ফ্লোরিডা থেকে:-

ভোর হয়েছে ,একটি নাছোরবান্দা কোকিল কন্ঠ উজার করে সেই কখন থেকে ডাকছে তো ডাকছেই , কাক পক্ষী গুলো বেকারত্বের একঘেয়েমি কাটাতে কি ই না ঐকতানে করছে ডাকাডাকি।

দূরে ভো করে কোন বাসের হর্ন বাজলো। এতটা জোড়ে না বাজলেও পারতো । আমি বেইলী রোডের ময়েনের ৬ তলায় ছোট কাকা চাচী দীপু পুতুলের ও আমাদের শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত বাসাটিতে শুয়ে আছি । এই যে প্রানের স্পন্দনে ভরা দেশটি তার নাম বাংলাদেশ, আমি আজ সেই দেশ ছেড়ে চলে যাবো আবার। তাই তো আমাকে ঘুম থেকে জাগানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে বিশ্ব চরাচর। আমি না হলে এই পৃথিবী একটি কণায় অপূর্ণ থেকে যেত। একটি কণা – এক সমুদ্র অনুভূতি।

উঠলাম , তারপর বড়দা ময়েনকে নিয়ে সকালটা বাইরে হাঁটলাম , আজ রমনা পার্কে যাইনি অশোক অর্জুন মেহগনি দেবদারু গাছগুলোকে ” দাস্ বিদানিয়া” বলতে , কাল বিদায় নিয়ে এসেছি , জীবনের এই প্রথম কান্চন ফুল গুলো দেখে হয়েছি বিস্মিত ও মুগ্ধ । কিন্তু আজ আমি ওদের মুখে চেয়ে বুকের কষ্ট বাড়াতে চাইনি।

তাই কথা বললাম, হাঁটলাম ছবি তুললাম অফিসার্স ক্লাবে, ফুল সেখানেও ছিল। ফুল ছাড়া কি বসন্ত হয়?
হাঁটা হাঁটি শেষে মালিবাগ থেকে নাস্তা কিনে ঘরে ফিরলাম। নাস্তা শেষে একান্তে কিছু বৈষয়িক সাংসারিক জটিলতা নিয়ে কথা বললাম বড়দা বড়বৌর সাথে। পশ্চিমে হেলেছে জীবন যাদের তাদের চাওয়া পাওয়া যন্ত্রনা গুলো সীমাহীন , প্রায়শই সমাধান হীন।

পরে জামাল আসরাফ বুলবুল এল নারায়নগন্জ থেকে কিছুটা সময় কাটাতে একসাথে। না এলেও পারত কিন্তু কখনও আত্মার টান আমাদের দিয়ে কিছু কিছু কাজ করিয়ে নেয় যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না। বন্ধুত্ব কখনও কখনও অযৌক্তিক আবেগকে প্রশ্রয় দেই বলেই আমরা পৃথিবীর মানুষেরা বন্ধুত্বকে লালন করি আমাদের হৃদয়ের কোমলতম কক্ষগুলোতে ।

বেইলী রোডের “নবাবী খাবার” রেস্টুরেন্টে বসলাম, যদিও নবাবত্ব অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই, নবাবী খাওয়া খেয়ে কোলেস্টেরলের চাষবাস করতে আপত্তি কি?

কিছুক্ষন পরে বদরুল ভাই এলেন তার কিছু আবৃত্তির সিডি নিয়ে । অনবদ্য শিশুর মত এই মানুষটি আমার কৈশোরের সুহৃদ মামুনের বড় ভাই, কদিন কাটিয়েছি তার সাথে , আমার কিছু প্রেমের কবিতার চমৎকার আবৃত্তি করেছেন। একটি সিডি করবেন।
একসাথে ছবি তুললাম, তারপর বদরুল ভাই চলে গেলেন।

আমরা ঘন্টা খানেক আড্ডা দিলাম তুমুল, হাসা হাসি , জোক চলল আপন প্রবাহে, তারপর যখন বের হলাম হঠাৎ করে রৌদ্র ঝলমলে দিন কোথায় উবে গিয়ে এক কালবোশেখী ঝড়ের কালিমায় ঢেকে দিল পৃথিবীর মুখ, ধূলা উড়তে লাগলো অসামান্যতায়, শুরু হলো ধূলি ধুসরিত নাকের শ্লেষ্মা সুড়সুড়ি দেয়া হাওয়ার নাচন, তারপর বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি। শিলার আঘাতে জর্জিরত ক্রন্দসী পৃথিবী তুলল এমনি এক বেদনার গোঙরানী যে গাছে গাছে পাতাগুলো, আমের গাছে মুকুলিত সোনালী বোলগুলো সমস্ত সৌন্দর্য , সমস্ত সুষ্মা ও ঘ্রান ছুড়ে ফেলে দিয়ে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়লো ঢাকা শহরের পাষান প্রস্তরীভূত মেঝেতে ।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সবুজ ঝরা পাতা, অকালমৃত আম্রকুসুম,বিচ্ছিন্ন ডাল পালা আর আসমান উৎক্ষিপ্ত সাদা গোলাকার স্ফটিক খন্ড গুলো একাকার করে দিল রাস্তা, সৃষ্টি হলো বৃষ্টি জলের স্রোত । আমরা দৌড়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার বিদায়ের দিনে প্রকৃতির বিদ্রোহের তান্ডব।

এখন সেই কৈশোর নেই যখন বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হতে বাঁধা ছিলোনা, নেই সেই খালি বা প্রায় খালি পা যা ভিজিয়ে নেয়া যেত নির্দ্ধিধায় । এখন সভ্যতা হাড়ে হাড়ে হাসাহাসি করে , আর সভ্যতার একটি বড় লক্ষনই হলো “অংশগ্রহন নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা”। আমি সচেতনে সভ্য রইলাম।

যেখানে হেঁটে আসা যেত ১০ মিনিটে , বন্ধুরা বলল “পা ভিজে নোংরা হবে বরং গাড়ীতে করে নামিয়ে দিই”, চড়ে বসলাম। যেহেতু ভুল আমাদের পায়ে পায়ে চলে অবয়ব হীন শৃংখলের মত, আমরা কত সহজেই সেই ভুলের কাছে ধরা দিই । ভুলের আজদাহা আমাদের স্বপ্নচূড় উপত্যকায় মরিচী মায়ার পিছু ছোটায় মোজেসের মত।

আমার অতি প্রিয়জনেরা বসে ছিল ভীড় করে , আর আমি রইলাম অচল ট্রাফিক জ্যামে বসে। ১ ঘন্টার ও বেশী সময় কাটিয়ে ময়েনের বাসার কাছে পৌঁছলাম। দেখলাম শুভ আনন্দ দাঁড়িয়ে । আমার ভালোবাসার দুইটি অবয়ব , দুই ভ্রাতুষ্পুত্র শুভ ও আনন্দ । গাছের পাতা পড়ে রাস্তা ঘাট সয়লাব, বৃষ্টি ভেজা বাতাসে পরিচ্ছন্নতার পরশ, কচি হাল্কা সবুজ পাতার বিশাল জাম গাছটি আমাকে মনে করিয়ে দিল তার শৈশবের কথা , সেই সাথে শুভ ও আনন্দের কথা যাদের আমি রেখে গিয়েছিলাম দুই স্তবক পুষ্পের মত। ওরা এখন বড় হয়েছে,হয়েছে সন্ততির জনক, অথচ সেই অপত্য স্নেহ যা আমি অনুভব করতাম বহুদিন আগে , অনুভব করলাম আজও, আমি আমার ঈশ্বরকে অনুরোধ করলাম : ঈশ্বর তুমি আমাদের এই সন্ততি গুলোকে সামর্থ্য দিও জয় করার জড়তা ও জড়া, মোহ ও লিপ্সা , দ্বেষ ও ঈর্ষা , যেন ওরা হয় এই জাম পাতা গুলোর মত সুন্দর , বর্নিল ও পরিচ্ছন্ন , যেন ওরা অতিক্রম করতে পারে আমাদের অল্পতা ও অগভীরতা গুলো , যেন ওরা দেবদারুর মত হয় দীর্ঘ ও ঋজু কিন্ত নমনীয় , যেন প্রয়োজনে হতে পারে নত কিন্তু অভঙ্গুর।

ওদের সংগে কথা বললাম কিছুক্ষন, তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম ৬ তলায়, কথা হল ভাই বোন ও উত্তর পুরুষদের সাথে, লান্চ করলাম একসাথে , তারপর ধীরে ধীরে তৈরী হলাম পৃথিবীর পথে বেড়িয়ে পড়ার জন্য।

টের পেলাম বয়েস হয়েছে, সংসারের মায়া হাজারো লক্ষ লতায় পাতায় বেঁধে ফেলেছে সত্তার প্রতিটি কণা, প্রতিটি রন্ধ্র, এই চলে যাওয়া এখন আর নয় যৌবনের চলে যাবার মত অত সহজ। এখন আর অনুভূতি প্রকাশ করা যায়না শব্দমালায়, গলার কাছে আটকে যায় চেতনার প্রবাহ, নদীগুলো বাধ বেঁধে বেঁধে জলহীন করে দেয়া গেলেও চোখ গুলো ঠেকাতে পারেনা প্লাবন, ভিজে ভিজে ওঠে আষাঢ়ের ঢল বুকে নিয়ে।

শিহাব/ফেব্রুয়ারী ২৪,২০১৬ ঢাকা থেকে দুবাইয়ের পথে

 

১ মন্তব্য

  1. শাহাব ভাই,
    লেখাটি পড়লাম! ঠিক যেন মন খারাপ করা একটি বিকেলের অনুভূতি! শৈশব যৌবনের অজস্র স্মৃতির জালে আটকা পরে রইলাম। প্রিয় রমনা আর বেইলী রোড!!
    অনেক ধন্যবাদ। ভীষণ ভালো লাগলো।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন