ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি

পর্ব ১৬।। 

পাশে পড়ে-থাকা চতুরদশপদী বেহালার সুষমাময় সুরের অনিন্দ্য মৃণালিনী চোখ মেলে। যেন টলেমি-নির্দেশিত একেকটি ধুপিয়ান গোলক উজিয়ে টুপ করে নেমে এল টেরাকোটা পরি কুরুশকাঁটাতে-বোনা পৃথিবীতে। জায়গির কিছু ভাবনা কখনো অপ্রাসঙ্গিক হয় না। অনিমেষ বালুবেলার থেকেও সার্বভৌম এমন অক্ষরে-লেখা স্মৃতিরা সবসময় কি হৃদয়হীনতার সহোদর? ব্যাকরণের ঘায়ে জর্জরিত আত্মঘাতী মেধারা কানাগলির মতো আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। তাদেরও জানা আছে– গাধাদের মাধ্যমিক ইশকুলে সচরাচর পড়ানো হয়, ‘সকল গর্দভই গ্ণডমূর্খ হয় না।‘

প্রচণ্ড দ্বিধাতে পরবাসী আমি। তোমার আলতা-রাঙানো পায়ের কোমল-সোচ্চার তল এই-প্রথম ছুঁলাম। দেখি– চার্বাকপন্থী একটি গোপনকাঁটার আঘাতে সেখানে ফুটে আছে উদ্ধত কোনো গোলাপ। তুমি বললে, ‘এ তো আমার অভিব্যক্তিগত নগ্নতা। এভাবেই কি আমরা ক্রমশ একে অপরের কাছ থেকে পারাবত-জাতীয় পত্রগুলো পাচ্ছি না?’

ফ্যসিবাদী বাবলাকাঁটার একচ্ছত্র অভিঘাতে জর্জরিত সুশীল বেড়াল লেলিহান কুকুরের ছায়াকেও আততায়ী ভাবে। 

দিকচক্রবাল পেছনে ফেলে-আসা উপযুক্ত ফড়িঙের প্রস্তাবে একেকটি বেলা কলাবতী হয়ে মুগ্ধতার বেচাকেনা করছিল। তুমি যে-পথ দিয়ে এখানে এলে, সে-পথে ব্রজবুলির আকাশ হল আরো নীল। সুস্থির ধুলিরা হয়েছে প্রগাঢ় রঙিন। অবশিষ্ট নানা নষ্টকীটের আঘাতে শস্যরা আর ভূলুণ্ঠিত হবে না। বিষণ্ণতা কোনো মিথ্যেবাদী আলেয়া? পরিপুষ্ট পর্দার আড়াল থেকে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী বলে যায় লুপ্ত দেবতাদের কথা। যাদের পদাঘাতে পাষাণ-পাহাড় চিরে ঝরনাধারা নেমে এসেছিল প্রথম। তাদেরও ছিল ভ্রূক্ষেপযোগ্য বজ্রবাণ। সেই বজ্রবাণের সংঘাতে পৃথিবী পেয়েছিল নবীনতম বৃষ্টির ঘ্রাণ। বৃষ্টির উমে ঘুমঘুম বীজের গর্ভে আলোড়িত হয় হৃদয়ঙ্গম সবুজের তাগিদ। সবুজ হয়ে ওঠে সকল রঙের জনক। 

আচানক বনমোরগ হলদেটে নক্ষত্রের ভাবভঙ্গিতে দুধলি ফুলের বড্ডো খোঁজখবর নেয়। আসলে বিদ্যাপতির মহালে বনমোরগের আলাপচারিতা একটি নিরতিশয় পুকুরঘাটের মতোই মোক্ষময়। বাতাবীলেবু-ফুলের গন্ধে আন্দোলিত হয় মোরগের লাল ঝুঁটি। 

গুটিসুটি গবেষণাগারে জন্ম-নেয়া প্রজাপতি কীভাবে চিনবে সাপের ফেলে-যাওয়া একান্ত খোলস, ধানক্ষেতের আলে মোক্ষম ইঁদুরের ব্যস্ততা, মধ্যদুপুরে হীরের মতো সহনশীল দিঘির টলমলে জল, গোধূলিতে আবছায়া আঁধারের নিষ্পেষণে জ্বলে-ওঠা কণে-দেখা আলো, লুব্ধকের দৃষ্টান্তমূলক আকাশ, কাশের প্লাবনে ভেসে-যাওয়া শরতের অগ্নিপ্রবণ স্নিগ্ধতা, কার্পাসের অলিন্দে তুলোট ধূমকেতুর শোভাযাত্রা, পায়রাদের বিচ্ছিন্ন বাকুম-বাকুম শব্দে চমৎকৃত পুঁইলতার ডগা, বিশৃঙ্খল আলোর সীমারেখা-চুয়ে ঝুলে-থাকা বুনোহাঁসদের সুদূরবর্তী উড়াল, গেছো ছায়াদের আলস্যবশত নাচের মুদ্রা? 

কাচের ঝরনার শৌখিন ঝালরে কেউ কি সুঁইসুতো দিয়ে এঁকে দিয়েছে আলোর ফিনকি? পাথরও সিংহ হয়ে ওঠে। তার পায়ে ছেয়ে-থাকা জলের পারদগুলো গ’লে-গ’লে লুটোপুটি খায়। দেবতা ভেবে যেন দৃশ্যহীন পূজারীরা শুশুনিয়া-আবাহনে অঞ্জলি দিয়ে চলেছে দিনমান। আমার ভালোলাগার সহপাঠী-ডানা খসে পড়ে। ওমনি একটা পৃথিবী তোমার পোষা ময়ূরীর দখলে চলে যায়। জুলিয়াসের রোমে বিষণ্ণ সিংহ কেউ বিনে পয়সায় বিলায়– এমন অকুণ্ঠ কথা কখনো শুনি নি।   

অবগুণ্ঠনহীন পূর্ণিমাতিথির রীতিনীতি বোঝার অবকাশ হতেই, হৃদয়ে চলকায় একটি সুসংবাদ, তুমি আসছ। অপেক্ষার দীর্ঘায়ু পেরেকে বিদ্ধ মন এতদিনে শিশুখাদ্যের মতো নরম তুলো হয়ে ভীষণ উড়ুউড়ু। এদিকে কীটপতঙ্গের প্রত্যঙ্গ ছুঁয়ে ছুটে-চলা গোবেচারা দৃশ্য দেয়ালঘড়ির অসাধ্য দোলকের পন্থায় আমাকে গ্রিক-ট্রয়ের উপাখ্যান বিতরণ ক’রে চলেছে।   

অক্ষয় জাদুঘরের সটান দেয়ালে ঝুলে-থাকা সুলতানি মুখোশের অচিন্ত্য আঁখি এখনো অশ্রুতে ছলোছলো। তারা কি সকলই মানবিক ইঁদুরের মতো ছিল ভাগ্যাহত? সিংহাসন-আরোহণের প্রতি বর্ষপূর্তিতে বুঝি হারিয়ে ফেলত ওপরে ওঠার মই? আসলে হাতে-হাতে ঘুরে বেড়ানো একটাকার বাণিজ্যিক হরিণেরা কখনো দেখে না প্রজাপতি-নদীর বৈঠক। যেখানে যাই, সঙ্গে নিয়ে ঘুরি আমাকে জাপটে-ধরা অনস্তিত্বের নিপীড়ন, উদ্বিগ্নতার চাবুক, মুদ্রাদোষের ছদ্মবেশে-থাকা ছিনেজোঁকের বেড়াজাল এবং আমার কলঙ্কহীন আংটিতে শীতঘুমে ব্যস্ত ভাগ্যদর্শী রক্তমুখি নীলা। 

শিলাময় নয়, এমন উৎকণ্ঠার সমতুল্য কিছুটা অমূল্য প্রেম দেখতে পাই পাশের বাড়ির হীরেমতির হেলনীয় দৃষ্টিতে। 

কেবলি ভাবি– কীভাবে নিজ্ঝুম বৃষ্টি আর নির্ঘুম উমের কীর্তিমান মেলামেশা জলহস্তির অলসতায় মিশে যায় বকুলফুলের উদগ্র কামনার ফুটন্ত পূর্ণগ্রাসে! তারপর একদিন পৃথিবীর সমস্ত কামরাঙা-বন থেকে অসম্ভব স্নেহ স্বাস্থ্যবান সূর্যগ্রাসকে ইলেকট্রন-প্রোটনে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। 

ক্ষুধিত বাঘের পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতায় পরিবেশবাদী হরিণগুলো ভয়ে বিবিধ ফুল হয়ে ফুটে রইল। গোয়েন্দাপরায়ণ বাঘ কি ভ্রমরের হটকারী ছদ্মবেশে ওইসব ফুলের দেখভাল করবে? আর মধু জমাটি হতেই চুমুকে-চুমুকে নিঃশেষ করে দেবে! এমন রূপান্তরের সারবত্তা খুঁজতে গিয়ে জনৈক খলিল জিবরান নবজাতক আয়নাদের পরমাত্মাকে প্রত্যক্ষ মেঘের সন্ততি-বাৎসল্য ভেবে বসতে পারেন। 

মল্লযুদ্ধের কথা ভুলে যেতেই, পশুচারণভূমির দখল নিতে আঞ্চলিক নৌমহড়ায় নাম লেখায় আধুনিকতা-উত্তর একলব্যের ভাই-বেদাররা। তিন-পা সামনে এগিয়ে দুই-পা পিছু হটে পিপাসার অতিরিক্ত ক্ষরণ বুকে নিয়ে করাত-ব্যবসায়ী কখনো একটুকরো কাচের মাত্রিকতায় নিজেকে ভঙ্গুর ভাবে না। 

ঢাক-গুড়গুড় ঘোষণাপত্রেও প্রতিটি পূর্ণদৈর্ঘ্য বিস্ময়ের একটি মৌসুমি অর্থ আছে। সনাতন বৃষ্টিতে ভিজে কুঁকড়ে-যাওয়া কাকের কালো জামাতে হাত বুলিয়ে দেয় কচি ভোরের শিশুসুলভ ধর্মাচার। সবুজ আগুনের হলকা ছুটলেই, প্রণয়ী দিনের পরশে তা রোদ্দুর বলে বিবেচিত হয়। কাঁথায় শুকপাখির ঠোঁটে সুতোর সর্বশেষ লালিমা বুনে দিতে-দিতে দুয়োরানি মনেমনে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ‘নুহের প্লাবনের দমকা আড়ালে এবারও কি হারিয়ে যাবে তাদের দৃশ্যগোচর পৃথিবী? আকাশ ছেয়ে যাবে প্রবীণ বাদুরদের অপ্রকাশিত প্রাচুর্যে?’ (চলবে…)

 

১ মন্তব্য

  1. যতই পড়ছি, ততই যেন গভীর এক অনুভূতির গহবরে চলে যাচ্ছি, সত্যিই অসাধারণ…….

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন