যাফেতে কাউন্টার সার্ভিসে একটি চাকরি হলো। actually নাম কাউন্টার সার্ভিস হলেও বাসন মাজা, ক্যাশ সামলানো, ঘর ঝাড়ি দেওয়া থেকে শুরু করে ফুড প্রেপ পর্যন্ত সব কাজই করতে হতো। প্রথম দিন আমার ট্রেইনারের সাথে কাজ ভালোই হলো। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলো দ্বিতীয় দিনে। তখন আমি একা এবং মালিক (ইরানি )। উনি আমাকে বললেন তুমি ডিম্ ভাজতে পারো। আমি বললাম পারি। তারপর বললেন ডিম্ ফ্লিপ করতে পারো। আমি খুব একটা বুঝতে পারি নি, তারপরেও বললাম হা পারি। মনে মনে ভাবলাম ডিম্ ভাজার আর কত কৌশল থাকতে পারে। উনি তখন একটা ডিম্ চামচ বা স্প্যাটুলা ব্যবহার না করে ফ্লিপ করলেন (উল্টে দিলেন) . আমি দেখে উনার মতো করে আল্লার নাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে দিলাম তাওয়ায় ঝাঁকি। ঝড়ে কলা গাছ পড়ার মতো ঠিকমতোই হলো।
এবার উনি তাওয়ায় দুইটি ডিম্ নিয়ে বললেন “double it” মানে দুইটা একসাথে ফ্লিপ করো। মরজ্বালা, একটা তো আন্দাজে করেছি কিন্তু দুটো কিভাবে করবো। উনি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন। চোখ কান বন্ধ করে এবারও তাওয়ায় মারলাম ঝাঁকি। এবার কিন্তু কলাগাছ আর পড়লো না। একটা ডিম্ ঠিকই ফ্লিপ হলো, কিন্তু দ্বিতীয়টি গিয়ে পড়লো ভদ্রলোকের প্যান্টের উপরে। আমি অপরাধীর মত সরি বললাম। উনি আমাকে মুখ দিয়ে বকা দিলেন না কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখে ঠিকই বোঝা গেলো উনি কি পরিমান রেগে গেছেন। মুখ দিয়ে শুধু বললেন, “Common man, this not a pan, it’s my pant !” বলেই চলে গেলেন পিছনে প্যান্ট ধুতে। আমি পারলে দৌড়ে পালাই, কিন্তু সমানে কেউ ছিল না, তাই আর সেটা হলো না। আমি পরবর্তী ২ ঘন্টা শেষ করলাম, তারপর যখন ব্রেকে যাবো তখন উনি আমাকে $১০ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাই দিলেন। শেষ হয়ে গেলো আমার একদিনের চাকরি জীবন।
কাজটি একটি সারভাইভাল জব তারপরেও মনে কেন যেন চাকরি হারানোর ব্যথা অনুভব করলাম। আর ওই সময়টাতে odd জব এখনকার মতো এতো available ছিল না। চাকরি হারানোর ব্যথার সাথে সাথে ব্যর্থতার গ্লানিও মনে কাটা দিচ্ছিলো, আর মনে হচ্ছিলো “হায়রে ডিম্, জীবনে ওমলেট আর পোজ ছাড়া, sunnyside up, over easy, scrumbble এসব কিছুই শুনিনি। তারপরে আবার ফ্লিপ, আর সেই ফ্লিপেই আমার চাকরি খেলো। তখন তেমন কাউকে চিনি না তাই একা একাই কষ্ট ভোগ করলাম। এর আগে জীবনে অনেক ব্যর্থতা এসেছে কিন্তু এই রকম humiliated আগে কখনো ফিল হয়নি। যাহোক, পরে যখন এই ডিম্ ভাজার সময় ফ্লিপ করাটা শিখলাম, তখন একেবারে বিশ্ব জয়ের আনন্দ পেলাম। যাহোক এই জাতীয় চাকরি থেকে ফায়ার হওয়ার ইতিহাস আরো আছে, তবে এই সমস্ত ফায়ারের পজেটিভ দিক ছিল। সেটা হলো যখনই ফায়ার হতাম তখনই একটি প্রফেশনাল চাকরি পাওয়ার জন্য বেশি বেশি motivate হতাম, এবং অবশেষে আল্লাহর রহমতে সেটা হলে। তবে এখন পর্যন্ত প্রফেশনাল চাকরি থেকে ফায়ার হয়নি, যদিও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছি। তবে ওই মালিকের প্যান্টের উপর কাঁচা ডিম্ ফেলার humiliating moment এর কথা এখনো ভুলিনি।
গল্পটি অনেক জায়গায় করেছি, কিন্তু কখনো লিখিনি। নতুন নতুন এরকম অনেক রূঢ় অভিজ্ঞতাই হয়। এসব অভিজ্ঞতা ছাড়া শুরুতে আরো অনেক স্ট্রাগগল ছিলো, তবে একটা জিনিস ভালো ছিল, সেটি হলো মনের কোনো এক কোণে ক্ষীণ একটি আশা সবসময়েই ছিল, যে না একদিন জায়গামতো পৌছাবো, এবং আল্লাহতালা ও বাবা-মার দোয়ায় সেটা হয়েছে, তাই আপনাদের সবাইকে বলি নিজের উপর থেকে faith কখনো হারাবেন না এবং আপনার আশাকে উজ্জীবিত রাখুন। আল্লাহ আপনার লক্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করবেন।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন