ফ্লোরিডা থেকে:-
তন্ময়তার তরলে ডুবে আছি।
কাল রাতে অপরূপ এসেছিল ওকালার গাছ গাছালী, মাঠ আর ঘোড়াদের পিছু পিছু, হেঁটে হেঁটে। তার চোখে ছিল আনন্দের ফোয়ারা।
দুটো কাঠবিড়ালী দুই পায়ে লম্বা দেওদারু হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার গাড়ীর পথ রোধ করে, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে।
আমার বাংলা ১৪২৪ নববর্ষের গান কবিতা ও নাচের উত্সবে যাবার প্রয়োজন কিন্তু ওদের বোঝা পোড়ার মুহূর্তটিকে ব্যাঘাত করার ইচ্ছে হলোনা। প্রয়োজন ও অপ্রয়োজন, সময় ও অসময় এই বোধ গুলো এত অস্পষ্ট হয়ে উঠছে দিন দিন যে আমি তন্ময়তার তরলে ডুবে যেতে যেতেও ভেসে থাকি । ভেসে থাকা না ডুবে যাওয়া, কোনটা যে ভালো এখন বুঝে উঠতে কষ্টে হয়, গহীনে কে যেন বলে ,”ভেসে থাকা” ।
আমি প্রশ্ন করি , “তুমি কি করে জানো?”
বলে, ” আমার মনে হয়।”
আছি।
এই নিয়েই। এইসব গাঁজাখুরী, গাল গল্প কথোপকথনের মরুভূমিতে । ক্যাকটাস, লম্বা লম্বা ক্যকটাস , আর কাঁটা !
পায়ে ফোটে, ক্ষত হয়ে পাকে, পুজ হয়ে
বের হয়, পুজ গুলো মধ্যপ্রাচ্যের তেলের
মত দেখতে, সুন্দর বনের কয়লা বিদ্যুৎ
আর সিরিয়ার আহত মানুষের মুখের মত!
সত্যই সুন্দর একটি অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছে এই ছোট্ট শহরের নারী পুরুষ ও শিশুরা। বেশ অতিথি এসেছে অন্য শহর থেকে , আর অতিথি শিল্পী দেশ থেকে।
দেশ যে কোনটা তা স্মৃতির মাথায় টোকা মেরে খুঁজে পেতে হয়।
আমার মায়ের দেশ,যেখানে সহজাত বোধের মানুষেরা ছিল ? না আমার দেশ , যা বিশ্বায়নের ম্যানফিল্ডে এক টুকরো জমি , যেখানে মানুষের চেয়ে চিল শকুন ও দাঁড়কাক বেশী?
ওকালার মানুষ গুলো ভালো, আমার তাই মনে হয়। তাদের কেদারায় বসার যোগ্যতা আমার নেই কিন্তু কেদারার হাতলে বসতে উসখুস লাগে। তাই আমি লুকিয়ে থাকি রৌদ্রের ছায়ায়,গাছগুলো কথা বলে শুনি, পাখী গুলো গান গায়।
পাখী গুলো সুন্দর গায়, পৃথিবীতে যত পাখী গান গেয়েছে যত শত বছর ,তাদের কন্ঠে গান ছিল আনন্দের, মানুষের মুখের গান সবটাই আনন্দের নয়।
মানুষের মুখে গান পন্যও।
এ নিয়ে কিছু করার নেই, আসলে এ প্রশ্নটা তোলাও অপ্রাসঙ্গিক।
মানুষ পাখী নয়, সে অন্যের শস্যের ক্ষেতে মুখ দিতে পারেনা।
আমার মগজে কিছু লতাগুল্ম ঝোপঝাড় আছে , সেখানে কতগুলো কালো কালো ঢোরা সাপ।
কালো ও সুন্দর , বিষাক্ত নয় , তবু গা শিরশির করে।
আমি ওদের নাম জানিনা। একদিন জানবো হয়তো, আর না জানতে পেলে নিজেই ওদের এক একটা নাম দিয়ে দিব, ভালোবেসে।
কারণ ঢোরা সাপ বিষাক্ত সাপের চেয়ে ভালো , অন্তত গত ৫০০০ বছরে তাই মনে করা হতো। ৫০০০ হাজার বছরে মানুষের মূল্যবোধ, ভালো-মন্দ ,সাদা-কালো এই সংজ্ঞা গুলো প্রায় অপরিবর্তিত ছিল, কিন্তু গত ৪০ বছরে সভ্যতা সব কিছু বদলে দিয়েছে।
এখন ঢোরা সাপ ভালো , না বিষধর সাপ ভালো সেটা তত স্পষ্ট নয়। বোধের জঙ্গলে অন্য বোধ।
দেশপ্রেমিক মুখোশ পরে হাঁটে, আর শত্রু মুখ খুলে ,দাঁত দেখিয়ে।
উটের দাঁত।
খয়ের চুন পানের কোন দাগ নেই সেই দাঁতে। তারা শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষনের গলা দিয়ে রক্ত ঝরায় বলেই ভাবার প্রয়োজন নেই যে তারা চিঙ্গিজ খানের বংশধর নয়।
ভালোবাসার দিন ছিল গতকাল , আজ গতকাল নয়। অথচ অনুভূতি গুলো কাছের জানালার ঐ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
বলি,”আমি রোদ দেখছি, বিরক্ত করোনা।”
টোকা মারে।
বাইরে গাছগুলোর বাতাসের সাথে ঢলাঢলী, যুবতি বাতাস, খালি হাসে , ওড়না উড়ায়।
বলি, “মগজের গহীনে অনেক গুলো পাইপ বসিয়েছি জ্ঞান তুলবো তেলের মত করে।” ভালোবাসা বুক উদোম করে দিতে চায়,দু হাত উচিয়ে বলি , “না না ,ছিহ্, একটু লজ্জা রাখো, আফ্রিকান ভাইওলেট , অর্কিড গুলোর কি হবে ? আর তাদের যে যত্ন করে ,সেই কুকুরের মত বিশ্বস্ততার ?
তুমি কি কুকুরের চোখে তাকিয়ে দেখেছো কোনদিন ?”
মানবতা শিখতে চাও কুকুরকে পীর মানো।
ভালোবাসা হাতছানি দেয়, জীবনের ভালোবাসা ,কিন্তু আমি এখন বৃদ্ধ, ভীষন বৃদ্ধ, তিথোনসের মত।
ঝিল্লি পোকা ডাকছে।
দুপুরের রোদ চিক চিক করছে ঘাসে ।
আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা। আমি মহাসমুদ্র সাঁতরাচ্ছি , না আমি মহাকাশে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমি পিপড়ের বোধী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা ভাঙা বাঁশী বাজাচ্ছি।
আমি মানুষ নই , আমি এই দুপুরের রোদ।
“তুমি জানো, আমার নাম তিথোনস?”
একটা ঝিল্লি পোকা বলে।
“এর চেয়ে কঠিন নাম আমি শুনেছি অনেক, তাতে কি?”
“তুমি একটা মুর্খ”
” শেখ মুজিব জ্ঞানী ছিলেন, তাতে কি? সত্যকে শাড়ী পড়ানো গ্রীক দেবী থেমিস বলে দোররা মারা কি তাতে থেমেছে?”
“তার মেয়েও জ্ঞানী এবং ক্ষমতায় থাকবেন চিরকাল , সেই চিরকাল যখন শেষ হয়ে যাবে তখন বুনো ওল ও তেতুল দেশ শাসন করবে ,তাতে কি?”
” আমি তোমাকে আমার গল্প বলতে চেয়েছিলাম, আর তুমি যত সব অর্থ হীন তর্ক বাঁধাচ্ছো। আমি এত হাজার বছর তর্ক না করেই বেঁচে আছি।”
ঝিল্লি পোকাটি নরম হয়ে আমার চোখে চেয়ে থাকে।
“সত্য সব সময়ই নি:সঙ্গ , তুমি কি সত্য?”
“আমি সত্য নই, আমি তিথোনস।”
সে নিজের গল্প বলে:
সে ছিল ট্রয়ের রাজপুত্র। উষোসী দেবী ইওস তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্গে। তার প্রেমিক হিসেবে। সেও রূপমুগ্ধ হয়ে ইওসকে ভালোবেসে ফেলেছিল।ইওস জিউসের কাছে যেয়ে তিথোনসকে অমরত্ব দেবার অনুরোধ করে । এত সুন্দরী ইওসকে কি জিউস না বলতে পারে? সে মন্জুর করে তার অনুরোধ। কিন্তু একটা ভুল হয়ে যায় । ইওস তার প্রেমিকের অক্ষয় যৌবন চাইতে ভুলে যায়।
তিথোনস অমর, কিন্তু তার বয়স বাড়তেই থাকে। সে থুথ্থুরে দুর্বল এক বৃদ্ধে পরিনত হয়,আর চলাফেরা করতে পারেনা, এমনকি হাতও নাড়াতে পারেনা। আর চোখে দেখেনা, কানে শুনেনা, আর এই পৃথিবীর রূপরস গন্ধও আস্বাদন করার ক্ষমতা তার নেই । অথচ মৃত্যু , মৃত্যু কখনও আসবেনা তার কাছে তুঁহু মম শ্যাম সমান হয়ে।
চির যৌবনা, অগ্নি -রূপসী ইওস তার জন্য কষ্ট বোধ করে ,কিন্তু কি করবে সে এই অথর্ব বৃদ্ধকে দিয়ে?
তিথোনস সব সময় কিছু বলতে চায়, তার অনুভূতি, বুকের ভেতরের আইঢাই, কান্না ভালোবাসা , আনন্দ ও কষ্ট প্রকাশ করতে চায় । তার মুখ থেকে আওয়াজ বের হয়ে আসে, কিন্তু কোন কিছুই বোঝা যায়না। তার অসহায় চোখ থেকে ঝরে অশ্রু।
শিশির বিন্দুর মত অশ্রু।
শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর দয়াময় তাকে একটি ঝিল্লি পোকায় পরিণত করে দেয়।
সেই থেকে সে চিৎকার করে জানিয়ে চলেছে তার পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসার কথা।
শৈশবে যখন আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসতো চারিদিকে গাছপালা ঝোপ ঝাড় গুলোর ডালপালা গুলো বেয়ে , যখন জোনাকী পোকা , তারা আর চাঁদ দিত আলো। অন্ধকারে এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত শুধুমাত্র হ্যারিকেন বা বাতাসে নৃত্যরতা কুপির আলোর শিখায় , নিঝুম রাতের নৈশব্দ ভেঙে দিত ঝিল্লি পোকার শব্দ ।
সে ছিল আমার মায়ের দেশ; স্বপ্ন , ভালোবাসা, বিশ্বাস ও নিরাপত্তার দেশ।
বলি ,”তিথোনস, সত্যিই কষ্টের ইতিহাস তোমার, তুমি কি এখনও ইওসকে ভালোবাসো?”
সে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে।
“ইওস যে নতুন দিনের দেবী, তাকে না ভালোবেসে কি পারা কি যায়?”
আমি তন্ময়তার তরলে ডুবে আছি, ইওস নতুন দিনের ইশারা দিয়ে যায়।
এপ্রিল ২৩,২০১৭
[asa]B01GUGW4J2[/asa]