(ফেইসবুক বন্ধুদের জন্য উৎসর্গ)

১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ আমি বাউচি, নাইজেরিয়া চাকুরী করেছি । ১৯৮৪ জুলাই কি অগাস্ট(সঠিক তারিখ মনে নেই ) ,  এক সপ্তাহান্তে পার্শবর্তী শহর Jose,Plateau state পরিবার নিয়ে গিয়েছি কিছু কেনাকাটা করতে। আমি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছি ।   কেনাকাটা শেষে বাসায় ফিরে আসার পথে  রাস্তায় গাড়ির সামনের চাকা  পাঞ্চার  হওয়ায় আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে  দুর্ঘটনায় পড়ি। গাড়ি অতিরিক্ত স্পীডে থাকায়  নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টিয়ে রাস্তা থেকে পাশে অনেক দূরে জমিতে গিয়ে থেমে  যায়। গাড়ির চাকা উপরে, আমার স্ত্রী ও ছোট্ট ছেলে নিচে গাড়িতে, বের হতে পারছে না।   আমি গাড়ি থেকে ছিটকিয়ে দূরে কি ভাবে পড়ে যাই বলতে পারছি না।  মাঠের লোকজন দৌড়ে এসে গাড়ি সরিয়ে ওদের বের করে, আমি এর কিছুই বলতে পারছি না।   আমি মাথায় আঘাত পেয়ে সাময়িক জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এবং স্ত্রী ও ছেলে  মাইনর ইনজুরি নিয়ে সবাই হাসপাতালে যাই।  ওদের প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর ছেড়ে দিলেও আমাকে রেখে দেয়া হয় কিছুদিনের জন্য। 

নাইজেরিয়ায় আমার সঠিক  ট্রিটমেন্ট না হওয়াতে ইংল্যান্ড  ট্রিটমেন্ট হয় ; সে ও এক অলৌকিক, আমরা ছুটিতে দেশের বাড়ি যাবো,পথে প্লেনে ভালোই ছিলাম, লন্ডন যাওয়ার পর বেশিরকম অসুস্থ্য হয়ে পড়লে আমাদের এক আত্মীয় (আজ আর জীবিত নেই, আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন)  হাসপাতালে নিয়ে যান  ।  ট্রাইটমেন্টে ভালো হয়ে গেলে ও  দুর্ঘটনার পর থেকেই আমার শরীর ভালো যাচ্ছিলো না। 

 ১৯৮৫  চাকুরীর চুক্তি মেয়াদ শেষ হলে পরিবার বাংলাদেশ পাঠিয়ে আমি আমেরিকা নিজের ভাগ্যান্বেষণে  যাওয়ার উদ্যোগ নেই। দেশে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে নাইজেরিয়া গিয়েছিলাম এবং ফিরে এসে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে চাকুরী  খোঁজাখোঁজি করতে মন চায় নি। নাইজেরিয়া থেকে পুরা পরিবারের আমেরিকার  ভিসিট ভিসা নিয়েছিলাম।  কিন্তু বড়ো রকমের ঝুঁকি হয়ে যাওয়াতে আমি ওদের লন্ডন থেকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে একা চেষ্টা করি।     

আমি ১৯৮৬ সালের ১০ জানুয়ারী সকালে নাইজেরীয় এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ইংল্যান্ডের লন্ডন ত্যাগ করি এবং স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় নিউ ইয়র্কের JFK  বিমানবন্দরে পৌঁছাই। ইমিগ্রেশন আমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেবে কিনা তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমাকে আমার সফর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে। ইমিগ্রেশন আমাকে প্রমাণ দেখাতে বলে আমি পরিদর্শনের পরে চলে যাব। আমি বলেছি যে আমার কাছে নাইজেরিয়ার একটি নির্মাণ সংস্থা থেকে স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব রয়েছে এবং তাদের অফার এবং গ্রহণযোগ্যতার চিঠিটি দেখিয়েছি। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কত ডলার নিয়ে এসেছো ? 

আমি লন্ডনের বারক্লেজ ব্যাংক থেকে ৩০০ পাউন্ড উঠিয়ে এনেছি। আমাকে জিজ্ঞেস করে , ‘এই পাউনড আমেরিকা ভিজিটের জন্য  যথেষ্ট নয়। আমি তাকে বলেছি লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট যার নিউ ইয়র্কে শাখা রয়েছে, প্রয়োজনে ডলার উঠিয়ে নিতে পারবো। তারপর আমাকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত কাগজপত্র দেখাতে বলে।আমি কাগজপত্র বের করে দেখালাম ।   আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এটাতো ফ্যামিলি ভিসা;  “কেন তুমি তোমার পরিবার তোমার সাথে নিয়ে আসনি? আমি বললাম, আমার এক বছরের মেয়ে আছে যে অসুস্থ্য । তাই আমি তাদের লন্ডন থেকে বাংলাদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব লোকজন চলে গিয়েছে, আমি ভেবেই নিচ্ছি, আমাকে ফেরত পাঠাবে । আমার রিটার্ন টিকেট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো; ইমিগ্রেশন শেষ করতে আমার প্রায়  ৪৫ মিনিট সময় লেগেছিল এবং একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিলেন তারপর আমাকে অনুমতি  দেয় । 

আমি কাস্টম থেকে মালপত্র সংগ্রহ করেছি এবং বাহিরে এসে ভাবছি এই অচিন দেশে কোথায় গিয়ে উঠবো ? আমি লন্ডন থেকে আসার প্রাক্কালে এক অপরিচিতের ঠিকানা ও তার আত্মীয়ের চিঠি এনেছি, দেখি চেষ্টা করে। একটি ট্যাক্সি ডেকে চিঠির ঠিকানা দেখলাম, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি   ম্যানহাটনের একটি ইন্ডিয়ান  রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার ঠিকানা জানে কিনা?

সে বলে আমি এই রেস্টুরেন্ট চিনি এবং নিয়ে যেতে পারবো। আমি তার ট্যাক্সিতে লাগেজ লোড করেছি এবং সে গাড়ি চালানো শুরু করছে  । এটি আমার জন্য একটি নতুন দেশ এবং নতুন শহর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটাই আমার প্রথম ভ্রমণ, যদিও আমি ইতিপূর্বে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি।    আমার কাছে সবকিছু নতুন দেখাচ্ছে । উঁচু ভবনগুলি অতিক্রম করে, হাডসন বে, স্ট্যাচু অফ লিবার্টির পাশ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে  আর আমি অবাক হয়ে দেখছি  এবং ট্যাক্সি ড্রাইভার একটি রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। আমি ট্যাক্সি ভাড়া  পরিশোধ করে ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এসে, লাগেজ সংগ্রহ করে রেস্টুরেন্টের ভিতরে গিয়ে কাউকে চিনি না যার নাম, ঠিকানা আমি লন্ডনে থাকাকালীন সংগ্রহ করেছিলাম।

 লন্ডনে, মালিকের  কেমন পরিচিত আমাকে বলেছিলেন যে নিউ ইয়র্কে তার এক আত্মীয় রয়েছে এবং তিনি আমাকে তার ঠিকানা দিয়েছেন। কিন্তু এই লোক সেদিন রেস্টুরেন্টে ছিলেন না, তার ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য বাহিরে  গিয়েছিলেন। আমি অন্যদের জিজ্ঞেস করলাম, সে কখন ফিরবে?

 তারা আমাকে বলে সে পরের দিন ফিরে আসতে পারে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি , জিজ্ঞাসা করি, কাছাকাছি কোনও হোটেল চিনে  কিনা। তারা আমাকে কাছাকাছি একটি হোটেল দেখিয়েছে । আমি হোটেলে গিয়ে রাতের জন্য একটি রুম  রিজার্ভ  করি। 

আমি রুমে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে রাতের খাবার খেতে বের হলাম। কাছাকাছি ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেয়ে খাওয়া শেষ করে  বাইরে খানিক ঘোরাঘুরি  করে হোটেলে ফিরলাম।   শহরটিকে খুব ব্যস্ত এবং যে দিকেই তাকাই অবাক হয়ে উঁচু উঁচু ভবন দেখছি।   আমি হোটেলে গিয়ে কাউন্টার থেকে একটি সংবাদপত্র নিয়ে ওয়েটিং এরিয়াতে বিশ্রাম নিচ্ছি এবং আস্তে সোফায় ঘুমিয়ে পড়ি।  একটু পর রিসেপশনিস্ট  এসে বলে এই মিস্টার, তুমি  তো রুমে গিয়ে ও ঘুমাতে পারো ।  আমি চোখ খুলে বলি ঠিক আছে,  আস্তে এলিভেটরে উঠে নিজের রুমে গিয়ে  কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ি ।  হঠাৎ মনে হলো আমি বোধ হয় দরজা বন্ধ করিনি ।  উঠে চেক করে দরজা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।  সারাদিনে লম্বা জার্নির পর আমি কি পরিমান ঘুমিয়েছি বলতে পারি না ; পর দিন চোখ খুলে দেখি দিনের ৯টা  বাজে। এক ইন্ডিয়ান ছেলে   এসে বেড পাল্টিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে  চাই, আবার ভাবলাম অপরিচিত লোক,কী  জানি কী  বলে ; তাই কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।   

ঘুম থেকে উঠে  বাহিরে  রেস্টুরেন্টে প্রাতঃরাশের জন্য চলে যাই । মিডডেতে, আমাকে হোটেল ছেড়ে চলে যেতে হবে, কিন্তু আমি কোথায় যাব তা নিশ্চিত নই ।  আমি ওয়াল স্ট্রিট এবং কিছু জায়গায় হেঁটে দুপুর ১২:০০ টায় হোটেলে ফিরে এসেছি। এই শহরে সবকিছুই আমার কাছে নতুন।

 দুপুর ১টার মধ্যে আমি রেস্টুরেন্টে গিয়ে যাকে খোঁজ করছি ফিরে এসেছেন। ভদ্রলোক  ব্যস্ত রান্নাঘরে কাজ করছিল, তাত্ক্ষণিকভাবে আমার প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি । আমি বাইরে গিয়ে কয়েক মিনিট  এখানে সেখানে তাকালাম এবং তাকে আবার দেখার জন্য রেস্টুরেন্টে ফিরে এলাম। গেস্ট শেষ করে এসে আমাকে চিনতে পারছেন না, আপনি আমাকে খোঁজ করছেন? 

জ্বি , আমি তার লন্ডনে পরিচিত লোকের  কাছ থেকে যে চিঠি এনেছিলাম, তাকে দিলাম।  তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে  এবং তার পরিবার কেমন আছে ?   

আমি বলি, ‘তারা ভালো আছে । তিনি বললেন ভিতরে এসে বসেন, আমি কাস্টমার সার্ভ করতে যাই। তার কাজ শেষ করার পরে, তিনি আমাকে উপরের তলায় একটি রুমে নিয়ে যান এবং আমাকে বলেন, “আপনি আপনার কাপড় ছেড়ে আরাম করেন  এবং পরে নীচে আসুন। আমি পোশাক পরিবর্তন করে বিশ্রাম নিয়ে, নীচে এসেছি। তিনি আমার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে এলেন এবং আমার সামনে খানিক বসলেন।

 তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জার্নি কেমন ছিল?

আমি তাকে বলেছি, ‘আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তিনি বলেন, ‘৮ থেকে ৯ ঘণ্টা বিরতিহীন যাত্রা ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। গত রাতে আপনি কোথায় ঘুমিয়ে ছিলেন? 

 আমি কাছের হোটেলে ছিলাম। “কিছু গ্রাহক এসেছে এবং তিনি খাবার প্রস্তুত করার জন্য ছেড়ে চলে গেলেন । আমি খবরের কাগজের দিকে মনোযোগ দিলাম। তিনি আবার এসে আমাকে আমার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তাকে বলেছি যে আমার এক বছর বয়সী মেয়ে ভাল বোধ করে নি, ফলে আমি পরিবারকে আমার সাথে নিয়ে আসিনি। গ্রাহকরা আসছেন এবং তিনি আমাকে আবার সেবা করার জন্য ছেড়ে চলে গেছেন। লাঞ্চের পর, আমি উপরে বিশ্রামের জন্য  গিয়েছি।

যখন রেস্তোঁরাটি কম ব্যস্ত, তিনি আমার রুমে এসেছিলেন এবং জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমার কিছু দরকার কিনা। আমি বললাম, আপনি ব্যস্ত এবং আমার বিরক্ত করা উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘এটাই যুক্তরাষ্ট্রের জীবন, দেখতে পাচ্ছেন আমরা কতটা ব্যস্ত! এটা বাংলাদেশ নয়, দাপ্তরিক দায়িত্ব শেষ করার পরশুধু বাড়ি যাও এবং আরাম কর। এখানেআমি মালিক, আমি রাঁধুনি, খাবার প্রস্তুত করতে হবে, পরের দিনের জন্য জিনিস কিনতে হবে, বিল পরিশোধ করতে হবে, ইত্যাদি। তিনি আমাকে বললেন, “আপনার যদি কিছু প্রয়োজন হয় তবে নীচে আসুন এবং পানীয় বা অন্য কিছু খান।  ‘আমি নিচে এসে দেখি তিনি কি ভাবে কী করছেন। 

আমি দেখছি  এক বা দুই জন কাস্টমার  রাতের খাবারের জন্য বসে আছে।  তিনি বলেন, ‘কিছু মনে করবেন না, এটা একটা ব্যবসা। ব্যবসা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যস্ত থাকি আমি বললাম, ‘আপনি কোন সময়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করবেন?

 তিনি বলেন, “সাধারণত রাত ১২টা থেকে ১টা;, কিন্তু কখনও কখনও আমরা কাস্টমারের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত খোলা রাখি । তিনি বলেন, আমরা দিনের  ১২টার মধ্যে রেস্টুরেন্ট খুলে দেই। আমরা গ্রাহকদের জন্য দরজা খোলার আগে খাবার   প্রস্তুত করতে অন্তত ১ঘন্টা আগে আসি।  সালেহ  তার ছোট ভাই সেলিম এবং আরও একজন সাহায্যকারী ওয়েটিং রুমে অর্ডার নিয়ে খাওয়া পরিবেশন করে  এবং বিল সংগ্রহ করে। 

আমি তাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম, যে আমি এ দেশে থাকতে এসেছি।  তিনি বলেন  আমি চিঠি থেকে এবং আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি; থাকতে পারবেন, তবে এ দেশে জীবন কঠিন, পদে পদে বাধার সম্মুখীন হবেন। 

আমি তাকে তার পরিবার ও সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বলেন, ‘আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। দু’জনেই প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। কথা বলার সময়, তার স্ত্রী দুই সন্তান রেস্টুরেন্টে আসলে  সে পরিচয় করিয়ে দিলে  আমাকে সালাম জানায়, ওর ব্যাবসার অসুবিধা হবে ভেবে আমি  কিছুক্ষণ পর রুমে চলে এলাম।

পরের দিন সকালে আমি সতেজ বোধ করছিলাম কারণ রাতে আমি ভাল ঘুমিয়েছি। আমি বাহিরে হাঁটতে বের হৈ এবং প্রাতঃরাশ সেরে কিছু সময় ঘোরাঘুরি   করে রুমে ফিরে আসি।   আমি যখন খবরের কাগজ পড়ছি তখন ছেলেমেয়ে পুনরায় আমাকে দেখতে এসেছে । আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কেমন আছো ? আমি বললাম, আমি ভালো আছি, তোমরা   কেমন আছো? ভালো আছি। আমি আমার লাগেজ থেকে অ্যালবাম খুললাম এবং তাদের আমার বাচ্চাদের ছবি দেখালাম। ওরা খুশি হয়ে ছেলেমেয়েদের ছবি দেখে ফিরিয়ে দেয়।   

কথা প্রসঙ্গে আমি সালেহ সাহেবকে জিজ্ঞেস করি , ‘আপনি কতদিন বাংলাদেশ থেকে বাইরে আছেন ? 

সালেহ সাহেব বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বাইরে আছি ১০ বছর।  একবার দেশের বাড়িতে পরিবার নিয়ে, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের দেখতে গিয়েছিলাম। গত কয়েক বছর ধরে আমরা বাংলাদেশে যাওয়ার সময় পাইনি। কাজে ব্যাস্ত থাকি, বাড়ি যাওয়ার  সময় কোথায়? 

 আমি বললাম, ‘এটাই জীবন। তিনি বলেন সবকিছু একসাথে পাবেন না। এমন কিছু যা আপনি মিস করেন, যা আপনি পান তা হল জীবনের উপায়। তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করছি, বিল পরিশোধ করছি, পকেটে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।  ঋণ পরিশোধের পরে, আমরা কিছুই দেখতে পাই না এবং যদি আমরা ছুটির জন্য বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি তবে আমাদের ঋণ নিতে হবে এবং তারপরে কয়েক বছর ধরে ঋণ বহন করতে হবে। 

সালেহ এবং তার পরিবার রেস্টুরেন্টের নিকটেই এপার্টমেন্টে থাকে । আমি যে রুমে উঠেছি তা তাদের মালামাল রাখার জন্য  এবং একটি সিঙ্গেল বেড তাদের রেস্টের জন্য ব্যবহার  করা হয়ে থাকে। আমাকে আমার নিজের জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। সেদিন ছিল রবিবার। 

সালেহ তার সন্তানদের সাথে আমাকে কিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখানোর জন্য কিছু সময় তৈরি করেছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তিনি এমন কোনও জায়গা জানেন যেখানে আমি কিছু ব্যাচেলরদের সাথে থাকতে পারি। তিনি বলেন, ব্যাচেলর অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী কাউকে তিনি চেনেন না। 

আমার মনে আছে, আমার পরিচিত  এক ভদ্রলোকের টেলিফোন নম্বর লন্ডন থেকে নিয়েছি , যাকে আমি নাইজেরিয়া থেকে চিঠি লিখেছি এবং লন্ডন থেকে তার আত্মীয়ের কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর পেয়েছি। তিনি তার পরিবারের সাথে নিউইয়র্ক শহরে বসবাস করছেন। তার বাবার ঢাকার গোপীবাগে একটি টেলারিংয়ের দোকান রয়েছে, আমাকে তার ঠিকানা দিয়েছিলেন।  সন্ধ্যায় আমি তাঁকে ফোন করেছি । আমি আমার নাম বললাম, সে বুঝতে পারল না যে আমি এখানে এসেছি । 

জিজ্ঞেস করে, আপনি নিউইয়র্কে কখন এসেছেন? 

গত দুইদিন  আমি এসেছি, একদিন হোটেল ও  একদিন সাময়িকভাবে একটি পরিবারের সঙ্গে আছি । তিনি বললেন, “আমি কি জানতে পারি, কে সেই ব্যক্তি, যার সাথে আপনি আছেন? 

আমি মিঃ সালেহ-এর নাম বললাম, কিন্তু তিনি চিনতে পারলেন না। যখন আমি তার ব্যবসার ঠিকানা বলেছিলাম, তখন তিনি আমাকে অবিলম্বে তার বাসভবনে আসতে বলেছিলেন এবং নিউ ইয়র্কের এলমহার্স্টে তার ঠিকানা দিয়েছিলেন।

এই লোক লন্ডন থেকে একজন ব্যবসায়ী হিসাবে আমেরিকায় এসেছেন  এবং এখানে নিউ ইয়র্কে একটি ব্যবসা শুরু করছেন । তিনি   আমাকে তাঁর ঠিকানা দিয়ে অবিলম্বে যেতে বলেন, এতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সালেহ এর ছোট ভাই আমাকে নিয়ে আসে তার বাসায়।  

আমি নাইজেরিয়া থেকে ওকে লিখেছিলাম যে আমি নিউ ইয়র্কে আসতে পারি, কিন্তু আমি কখন আসতে পারি  উল্লেখ করিনি, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না যে আমি এত তাড়াতাড়ি আসতে পারি। তিনি তার স্ত্রী সন্তানদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। তার পরিবার, শাশুড়ি এবং অন্যান্যরা বাংলাদেশ থেকে আসায় তার ছোট্ট বাসায় তিলধারণের জায়গা ও ছিল না ; ডিনারের পরে, তিনি প্রতিবেশী এক মেসে টেলিফোন করে বলেন ,” আমার এক গেস্ট এসেছে, তোমাদের মেসে জায়গা দিতে হবে । ”   সাথে সাথে আমরা লাগেজ নিয়ে ওর এপার্টমেন্টে চলে আসি।  আমি থাকার আপাতত ব্যবস্থা হওয়াতে একটু স্বস্তি পেলাম।  

আমার মনে হয়েছিল আমি সমুদ্রে সাঁতার কেটে কেটে  ক্লান্ত হয়ে কেবলই মাটিতে পা রাখলাম।  চারজন যুবক ছেলে যাদের বয়স আমার চেয়ে ছোট; একজন গ্রীন কার্ড হোল্ডার,বাকি তিনজন ভিসিট ভিসা বা শিপ থেকে নেমে এক কামরা বাসায় কোনোরকমে মাথা গোঁজে থাকে।  একটি বেডরুম চারটি বেড লাগানো,নড়াচড়ার জায়গা ও নেই, লিভিং রুম, ছোট্ট রান্নার ব্যবস্থা এবং একটি ওয়াশ রুম, লিভিং রুমে সোফা ও কয়েকটা চেয়ার। দিনে একজন,  বাকিরা বিভিন্ন  শিফটের কাজ করে; কেউ দিনে কাজ করে, কেউ রাতে। কখনও কখনও যদি ডিউটি বন্ধ থাকে, সবাই বাসায়  থাকে এবং নড়াচড়ার ব্যবস্থা ও থাকে না। রাতে আমার ঘুমানোর কোনো জায়গা নেই, এই সোফা একমাত্র সম্বল, চেয়ার টেনে কোনো রকমে রাত শেষ করি।

গ্রোসারি দোকান থেকে একটা ম্যাপ সংগ্রহ করে রাস্তা ও সাবওয়ে সিস্টেম গুলি দেখে নিলাম।  টিকেট নিয়ে সাবওয়েতে ঢুকলে বিভিন্ন লাইন ঘুরে ঘুরে দেখি, বের হলে আবার টিকেট কিনতে হয়, সে জন্য ট্রেন থেকে বাহিরে বের হই না।   

একজন হোটেলে, একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং বাকি দুইজন রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। আনোয়ার    আমাদের চাঁদপুরের, পাশের গ্রামের, আগে কখন ও দেখিনি  । তিনি দিনের বেলায় একটি হোটেলে কাজ করেন এবং রাতে বাসায়  থাকেন। ময়মনসিংহের একজন  যিনি একজন ট্যাক্সি চালক,  সন্ধ্যা সাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত  ট্যাক্সি চালান।  মতিন বাংলাদেশের পাবনা জেলার একজন যুবক,  আমি ১৯৮১ সালে পাবনা পল্লী বিদ্যুত সমিতিতে কাজ করেছি, শুনে  বলে “বড়ো ভাই আপনি এ দেশে কি কাজ করবেন? “ এই দেশ আপনার জন্য না।  আব্দুল আলিমের গান তার  খুব পছন্দ, যতক্ষন বাসায় থাকে গান গেয়ে সময় পার করে।  বিয়ে করেছে কাগজ বানানোর জন্য। কালো বয়স্কা, সে মহিলার সঙ্গে থাকে না এবং পয়সা ও ঠিকমতো দেয় না, মহিলা ইম্মিগ্রাশনে ওর বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে, এ নিয়ে দুঃখ করে বলে, বড়ো ভাই, কত পয়সা খরচ করলাম এই মহিলার পিছনে, সে আমার বিরুদ্ধে  ইম্মিগ্রাশনে কমপ্লেইন  করেছে।      

 এই অল্প বয়সী ছেলেদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এরা বরাবরই আমাকে বলে  এ দেশে সব কাজ কঠিন ; আপনি এ দেশে কোনো কাজ করতে পারবেন না।  একদিকে আপনি কোনোদিন হার্ডওয়ার্ক করে অভ্যস্থ না, অপর দিকে আপনার যে শরীরের অবস্থা, চেষ্টা করলেও পারবেন না । আমি জিজ্ঞেস করি, আপনারা আমাকে কী করতে বলেন? 

সবাই বলে দেশে চলে যান,আপনি শিক্ষিত লোক,দেশে কাজ  করবেন, পরিবার নিয়ে ভালো থাকবেন; তাছাড়া নাইজেরিয়া ফেরত গেলে ও কাজ করতে পারবেন, পরিবার নিয়ে থাকবেন।  ।     এই দেশ আপনার জন্য নয়। আপনি একজন বয়স্ক ব্যক্তি এবং আপনার ক্ষেত্রে চাকরি পাবেন না। নাইজেরিয়া বা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়াই ভালো, যেখানে “আপনি আপনার ক্ষেত্রে চাকরি পাবেন।”

 আমি তো ভাই এখানে থেকে  চেষ্টা করার জন্য এসেছি । তারা বলে, “নাইজেরিয়াতে আপনার এক বছরের চাকরির চুক্তি রয়েছে এবং আপনি যখন চুক্তিটি শেষ করবেন, তখন এটি পুনর্নবীকরণ করতে পারেন। আমি বলি, “নাইজেরিয়ার অর্থনীতি ভাল নয়, কোনও গ্যারান্টি নেই যা আমি চালিয়ে যেতে পারি। আমি ওদের কথাবার্তায় নিরুৎসাহিত বোধ করছি।

প্রথমেই আমি আমার স্ত্রীকে  বাংলাদেশে ফোন করার সিদ্ধান্ত নেই । কিন্তু মায়া এখন  গ্রামে বাস করছে যেখানে ল্যান্ড টেলিফোন নেই। আমি বার্তাটি প্রেরণের জন্য Matlab টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসে কল করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি সেই টেলিফোনে পৌঁছাতে পারিনি। আমি তাকে বাংলাদেশে চিঠি পাঠিয়েছি,” আমি নিরাপদে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছি।“  চিঠি পাঠানো সময় সাপেক্ষ; প্রত্যুত্তর  পেতে এক মাস বা তারও বেশি সময় লাগে। 

প্রথম কয়েক দিন আমি শহরের সুন্দর দৃশ্যাবলী যেমন স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, জাদুঘর  এবং অন্যান্য সুন্দর জায়গাগুলি দেখার জন্য কিছু সময় নষ্ট করি।  আমি সাবওয়ে থেকে একটি  শহরের মানচিত্র সংগ্রহ করেছি, নিউ ইয়র্ক সাবওয়ে সিস্টেম দেখে নিচ্ছি  ।

(চলবে-)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন