দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ০৮।।
উড়ন্ত ফানুসের বুকে কান পেতে ঊর্ধ্বশ্বাস শোনে নি কি কুহকময় স্পন্দন? উত্থিত বাষ্পের প্রগলভ মন্থনে দেখতে কি পায় নি আরব সাগর কিংবা নীল নদের সনাতন নকশা? ক্ষীণ ঝরনার নিষ্পন্ন প্রান্তে থাকতে পারে ডহর গঙ্গার শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ আর স্পর্শানুভূতির ঊর্মিল আড্ডা। প্রগাঢ় শালপাতার একটি রমণীয় নৃত্য দমকা বাতাসে শরীরী হয়ে উঠল পূর্ব-পশ্চিমে। যাবে কি পাহাড়ের দিকে? চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে অনেক দিন কৌম রোদ্দুরে বসে থাকি নি। তবে সঠিক উঠোনে চরে-বেড়ানো শালিক পাখিদের উৎসুক-তির্যক দৃষ্টি আমাকে নিঃসঙ্গ বলে ভর্ৎসনা করে– তা বেশ বুঝতে পারি।
বুঝতে বাকি নেই – কঙ্কালসার সাঁকোর মগজে অবস্থান করে গৃহার্ত অবলীলার উদ্বিগ্ন উপলব্ধি। তাহলে কি খুবখুব ভালো আছে খানিক-কুঁজো বাঁশের দুস্থ খুঁটিটা! পরিত্যক্ত শ্মশানে পড়ে-থাকা সকল মাথার খুলি পাঠশালা-ফেরত শকুনদের লবণাক্ত দূরদর্শিতা পায় না। কাচা এলাচের উজ্জ্বলতা নিয়ে কিচিরমিচির শ্লোকে বংশপরম্পরায় কুমারপাড়ার ইতিহাস গেঁথে চলেছে বিশুদ্ধ পাখিগুলো। কোবিদ বংশী নদীর এতে আপত্তি ছিল– শুধু তারাই কেন এ গুরুদায়িত্ব পালন করবে! কলকল ধ্বনির বনেদি ছন্দে সেও তো পারত অঙ্গার-হয়ে-যাওয়া মাটির ঘনত্বে জন্ম-নেয়া কলসির কথকতা লিখতে!
তোমার স্পর্শঘ্রাণ আমার প্রশ্বাস-ঘনত্বে বর্ধিষ্ণু প্লাবন। যত দূরেই যাও-না কেন, আমি সেই ঘ্রাণের ধারাবাহিকতা চিনে তোমার কাছে ঠিকঠিক পৌঁছে যাব। নয়তো আমার চারদিকে দেবদারুমালা আসীন হোক। আমি ওতে থেকে যাই নির্বাসিত। এখন আর কেউ রাজভিখেরির হাতে গুঁজে দেয় না একটা-দুটো সুধী সকাল; বিকল্পে সাঁঝে নিভে-আসা নদীটার গান। সাগরতীরে ভুল করে বালির অক্ষরে লেখো নি কি আমার নাম? তেমনি করে তুমি প্রতি বিকেলে একটি প্রকৃত লালগোলাপ পরে নিও তোমার খোঁপাতে।
কখনো যদি আকাশ কিনতে গিয়ে নদী, নদী কিনতে গিয়ে আকাশ কিনে ফেলি, তখন আমি ভাবতে থাকি তুমি আমার হাতটি ধরে চুপটি বসে আছ। তবুও, আমাকে ক্রমান্বয়ে তোমার মতো যোগ্য হয়ে উঠতে বলো না। সময় ফুরাতে থাকবে। আমাকে পাবে না। তুমি তো পরশ পাথর! দ্রাক্ষাবনের উষ্ণতা নিয়ে তোমাকে ছুঁতে দাও। যেমনটি তুমি চেয়েছিল, আমি তেমনটি হয়ে উঠব পলকে জিরাফের বাড়ন্ত গ্রীবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কে চায় বলো আলোকসজ্জাহীন হৃদয়? আমার হৃদয়ে অগণন প্রবেশ করো। দেখবে– সেখানে তুমি আর তুমি। ভ্রমর যেমন ফুলকে ভালবাসে ফুলের জন্যেও, তেমনি আমি তোমাকে ভালবাসি তোমার জন্যেই। জানো কি?
জানাব-জানাব করে জানানো হয় নি। দূরত্বের ইছামতিতে যতই আকাশ পুঞ্জিভুত থাক-না কেন, কিছু তারা উঠে এসে এখনো আমাদের গাঁয়ে রাতকানা তালগাছটাকে আলো দেয়। অন্যমনে হাঁটতে গিয়ে কর্দমাক্ত ছায়ার গর্তে হঠাৎ পা মচকালে কে দেবে আমাকে শুশ্রূষা? গতকাল মোড়ের প্রাচীন টিস্টলে চা খেতে গেলে, আমাকে একলা পেয়ে সর্বজান্তা ষাটোর্ধ্ব একজন ভদ্রলোক আবহাওয়া বিষয়ে খানিক সম্যক জ্ঞান দিলেন। বললেন না, হিমযুগের পরে অসহিষ্ণুতার প্লেগ কোন মাত্রায় আসন্ন। কিংবা অবকাশের কাঁটাতার পেরুতে গেলে কতটুকু রক্তাক্ত হতে হবে?
খুব সাধ ছিল অন্তত সপ্তাহ তিনেকের জন্যে অবকাশযাপনে যাব নৈনিতাল। ভুলো কোনো তন্বীর ফেলে-যাওয়া ফুলেল রুমালের মতো কিছু সময় নির্লিপ্ত জীবনযাপন করব।
প্রকৃত প্রস্তাবে– নষ্ট হয়ে-যাওয়া টাইপরাইটারের জীবন ছুঁড়ে-ফেলা কমলালেবুর খোসার মতোই বড়ো একঘেয়ে।
নব্যদম্পতি কমলা রঙের সুটকেসে লুকিয়ে রাখে গুহাচিত্রের মতো আকর্ষণীয় আমিষ আশ্লেষ। গিরগিটির মেধা শেষবিকেলে ফেরি করে ফেরে চৌরাস্তার পাশ ঘেঁষে গভীর আগ্রহে এ কোন ফেরিওলা? অন্ধকার গলিটা পেরুতে গেলেই দূরের দোকানে ঝুলে-থাকা মুখোশগুলোর প্রাকৃতিক প্রেতাত্মা এসে আমাকে ঘিরে ধরে। কৌতুক করে বলে, ‘আজ্ঞাবহ কাঠঠোকরা হয়ে আর কতদিন গোলাপজামের চমৎকারিত্বে পরিপূর্ণ বেলুনগুলো ফুটিয়ে যাবে?’
পরস্পরবিরোধী দুটো রঙিন বেলুনের মাঝে আকাশছোঁয়া সিঁড়ির উচ্চতা ডাকসাইটে অট্টহাসিতে ন্যস্ত। রাজসিক তুঁতপোকার স্মৃতিতে নেই মেষপালকের সঙ্গীত; ম্রিয়মাণ ঘোড়ার যথাসাধ্য হ্রেষাধ্বনি! সকল সমুদ্রসীমানার মানুষগুলো একদিন গহীন অরণ্যে বেড়াতে গেলে, তারামাছদের আহ্বানে সোনালি চিলরা সৈকত দিবস পালন করবে। থেকেথেকে বেজে উঠবে সেতারের সুরে-বাঁধা বাতাসের আলাপনে জলজ সন্তুর সারাবেলা। সারাবেলা। সারাবেলা।
কে ওই দ্রাবিড় দেবদূতী সারাবেলা চোখের চৌকাঠে ঘুরেফিরে দাঁড়িয়ে থাকে? কার মুখ জুলেখার কমনীয়তা বিলায়? নমনীয় তৃষ্ণার ফসকা জালে ধরা দেয় না জল। লাবণ্য-ধনুকের ছিলাতে ভর করে কারো ছলনাময় দৃষ্টির তীর করুক-না বিদ্ধ এই আমাকে। বিক্ষত হই গরল প্রশান্তিতে। তোমার আঙুলের ডগায় ঝুলে-থাকা বৃষ্টির ফুল বড়ো ভালবাসি। প্রার্থনা পেতে রাখি– আমার আঁজলাতে জমুক-না অমন কিছু আত্মবিশ্বাস।
মধুকূপী দিগন্তে ফুটে-থাকা টুকটুকে ঘাসফুলটাই কি একান্তে বেড়ে-ওঠা ঋতুহীন রঙদের আত্মসমালোচনা? শীলভদ্রের কল্লোলিত লিপিতে ছেয়ে আছে তেমন প্রান্তরে কে রাখে মেলে ধ্যানের দুয়ার? নৌকোর গলুইয়ের মতো একটি গোলার্ধে তোমাকে নিয়ে সমাজ গড়ব জলপিপি আর পড়ন্ত দুপুরের পরামর্শে।
পদ্মাবতীর প্রকরণে পিঁপড়েদের মতো করে কবিতা লিখব দীপান্বিত সর্ষেক্ষেতের অভ্যাসে। বুকে হাত রেখে বলতে পারো নি– বৃষ্টি এলেই তুমি আসবে। জোছনাতে-ভাঙা জানালার পাশে বসে মেঘগুলোকে পর্বত, পর্বতকে বাড়ি, আর বাড়িকে তেপান্তর ভাবতে গিয়ে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করি। সারসের ন্যায় সাহসী শুকতারাকেও তুলোট হাঁসের ছানার সুরে সবিনয় গান গাইতে শুনেছি। কষ্টের কেশরে ঔজ্জ্বল্য বাড়লে ভুলে যাই জলপাই পাতাদের ছবি আকঁতে।
দুপুররঙা জামার ছায়াময় বোতামের স্থিরতা নিয়ে আনমনে কত কিছু যে আঁকিবুকি কাটি!
একবার পাহাড় কাটতে যাব বলে আমার সব লাটিম আর গুলতি বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে দিলাম। সারারাত যাত্রাপালা দেখে ঘুম কাজা করে বাসায় ফিরলে সোনালি সকালকে দুমড়ানোমুচড়ানো টিনের কৌটার মতো বিস্বাদ লাগে। ছেঁড়া ত্রিপলের রুগ্ণতাতে কী নির্বিকার রোদ্রের জল্লাদ-বিলাসিতা! আবারো রাত এলে আয়নায় ছড়িয়েছিটিয়ে-থাকা আমার দস্যি অশ্রুদের ঘুমপাড়ানি গান শোনায় প্রতিবেশী ছয়টি টিকটিকি।
আজো ভুলে গেছি উঠোনে ভাত ছিটাতে। কাকরা রাজনীতি বোঝে না। তাদেরকে কেউ হয়তো বোঝায় নি– রাজনীতি করলে রাজা পাওয়া যায়। আর রাজা পেলে নিজ দেশে পরবাসী হয় প্রজা। ঈশা খাঁ শীর্ষক জাতীয় বীর পদকপ্রদান-অনুষ্ঠানে স্মারক হিসেবে কাচের তলোয়ারের আজকাল দারুণ কদর। সাইরেন বেজে ওঠে পান থেকে চুন খসলেই। পুতুলনাচের ইতিকথা ভুলে এইসব অভিজ্ঞান অনেকে সুগন্ধি তেজপাতা চিনতেও ব্যবহার করে থাকতে পারে। তেমন সূত্র ধরে তোমাকে বলি নি, পাশের বাসার ডাকপিয়নটাই শৈশবে প্রথম আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে আঙুলের দাগ গুণে মারবেলের হিসেব রাখতে হয়। বানানে কাঁচা– এই উছিলায় কতদিন আমাকে লেখো না চিঠি। আর আমিও সস্তা হাততালি পেতে রুমাল থেকে কবুতর বানানোর ম্যাজিকটা শিখে নিতে শুধু অবহেলাই করে গেলাম। (চলবে…)