ফ্লোরিডা থেকে:-

আকবার বাদশা মাঝে মাঝে আমার ২১৫ নম্বর নর্থ হোষ্টেলে এসে হানা দিত । বেশীর ভাগ সময়েই আমাকে না পেয়ে বসতো যেয়ে আমার ২ রুম পরে যে বড় ভাই তখন ক্ষমতাসীন পার্টির ছাত্রনেতা ,তার কক্ষে। আর আমাকে পেলেও আমি কোন না কোন কারণ দেখিয়ে তাকে এড়িয়ে যেতাম । সে জানতো যে আমি আর আগের মত তার প্রেমমুগ্ধ বন্ধু নেই , কিন্তু তারপরেও সে আসতো আমাকে বিরক্ত করতে।
কিছু পাগল আজন্ম পাগল থাকে , কিছু পাগল মুখে ফেনা তুলে বিবেকের কথা বলে।
সেই সব দিনে ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতা না হলে পিস্তল বন্দুক রাখা অবৈধ ছিল। আমার সেই ভয়ন্কর প্রতিবেশীর যেখানে ভিন্ন রাজনীতি করার কারণে আমার নাড়ি ভুডি বের করে কুকুরকে খেতে দেবার কথা, তা না করে বরং আমার এই পাগলাটে প্রাক্তন পন্ডিত বন্ধুটিকে রুমে বসতে দিত এবং আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে।
আকবর বাদশার মানুষ পটানোর বৈশিষ্ট্য ছিল ঈর্ষনীয়, আকবর বাদশার একটি মন ছিল বর্ষার বৃষ্টি বিধৌত পুঁই পাতার মত।

একদিন সে পিস্তল বাগিয়ে আমার কক্ষে এসে সিনেমায় দেখা ভিলেনদের মত আমার কপালে ধরে বলে “আমি কুকুরের মত তোমাকে গুলী করে মেরে ফেলবো এখন ”
আমি ভয় পেয়েছিলাম , কিন্তু তা গোপন করে বললাম,
“না মারলেও মানুষ বেঁচে থাকে না, আমাকে মেরে যদি তোমার শান্তি হয়, মারো।”
সে আমাকে যাচ্ছে তাই গালাগালি করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত চলে যায়। ওর রাগটা ছিল কোথায় আমি জানতামনা। ও কেনই আমাকে মারতে চাইলো, বা কেনই মারলোনা তাও আমি জানিনা, যদিও আমি ওর বন্ধুত্বের বলয় থেকে নীরবে বের হয়ে এসেছিলাম কোন রকমের কোন ঝগড়া ছাড়াই । যেমন আকাশে ধুমকেতু পাশকেটে চুপ করে চলে যায় কোন শব্দ না করে। এও কি ছিল ওর পাগলামীর একটা অংশ? প্রমান করা যে ইচ্ছা করলে সে পারে ?

আসলে আমিও ছিলাম অসুস্থ, যদিও আমার কোন ঔষধ ছিলোনা ( বই নিয়ে বুঁদ থাকা বা রাজনীতিতে জীবন বিলিয়ে দেয়া ফার্মাকোপিয়ায় ঔষধ হিসেবে লিস্টেড নয়) । মাঝে মাঝে বিকেল হলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতো। আমি সটান বাসে উঠে চলে যেতাম নদীর বাসায়। নদী ছিল হাঙর, চোয়াল উচানো হাঙর। সে আমাকে ভালোবাসেনি কারণ আমি তাকে মুখ খুলে বলিনি যে আমি তাকে ভালোবাসি। তাই তার ব্যাখা ছিল ৩৫ বছর পরে । দুজন মানুষ দুজনকে তীব্রভাবে ভালোবাসলে, দিনের পর দিন পাশে পাশে ছায়ার মত থাকলে , শুধু মুখ খুলে না বলার কারণেই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকা সত্য যে দুজনেরই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে সেই রূপকথা লোকে কি শুনতে চায়? সেই রূপকথা বলাও কি উচিত?

জীবন একমুখো নদী, সেখানে অনেক ভুল করা হয় , অনেক ভুল বোঝা হয় , ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় । কখনও কখনও জীবন বাজপাখী হয়ে ছো মেরে আমাদের কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে। তারপরেও সত্যকে কখনও কখনও স্বীকার করে নেয়াই সহজ এবং সৎ।

আমি আলবৎ তাকে বলেছি আমার ভালোবাসার কথা ।সে যদি বুঝে না থাকে, সে যদি সে কথা শুনতে প্রস্তুত না থাকে , তাতে তো আমার বলার সত্যতা মিথ্যে হয়ে যায়না। এক কথা বার বার বলা পুরুষের কাজ নয় । প্রথম প্রেম ,সবচাইতে সুন্দর, সবচাইতে পবিত্র, তার ডিটেইল গুলো কি এত সহজেই ভুলে যাওয়া যায় ?

আমি বার বার বলিনি কিন্তু এক ইন্চি জমিও ছেড়ে দেইনি শেষ দিন পর্যন্ত । সে আমাকে নিজের চোখের বদলে দেখিয়েছে সুন্দর ও শীতল মাছের চোখ । সোনালী মাছের চোখ!
রাতে রাতে ছুটে যেতাম এক শহর থেকে অন্য শহরে, কাছে বসে থাকতাম মন্ত্র মুগ্ধ তন্ময়তায়, গল্প করতাম ধুতুরার দুধে আস্তে চুমুক দিয়ে দিয়ে। এত ভালোবাসা এই আকাশের খিলান খসে কয়জন নারী দেখেছে এই মর্ত্যে ঝরে পড়তে ? পেত্রার্কার লরা ? দান্তের বিয়েত্রিচ?
না , না , না , সেই নারীরা সেই সৌভাগ্যের কাননে কোনদিন হাঁটেনি, তারা হেঁটেছে কবির কল্পনার রামধনুর সিঁড়ি বিয়ে।
“কাল আসেননি কেন ” তার কৈফিয়ত দিয়েছি কত রাত, তারপরে চাঁদের নৌকায় চড়ে হোস্টেলে ফিরে এসেছি শীত রাত্রীর দীর্ঘশ্বাসের বোঝা কাঁধে করে। এই সবই ছিল অর্থহীন, সবই মিথ্যা ?
তারপর একদিন মনে হয়েছে বৃথা , বৃথা এই যৌবনের অপচয়। বিশাল যে পাথর সরানো যায়না,তাকে অন্তহীন ঠেলা যায়না, তাতে অবমাননার জন্জাল জমে জমে মেঘ হয়ে উঠে ।

আমি খুব বেশী রাজপথে নেমে গিয়েছিলাম। পেটে যার ভাত নেই তার এত বেশী রাজনীতি করা ঠিক নয়। বিশেষ করে রাজপথে যারা রাজনীতি করে, ইতিহাস বলে তারা কোনদিন রাজপথের মায়া ছেড়ে যেতে পারেনা। তাদের রক্তে হয় শত্রুরা রাজপথে রং দেয় বিপ্লবের আগে , নয় মিত্রেরা বিপ্লবের পরে বিপ্লবকে সংহত করতে। রাজপথে রাজনীতি করে সাধারণ নির্বোধ মানুষ ; বিগত দশ লক্ষ বছরে সাধারণ মানুষ রাজা, প্রেসিডেন্ট , প্রধানমন্ত্রী ও বিপ্লবী কমরেডদের রাজপথের চৌকস রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে সমান ভাবে ।

রাজনীতির সবচাইতে নিরাপদ পথ হল উত্তরসূরির পথ বা চোরা পথ, যে পথে নেতৃত্বের সিঁড়ি বেয়ে যথা সত্বর রাজপথ ছেড়ে যাওয়া যায়। ক্ষমতাই হল সব রাজনীতির শেষ কথা , নিজের জন্য ক্ষমতা , তা ছোট পার্টি, বড় পার্টি, মাঝারি পার্টি বা রাষ্ট্র ক্ষমতা যাই হোকনা কেন। নারীর বিভ্রান্ত প্রেমিক হয়ে দেশের জন্য জীবন দিয়ে দেবার যে রোমান্টিক বিপ্লবীর পথ তা কোনদিন দীর্ঘায়িত হয়না। তা ভুল পথ। আকবর বাদশার বন্ধুদের পথ।

আমি অর্থনৈতিক , মানসিক ভাঙনের মুখে টের পেলাম যে নদীর থেকে মুক্তির একটাই পথ, অনেক দূরে চলে যাওয়া। দূরত্ব বহু সমস্যার সমাধান করে দেয়। তা নইলে সে হাঙর আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে । আমি উদ্ভ্রান্ত উৎকট এক চোরাবলিতে ছুটছি। বিশাল বিস্তীর্ণ সেই হা করা মুখ । আমাকে পালাতে হবে । বাঁচতে হবে ।

এই সময়ে স্কলারশীপটি এল । আমি বিশ্ব মানবতার মুক্তির স্থান সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে গেলাম। ভাবলাম বিদ্যাও হবে আবার সমাজতন্ত্রের আঁতুড়ঘরে বিপ্লবী সত্তার সংহতিও হবে। এবং অবশ্যই সবাই স্বস্থির নি:শ্বাস ছাড়লো । যে বোঝা কাঁধে বইতে ক্লান্তি লাগে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারে ,সে বোঝা গেলে নেমে গেলে শ্বাস নিতে
সহজ হয়।
নদীকে বললাম ,” যাই, শীঘ্র আর দেখা হবেনা”
সে বিদ্যুৎস্প্রিষ্ট হরিণীর মত লাফ দিয়ে উঠে সরু করিডোরে দুহাতে পথ রোধ করে দাঁড়ালো , “যাই মানে কি ? কোথায় যাচ্ছেন ?”
আমি দুহাতে ওর হাত সরিয়ে চলে এলাম বড় বড় পা ফেলে। সম্ভবত ওই প্রথম আমার হাত ছুয়ে ছিল ওর হাত। ওর আঙুল গুলো কি অদ্ভুত সরু ও সুন্দর, ওভিদের ডাফনের আঙুল গুলোর মত! ওর হাতে কি শান্তির কোমলতা, ওই হাত সাড়া জীবন ধরে রাখলেও ক্লান্তি লাগেনা। কিন্তু ওই ছিল শেষ স্পর্শ।
চলবে

শাহাব আহমেদ

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন