সেন্ট মাইকেল হসপিটাল। টরোন্টোর বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবাপ্রদানকারী গুটিকয়েক হাসপাতালের একটি। এক ক্লায়েন্টকে নিয়ে বসে আছি সতেরো তালার ‘সাইকিয়াট্রিক আউটপেশেন্ট ইউনিট’ এর নার্সিং স্টেশনের সামনে । উদ্দেশ্য, একজন মনস্তত্ববিদের সাথে বিষন্নতায় ব্যবহৃত একটি ঔষদের পরিমান বিষয়ক আলোচনা । বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার এই ক্লায়েন্ট জটিল একটি সমস্যায় ভুগছে. ডাক্তার সাহেব যখন নিৰ্দিষ্ট ঐ  ঔষদের পরিমাণ  বাড়িয়ে দেন, আমার ক্লায়েন্ট তখন হাইপার একটিভ হয়ে যায়. তার কাছে নাকি মনে হয় সে বসে আছে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় । আবার যখন এর পরিমাণ কমিয়ে দেন তখন বেড়ে যায় তার বিষন্নতা । জগতের সব কিছু তার কাছে হয়ে উঠে অর্থহীন । এ থেকে মুক্তির উপায় কি। আলোচনা এই বিষয়কে ঘিরেই । যাহোক, রুগীর সার্বিক অবস্থা এবং অন্যান্য কিছু ঔষধের পার্শপ্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ শেষে মনস্তত্ত্ববিদ ঔষধের নুতন একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে চার সপ্তাহ পরে আবার সাক্ষাৎ করতে বললেন  সব আলোচনা শেষে উঠার আগ মুহূর্তে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন আমার আর কিছু জানার আছে কিনা । কোনো কিছু না ভেবেই জানতে চাইলাম যে একজন মানুষ যখন তার ব্যক্তিগত জীবনে অগ্রাধিকারের বিষয়টি বুঝতে পারে না, তখন সেই অবস্থাটিকে Priority Deficiency Syndrome বলা যায় কিনা । কিছুটা চমকিত হয়ে স্মীত হাস্যে ডাক্তার উত্তর দিলেন, “No, it is not the priority deficiency syndrome, it is a matter of realization. It is a realization of what matters most in your life”.

হাসপাতাল থেকে বাইরে এসে ক্লায়েন্টকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ভাবছিলাম নিজেকে নিয়ে. উপলব্ধীর এই বিষয়টি নিয়ে এভাবে কখনো ভাবিনি । সচরাচর কর্মব্যস্ত দিন শেষে বাসায় ফিরে আইপেড নিয়ে প্রথমেই খুঁজি গত সপ্তাহের ফেসবুকের লেখায় কয়টা লাইক পড়লো, একবারও ভাবিনা একই রকম ব্যস্ততায় স্ত্রী, সন্তানদের দিনটি কেমন কাটলো । খেয়াল করিনা টেলিভিশনে আমেরিকার নির্বাচন পরবর্তী নুতন রাজনৈতিক সার্কাসের খবরের চাইতেও বেশি দরকার নিকটস্থ বাংলাদেশি গ্রোসারি দোকান থেকে রান্নার জন্য পিয়াজের বস্তা নিয়ে আসা । অনুধাবনের বিষয়টি আসলে নিজের কাছেই. চারপাশে তাকালে অবশ্য আরো জটিল কিছু চোঁখে পড়ে। কাউকে দেখি রাতভর কষ্টকর একটি কাজের শেষে ভোররাতে এসে মাকে একটি ফোন না দিয়ে উনি ঘুমাতে পারেন না । জানি না কোন অগ্রাধিকারের বিবেচনায় কঠিন এই কাজটি তিনি আনন্দচিত্তে করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস । তারপরও উনার আফসোস যে মায়ের জন্য তিনি কিছুই করতে পারছেন না । আবার কাউকে দেখি অর্থ উপার্জনের অগ্রাধিকারের ভিড়ে বাবা মাকে মাসে একবার ফোন করেও মহান দায়িত্ব সম্পন্ন করার সময় পান না । কেউ দুধ বেচে মদ খান, আবার কেউ মদ বেচে দুধ খান। কেউ সুরের মধ্যে স্রষ্টার অন্নেষণ করেন, আবার কেউ সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টাকে খুঁজে পান। জগতে সব কিছুতেই দেখি উপলব্ধীর খেলা। উপলব্ধীতে না আসলে কোনো বিষয়ই আসলে বিষয় না।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন