ফ্লোরিডা থেকে:-

যেহেতু এ মুহূর্তে আমি আমার গল্প লিখছি এবং আমার সম্পর্কে বলার কেউ আর আশে পাশে নেই, তাই আমাকেই কথাটি বলতে হচ্ছে : যৌবনে আমি খুব বুদ্ধিমান ছিলাম। বুদ্ধি ধারণ করে রাখতো যে ঘন চুল তা আর নেই , মাথা এখন ফাঁকা এবং সেখানে মেঠো হাওয়া এসে হাত বুলায় আর দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে আপন মনে উচ্চারণ করে ,”আই , আই , আই”।

আমি এই তিনটি “আই” নিয়ে যে রাশিয়ান দীর্ঘনি:শ্বাস তা পছন্দ করিনা। এর মানে আমি এমন একটা কিছু করে ফেলেছি যাতে হয়েছে এক অপরিমেয় অপচয় এবং যা শুধরানোর সময় আর নেই।

আই , আই , আই ।

আমি বুদ্ধিমান ছিলাম অথচ সেই স্কুল জীবনে যখন চোখ বুজে থাকা অনুভূতি গুলো ডালপালা মেলতে শুরু করেছে ,আমি কালো দৈত্যের মত এক ছেলের হাতে টমাস জেফারসনের একটা বই দেখে ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে পাগল হয়ে গেলাম। বুদ্ধিমান ছিলাম তার মানে এই নয় তখন আমি জানতাম টমাস জেফারসন কে ?
যে ছেলেটি এমন একটি বড় নামের কোন এক লোকের বই হাতে নিয়ে হাঁটছে সে না জানি কত বড় পন্ডিত!
নাম জিজ্ঞেস করলাম । হেসে বলল,” আমি আকবর বাদশা, “দীন ই ইলাহির” প্রবর্তক।”
সে যদি বলতো , বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রবর্তক তাহলে হয়তো বুঝতে একটু সহজ হোত কারণ বাংলা ক্যালেন্ডার কি তা জানতাম।
“দীন ই ইলাহী ?” একটা আস্ত পাগল!
সে আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। একতলা বড় বিল্ডিং । বিশাল একটি কক্ষ , চার দেয়াল ঘেষে বুক শেল্ফ গুলো বই দিয়ে ঠাসা। মেঝেতে এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো জামা কাপড় ,বই খাতা, বিছানায় দুমরানো মুচরানো লেপ, লুঙ্গি, সারা ঘরের দিকে তাকালে মনে হয় ওখান দিয়ে “মামাই হেঁটে গেছে”।

তখন “মামাই” কে , জানতামনা। এখন জানি। সে ছিল মধ্যযুগের এক দুধর্ষ তাতার -মঙ্গোল যোদ্ধা এবং সে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে যেখান দিয়ে যেত সেখানে ধ্বংস স্তুপ আর বিশৃংখলা ছাড়া আর কিছুই থাকতোনা। তাই এমন বিশৃংখলা দেখলে রুশীরা মামাইকে স্মরণ করে।

বই ,অনেক বই ,একেবারে হাতের মুঠোয় ।
আকবর বাদশার রাজপ্রাসাদ । ওর বাপ ছিলোনা। বড়ভাই মেরিন ইন্জিনিয়ার , বিদেশী জাহাজে কাজ করে , ডলার কামাই করে। এক ডলার তখন অনেক টাকা। ভাই বিয়ে করেনি। সুতরাং ভাইয়ের সব আয়ই ওদের। যাকে বলা যায় ধনী, ওরা ছিল তাই। অন্তত আমার তুলনায়।
ওর মা এগিয়ে এল, আকবর বাদশা মায়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, ” মা , ও ক্লাসের ফার্স্ট বয়, তুমি বলছোনা ভালো ছেলে-পিলের সাথে মিশতে, তাই ওকে ধরে এনেছি তোমার জন্য ।”

মা লিক লিকে হাড় জিরজিরে তিনশ বছরের এক বৃদ্ধা , মুখের চামড়া চিমসে কিশমিশ, চোখে দেড় হাত পুরু চশমা অথচ মুখে মাতৃত্বের স্নেহময়তা। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন , “বাবা বেঁচে থাকো, মানুষ হও।”
মানুষ হয়েছি কিনা জানিনা, বেঁচে আছি এটা ফ্যাক্ট। দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার চাঁদের উল্টো পিঠের যে অন্ধকার তা কিন্তু আকবর বাদশাকে দেখতে হয়নি। আমার হচ্ছে, ওর মার দোয়ার কারণেই হয়তোবা ।
অন্য বন্ধুরা ঝাপসা হয়ে এল। আকবর বাদশার সাথে সময় কাটাই, বই নিয়ে পড়ি , আলোচনা করি। ও আমাকে ঠিকই দীন ই ইলাহী ” সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিল এবং তা ছিল সঠিক ও তথ্যবহুল। ও ছিল আমার দুই ক্লাশ উপরে , আমাদের পরিচয়ের সময়টিতে সে মেট্রিক পাশ করে ফেলেছে , আমি তখনও স্কুলে।

চলবে….

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন