বিকাল ৫টা বাজে, কাজ শেষে রহমান অফিস থেকে আস্তে আস্তে হেটে ঘরের দিকে রওয়ানা দিয়েছে হাতে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে। অফিসের কাগজ পত্র ফাইল কেবিনেটে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে চাবি ড্রয়ারে রেখে ২-৩ বার রুম চেক করে ধীরে সুস্থে বের হতে ৫-৭ মিনিট দেরি হয়। অনেক সময় রহমান ইচ্ছা করে দেরি করে এলিভেটরের ভিড় এড়িয়ে চলে । কখনও কখনও বড়ো সাহেবের সঙ্গে এলিভেটরের সামনে দেখা হয় । বড়ো সাহেবকে দেখলে সালাম দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং পরের এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করে। অফিস চলাকালীন সময় নিজের টেবিল ছেড়ে বিনা প্রয়োজনে কারো সঙ্গে আলাপ বা কারো টেবিলে অযথা সময় নষ্ট করে না । ঝড়/বৃষ্টির দিনে ও অফিস না গিয়ে বাসায় বসে থাকা পছন্দ করে না । এভাবে-ই গত ২০ বৎসর রহমান অফিস চালিয়েছে । অফিসে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই এবং এই ২০ বৎসরে তার কোনো প্রমোশন ও হয় নি। অনেক জুনিয়র কর্মচারী ও প্রমোশন নিয়েছে । কিন্তু রহমানের ভাগ্যে সে সুযোগ আসেনি ।
আজ অন্য দিনের চেয়ে রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় । একে তো রাস্তার সচরাচর ভিড়, তা ছাড়া আজ অনেকেই রেস-কোর্স ময়দানের সভায় যাওয়ার জন্য দ্রুত পা চালিয়ে যাচ্ছে । রাস্তায় কে কার আগে যাবে এ নিয়ে ধাক্কা- ধাক্কি ও হচ্ছে। সে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং পার হয়ে হাই কোর্টের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে । রাস্তার দুই দিক থেকেই গাড়ি বাস এবং রিকশা ভর্তি,রাস্তা অতিক্রম করার কোনো ফাঁক নেই । হাই কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ট্রাফিক সিগন্যাল দিলে রাস্তা পার হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে ।
সামনে রমনা পার্ক,গেটের দুই পার্শে চট- পটির দোকান । যুবক ছেলে- মেয়েরা লাইন ধরে চটপটি নিয়ে পার্কে বেঞ্চে বসে আরাম করে খাচ্ছে । চটপটির দোকানের পার্শে কয়েকটি ছিন্নমূল হাত পেতে লোকজনের নিকট পয়সা উঠচ্ছে ।”মাগো, বাবা গো আল্লাহর ওয়াস্তে দান করে যান, সারা দিন না খেয়ে আছি।” রহমান মনে মনে ভাবছে, দেশের অনেকের পরিবর্তন হলে ও এদের পরিবর্তন হয় নি বা হবে না । এ সব ছিন্নমূল হাত পেতে কাকুতি মিনতি করে পয়সা চাচ্ছে । আবার কেউবা ইট ভাঙছে, ঠেলাগাড়ি দিয়ে মাল নিয়ে যাচ্ছে। দিনের শেষে কেউবা বড়ো বড়ো দালানের সিঁড়ির নিচে, ওয়াসার পাইপের ভিতর, কোনো বস্তিতে, আবার কেউবা কোথায়ও মাথা গু জার স্থান করতে না পেরে রমনা পার্কের এখানে সেখানে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকে। এ সব লোক পার্কে আনাচে কানাচে বসে আছে আর লোক জন দেখলে হাত পেতে যা পায় তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। প্রতিদিন রহমান এ এলাকা দিয়ে সকাল বিকাল পার হয় আর এদের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এরাও আমার মতো মানুষ, সুযোগ ফেলে হয়তো আমার চেযে ও ভালো করতে পারতো। কে এদের খবর রাখে, রহমান ভাবতে ভাবতে খানিকটা এগিয়ে যাচ্ছে।
রমনা পার্ক থেকে নজরে পড়ছে রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য এবং মঞ্চ থেকে বক্তৃতার আওয়াজ আসছে। রহমানের কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে একটু উপভোগ করার মতো সময় নেই। রেবেকা বাজারের তালিকা দিয়েছে, নিউ মার্কেট কাঁচা বাজার যেতে হবে । সে শাহবাগের মোড়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। হাজার হাজার জনতা মিছিল করে রেসকোর্স ময়দানের দিকে যাচ্ছে। রহমান খানিক থেমে রাস্তার উভয় দিকে তাকাচ্ছে। এই মিছিল পার হতে অনেক সময় লাগবে। সে মনে মনে বলে আমাকে নিউ মার্কেট যেতে হবে এবং কাঁচা বাজার করে ঘরে গেলে রেবেকা রান্না করবে। রেবেকা নিশ্চয়-ই আমার বাজারের জন্য অপেক্ষা করছে। দেরি হলে সে রাগ করবে । কিন্তু যেভাবে মিছিল একের পর এক আসছে রাস্তা পার হওয়ার মতো কোনো অবস্থা দেখা যাচ্ছে না । ১০-১৫ মিনিটের মতো দাঁড়ানোর পর পুলিশ যাত্রীদের রাস্তা পার হতে সাহায্য করাতে, সে ঢাকা ক্লাবের সামনে থেকে রাস্তা পার হয়ে এলিফ্যান্ট রোড ধরে একটু তাড়াতাড়ি পা পেলে গাউসিয়ার সামনে দিয়ে নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারে ঢুকবে । লোকের ভিড় ঠেলে সে সামনে এগোচ্ছে । এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকছে, রহমান সাহেব, রহমান সাহেব, সে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে । কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না । আবার এগুতে চেষ্টা করছে , এবার সামনে সামনি দেখা অফিসের সহকর্মী করিম সাহেব। করিম সাহেব এলিফ্যান্ট রোড থাকেন। একটু দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময়ের পর সে কাঁচা বাজারে গিয়ে মাছ তরকারি ও প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করে রিকসা নেবে বলে পূর্ব গেট দিয়ে বের হচ্ছে । অনেকটা দেরি হয়ে গেলো, একটা রিকসা নিয়ে রওয়ানা হলো । নিউ মার্কেটের এ দিকটায় কোনো মিছিল দেখা যাচ্ছে না । সে মনে মনে বলছে ইলশা মাছ টা তাজা এবং দামে সস্তা পেয়েছি । রেবেকা যদি কয়েকটা টুকরা দোপিঁয়াজি করে মন্দ হবে না ।
বাসায় ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে কৈফিয়ৎ, রেবেকা বলে তুমি ৫টা বাজে অফিস থেকে বের হয়েছো, এখন বাজে ৭:৩০ । রহমান বলে , তুমি জানো না আজ রেসকোর্স ময়দানে মিটিং, ভিড় ঠেলে রাস্তা পার হতে এত দেরি হয়েছে।রেবেকা বলে , আমি তোমার বাজারের দিকে না তাকিয়ে ডিম সিদ্ধ করে রান্না করে ফেলেছি। রহমান বলে আমি একটা ইলিশ মাছ সস্তা পেয়েছি এবং আসতে আসতে ভাবছি কটা টুকরা দোপিঁয়াজি করবে । তোমার ইলিশ তুমি ভাজি করে খাও ,আমি আজ আর কিছু করতে পারবো না । রহমান বলে ঠিক আছে,আজ না হয় কাল হবে। রহমান রেবেকার সঙ্গে কোনো ব্যাপার নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে না। রহমান জানে রেবেকা সংসারে বহু কাজ করে, ওকে রাগানো ঠিক হবে না ।
রেবেকা বলে তুমি কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসো ।আমি পরে বাজার গোছাবো। খাবার পর রহমান ঘরের সামনে আয়েশী চেয়ার-এ খানিকটা আরাম করে বসে বাহিরের দিকে তাকাচ্ছে ।বিদ্যুৎ এই আসে এই যায় । আকাশ মেঘলা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে , আকাশ গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে , মনে হয় এখনই বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া শুরু হবে। সাকিলা বলে আব্বু বৃষ্টি হবে, তুমি ঘরে আসো । রহমান বলে সারাদিন গরমে ক্লান্ত, আমি খানিকটা ঠাণ্ডা হয়ে নেই।
রহমান বলে মজিদ ও আজিজ কোথায় ? সাকিলা বলে, ওরা কয়েকজন একত্রে পড়াশুনা করে এবং আসতে দেরি হবে। ধম্কা হাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যে ওরা কি ভাবে ঘরে আসবে? ওরা কি ঘর থেকে ছাতা নিয়ে গিয়েছে ? রেবেকা বলে ওরা ক্লাস শেষ করে ঘরে আসে না । একবার লাইব্রেরি, পড়াশুনা শেষ করে ঘরে ফিরে। রেবেকা বলে তোমার এ ব্যাপারে চিন্তা করার কোনো দরকার নেই । ওরা আসতে পারবে। বলতে বলতে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হলো । রহমান কিছু সময় দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে আয়েশী চেয়ার টেনে ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে । সাকিলা রান্না ঘর থেকে হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে বলে ভাইয়াদের আসতে কষ্ট হবে । রেবেকা বলে ওরা বৃষ্টি দেখলে বের হবে না । রাত ১০টার দিকে মজিদ ও আজিজ বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ঢুকেছে । রেবেকা বলে তোরা কোনো ছাতা পাইলি না? আম্মু কার ছাতা কে দেয়, তা ছাড়া চাইতে লজ্জা লাগে। যাক গে তাড়াতাড়ি কাপড় ছেড়ে ভালো ভাবে গা মাথা মুছে খেতে যা । তোদের খাওয়া শেষ হলে আমি মাছ কুটবো এবং রান্না ঘর গুছিয়ে নেবো।
রেবেকা রান্না ঘরে হারিকেন নিয়ে মজিদ ও আজিজ কে খাওয়া দিয়ে বসে থাকে এবং বলে আজ সোজা খাওয়া কাঁটা বাছতে হবে না। সোজা খাওয়া ডিম ভাজি আর ডাল ভাত । ওরা শুনে মায়ের সঙ্গে হাহা করে হাসে। মজিদ বলে আম্মু তোমার হাতের সব রান্না খেতে ভালো লাগে । সাকিলা পড়ার টেবিল ছেড়ে দৌড়ে এসে বলে ওরা কি নিয়ে হাসে ? রেবেকা বলে সোজা সোজা খাওয়া, কাঁটা বাছতে হবে না বলছি, তাই হাসে । সাকিলা ও হা হা হা করে হাসে । আম্মু, আজকের খাওয়া আমার খুব ভালো লেগেছে।
ওদের খাবার পর রেবেকা মাছ কুটে ভাজি করে, সব বাজার গুছিয়ে ঘরে আসে এবং ততক্ষণে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে। রেবেকা ঘ্যানরঘ্যানর করে বলে তুমি সস্তা পাইলে রাত্রে মাছ নিয়ে আসো। কাজের লোক নেই, তুমি এটুকু ও বিবেচনা করো না । রহমান কিছু বলে না । রেবেকা দিনে স্কুলে কাজ শেষ করে এসে ঘরের কাজ করে ।রহমান সচরাচর ৯টা বা ১০টার মধ্যে শুয়ে পড়ে । বৃষ্টি এখনও থামেনি ,রহমান বলে এই ঘরে কয়েকবার পানি উঠেছে। বেশি বৃষ্টি হলে আমার ভয় হয় আবার পানি উঠে কি না । রেবেকা বলে তুমি এই ঘরকে এত ভালোবাস, এখান থেকে সরতে চাও না ।
রহমান ও রেবেকা ছেলে- মেয়েদের নিয়ে বহু দিন কলা বাগানের ভাড়া বাসায় থাকে । দুই কামরা বাসা । মুলি বেড়া দিয়ে সাকিলার জন্য ছোট্ট একটা কামরা করা হয়েছে। ধানমন্ডিতে তিন কাঠা নিচু জায়গা নেয়া হয়েছে যা মাটি দিয়ে ভরাট করে কিছু একটা করার প্ল্যান আছে। কিন্তু টাকার অভাব দুই জনে যে পয়সা রোজগার করে তা দিয়ে” নুন আনতে পান্তা পুরায়” অবস্থা। ৪-৫ বৎসর ধানমন্ডি এই নিচু জায়গা টুকু কেনা হয়েছে । প্রতি বৎসর একটু একটু করে মাটি ভরাট করে কলা,আনারস ও সবজি লাগানো হয়েছে। ছেলে মেয়েরা এ নিয়ে ব্যস্ত থাকে । উইকেন্ডে ওরা রেবেকার সঙ্গে বাগানে গিয়ে সময় দেয় ।
বাড়িওয়ালা মাসুদ সাহেব এক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট । কলা বাগানের এই প্লট ছাড়া ও টিকাটুলি, এবং গুল শানে আরও দুইটা বাড়ি রয়েছে। মাসুদ সাহেব একজন চৌকশ ব্যবসায়ী । ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া ও এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ব্যবসা রয়েছে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এরিয়াতে ওর প্রধান কার্যালয় । মাসুদ সাহেব মাঝে মাঝে যখন কলা বাগান বাসা দেখতে আসেন, রহমানের সঙ্গে আলাপ করে। মাসুদ সাহেব রহমানকে একজন সৎ মানুষ হিসাবে পছন্দ করেন । কয়েকবার এসে নিজের থেকে তাঁর ব্যবসায় যোগ দানের জন্য বলেছে।“ আমি আপনার মতো একজন আদর্শবান লোক খোঁজ করতেছি। আপনি আমার ব্যবসায় যোগদান করেন।“ রেবেকা রহমানকে বলেছে আমাদের বড়ো চাকুরীর দরকার নেই । রেবেকা বলে, তুমি সরকারি চাকরী করে অভ্যস্ত । তুমি এর ধারে কাছে ও যাবে না । আমাদের সৎ ভাবে চলা-ই ভালো। ছেলে মেয়েরা মানুষ হলে আমাদের কোনো অভাব থাকবে না । আমরা সুখে আছি দুমুঠো খেয়ে।
মাসুদ সাহেবের স্ত্রী সীমা মাসুদ, তার ছেলে আরিফ ও মেয়ে নাবিলাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে রেবেকা ও তার ছেলে মেয়েকে দেখতে আসে। এই ঘরে সোফা বা তাদের বসার উপযুক্ত কোনো কিছুই নেই। কিন্তু তাঁরা আমাদের ছেলে- মেয়েদের অবজ্ঞা করে না ।আমরা ১৫ বৎসর এই টিনের ঘরে থাকি । ওরা ১৫০টাকার বেশি ভাড়া নেয় না । এমন কি রেবেকাকে ওদের কোম্পানি কাজ দিতে চাইলে রহমান ও তার ছেলে মেয়েরা রাজি হয় নি । ওদের ধারণা এ জাতীয় বড়ো লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ঝুঁকি পূর্ণ।
কয়েক বার মাসুদ সাহেব তাদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দাওয়াত করলে রহমান ও রেবেকা না গিয়ে ছেলে মেয়েদের পাঠিয়ে দেয়। রেবেকা বলে ওদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার মতো বেশভূষা আমাদের নেই । সে যাই হোক ছেলে মেয়েরা তাদের সহ- পাটি, ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বতা রয়েছে। ওরা বরং গিয়ে উপভোগ করে আসুক। আরিফ ও নাবিলা মাঝে মাঝে এসে মজিদ, আজিজ ও সাকিলার সঙ্গ দিয়ে থাকে। ওরা আসলে, রেবেকা কিছু না কিছু তরী করে ওদের খেতে দেয় এবং নিজের ছেলে মেয়ের মতো আদর ও যত্ন করে। ওরা মাঝে মধ্যে স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা এবং সিনেমা দেখা এ সবে নিয়ে যায়। রহমান ও রেবেকা মন থেকে ওদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করলে ও ওরা আপন ভেবে আসা যাওয়া করে।
রেবেকা স্কুল থেকে ঘরে এসে ঘরের কাজ শেষ করে পাশের বাসার দুইটা মেয়েকে টিউশনি দেয়, এতে সামান্য হাত খরচের পয়সা আসে । এই করে জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালায়। ছেলে মেয়েদের কারো কোনো কিছুর চাহিদা নেই, যা পায় তাই নিয়ে ওরা সন্তুষ্ট থাকে । অতিরিক্ত খাটুনিতে রেবেকার শরীর ও বেশি ভালো যায় না । প্রায়-ই শরীরে জ্বর , কাশি, মাথা ধরা থাকে।
রহমান অফিস থেকে ঘরে এসে দেখে রেবেকা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে । আজ মেয়ে দুটাকে ও পড়াতে না করেছে। রহমান কপালে হাত রেখে বলে , এ কি তোমার তো প্রচণ্ড জ্বর! সে অপেক্ষা না করে ডাক্তার আজমলের চেম্বারে গিয়ে জানায় যে ” তোমার ভাবীর জ্বর, মাথা ব্যথা ও কাশি । ” ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বলে ও গুলি নিয়ে খাওয়াবে এবং বলবে রেস্টে থাকতে। রহমান বলে তুমি জানো ও বসে থাকতে চায় না । সে তো ঘরে রান্না – বান্না করবে । আজমল বলে অন্তত এক সপ্তাহ ওকে রেস্টে থাকতে দাও । তা না হলে , জ্বর বেশি হলে তখন কি করবে?
সাকিলা স্কুল থেকে ঘরে এসে মাকে মাথা ধুয়ে দিয়ে সুজি ও চা করে বলে আম্মু তুমি একটু গরম গরম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো । রেবেকা বলে ঘরে রান্না -বান্না কিছুই নাই । রাতে কি খাবে? মা তুমি এসব চিন্তা করবে না । আমি একটা কিছু করবো । তুমি রান্না ঘরে আসবে না । রেবেকা বলে সাকিলা, তুই কি রান্না করবি? মা, আমি পারবো, না পারলে তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো। তুমি বেড থেকে একবার ও রান্না ঘরে আসবে না ।
রহমান ওষুধ নিয়ে ঘরে এসে দেখে রেবেকা শুয়ে আছে এবং সাকিলা রান্না ঘরে । রেবেকা তুমি এখন এই কটা ওষুধ খেয়ে নাও , কাল ডাক্তার আজমল সকালে আসবে এবং দেখে যাবে। রান্না ঘরে টুক টাক আওয়াজ হচ্ছে শুনে রহমান উঁকি দিয়ে দেখে সাকিলা কিছু একটা রান্না করছে। রহমান জিজ্ঞেস করে, সাকিলা তুমি কি করো? আব্বু ,আমি ভাত বসিয়ে দিয়েছি এবং ডাল আর ডিম রান্না করবো। মা, তুমি রান্না করতে পারবে? পারবো, আম্মু আমাকে শিখিয়েছেন । তুমি বস আমি চায়ের পানি দিয়েছি। রহমান হাসে এবং বলে তুমি চা খাওয়াতে পারবে ? পারবো তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও আমি ততক্ষণে তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসি।
রেবেকা এক ডোজ ওষুধ খাবার পর উঠে চা খেয়ে বলে সাকিলা তুই ঘরে তোর নিজের লেখা পড়া নিয়ে টেবিলে যা । আমি দেখি তোদের জন্য কি রান্না করতে পারি। রহমান বলে রেবেকা আজ তুমি চুপ চাপ শুয়ে থাকো , আরাম করো এবং দেখো দু-একদিন ছুটি নিয়ে শরীর ঠিক হয় কি না। আমি শুয়ে থাকলে দুনিয়া চলবে কি করে । সাকিলা তুই যা তোর পড়াশুনা আছে । মা আমি রান্না ঘর গুছিয়ে চলে যাবো । এখনও সারা রাত পড়ে আছে, আমি হোম ওয়ার্ক শেষ করে ঘুমতে যাবো।
আজ রেবেকাকে কোনো কাজ করতে কেউ দেয় নি । রাতে শরীরে তাপ মাত্রা একটু বেড়েছে। সকালে ডাক্তার আজমল চেম্বারএ যাওয়ার পূর্বে এসে বলে ভাবি তোমার আবার কি হলো! ভাই আমার বেশি কিছু হয় নি । ডাক্তার রেবেকাকে ভালো ভাবে চেক করার পর বলে তুমি ৫-৭দিন রেস্টে থাকো, তাতে সেরে উঠবে। ভাই আমি তো স্কুলে যেতে চাই। না, আমি সিক রিপোর্ট লিখে দেব এবং কয়েকদিন ছুটিতে থাকো । রেবেকা বলে ভাই আমি বাসায় থাকলে পাগল হয়ে যাবো। বরং কাজে গেলে আমি ভালো থাকবো। যেতে চাও, তবে যাও, আমি সিক রিপোর্ট লিখে দিয়ে যাইতেছি। যদি বেশি খারাপ দেখো তাহলে সিক নিয়ে বাসায় চলে আসবে। আচ্ছা ঠিক আছে। কার কথা কে শুনে ,রেবেকা পরদিন স্কুলে গিয়ে উপস্থিত এবং পুরা ক্লাস নিয়ে বিকেলে ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে এক কাপ চা ও মুড়ি খেয়ে ঘরের বারান্দায় আয়েশী চেয়ার-এ বসে আরাম করে নিউসপেপার খুলে চোখ বন্ধ করে ঝিমোচ্ছে ।
পাশের বাসার রাফাত ছেলেটা কয়েকবার এদিকে উঁকি দিয়েছে । সাকিলা বাসায় এ যাবৎ আসে নি। সে বিভিন্ন অজুহাত নিয়ে বাসায় আসে।সে ইলেকট্রিক্যাল কাজ জানে এবং তাকে দিয়ে একটু আধটু কাজ করানো যায়। কিন্তু তার চোখের চাহনি সঠিক না । সাকিলার রুমের জানালা টা কখন-ই খোলা যায় না । বাসায় মেয়ে থাকলে এ হলো সমস্যা। আজকাল প্রায় ওকে দোকানের সামনে ঘুরা ঘুরি করতে দেখা যায় ।
সস্তা ভাড়া বলে আমরা গত ১৫ বৎসর বাসা ছাড়িনি। যে করেই হোক একটা টিনের ঘর উঠিয়ে হলে ও নিজের জায়গার উপর চলে যাবো । আমি প্রতিদিন সাকিলা ঘরে আসার সময় হলে, ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকি। এই ছেলে যে কোনো অজুহাত নিয়ে সাকিলার সঙ্গে একটু কথা বলতে চেষ্টা করে । আমাকে দেখলে দূরে সরে পড়ে । এই করে কতদিন মেয়েকে পাহারা দিয়ে রাখবো। মেয়ে আমাদের চোখে বড়ো না হলে ও অন্যের চোখে বড়ো হয়েছে। তা ছাড়া এটা তাদের উঠতি বয়স। এখন-ই ওদের চেক দিয়ে না রাখতে পারলে যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে।
রহমান ঘরে আসলে রেবেকা বলে তুমি কত বৎসর এখানে থাকতে চাও? আজ আবার কি হলো? তোমার কিছুই জানার দরকার নেই। রহমান বলে দেশে কিছু জমি বিক্রি করে কাজ ধরবো এবং হাউস লোণের জন্য দরখাস্ত করবো। রেবেকা বলে তুমি বলে-ই যাচ্ছ, কিছুই করোনা। যখন মেয়ে নিয়ে একটা কিছু ঝামেলা হবে তখন তুমি সব হারাবে। রহমান বলে সাকিলা মাত্র ক্লাস নাইন-এ পড়ে , এখনও বড়ো হয় নি। রেবেকা বলে তোমার মা চাচিদের কত বয়সে বিয়ে হয়েছে মনে আছে তোমার? সেও একটা কথা। আমি অফিস থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের কিছু টাকা উঠিয়ে নেবো এবং আগামী সপ্তাহে বাড়ি গিয়ে দেখবো একটু জমি ছেড়ে দিতে হবে। আপাততঃ টিনের ঘর করে উঠে যাবো। কিন্তু রেবেকা তোমার স্কুল দূরে হবে বাসা থেকে। বাদ দাও আমার কথা, আমি দরকার মনে করলে বাসে আসা যাওয়া করবো। ঠিক আছে । তুমি তো এখন বললে ঠিক আছে, কিন্তু কাল ভুলে যাবে। না এবার ভুল হবে না । রহমান বলে ঠিক আছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গার উপর একটা কিছু করে সরে পড়বো ।
ক্রমশ: