নদী ভাঙ্গনে জমি- জমা হারানোর পর জাফর জীবনের স্বাভাবিক চলাচলের গতি হারিয়ে ফেলেছে । স্বামী-স্ত্রী ও দুই ছেলের সংসারের খাওয়া খরচের জন্য তাদের কিছুই ভাবতে হতো না । জমি থেকে ধান, পাট ও রবি শস্য যা উৎপন্ন হতো, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালিয়ে যেত । কারও কাছে ধার দেনা করতে হতো না, এ ভাবেই চলে যেত জাফরের সাংসারিক জীবন । কিন্তু নদীর একদিক ভাঙে আর একদিক গড়ে এই খেলায় সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে । এখন দিন মজুরি দিয়ে কোনোরকমে ও সংসার চালাতে পারছে না ।
জাফর প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ ও দোআ কালাম পড়ে স্থানীয় বাজারে গিয়ে দিন মজুরের কাজ খোঁজ করে, ভাগ্য প্রসন্ন হলে কোনো দিন কাজ পায়, আর কনোদিন কাজ না পেলে ফিরে আসে, স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা এ অবস্থায় অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে । জাফরের কাজের উপর নির্ভর করে পরিবারের ভরণপোষণ অসম্ভব রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে । এই বাজারে জাফরের মতো আরও কয়েক জন ভূমিহীন মজুর প্রতিদিন কাজের খোঁজে লাইনে দাঁড়ায় । ধান কাটা, পাট কাটা ও ফসল লাগানোর মৌসুমে ওদের বেশ সমাদর । কিন্তু ফসল লাগানো বা ফসল উঠানো শেষ হলে কাজ পাওয়া যায় না । প্রতিদিন এ সব মজুর বাজারে কিছু সময় ঘুরা ঘুরি করে ঘরে ফিরে আসে ।
গ্রামের এই ছোট্ট বাজার, একটা চায়ের দোকান যেখানে ভোর হলে-ই গ্রামের নেতা,উপ-নেতা এবং স্থানীয় লোকের ভিড়ে বসার জায়গা পাওয়া যায় না । দোকানের মালিক জুনা একা চা তৈরী করে সবাইকে টেবিলে পরিবেশন করা সম্ভব না, একটা ছোট্ট ছেলে চা নাস্তা পরিবেশন এবং পয়সা নিয়ে ক্যাশে জমা দিয়ে সাহায্য করে । এই দোকানের দেখা দেখি বাজারে আর ও দুইটা দোকান খুলেছে । কিন্তু এই দোকানের মতো ব্যবসা হয় না, কারণ এই দোকানের চা একবার খাইলে আর একবার ফিরে আসতে হবে । অত্র এলাকাতে জুনার চায়ের দোকানের নাম ডাক আছে । এই দোকানের চায়ের উপর দুধের সর ভাসে । জুনা লোকজনের বসার সুন্দর ব্যবস্থা করেছে, বসার আরামের জন্যও লোকজন এখানে ভিড় জমায় । দুধ বাজারে এক নম্বরি,দুই নম্বরি, পানি পাউডার মিশানো দুধ ও পাওয়া যায় । সে নিজে গিয়ে দেখে শুনে ভালো দুধ খরিদ করে এবং অনেক সময় নিয়ে দুধ ঘন করে চা তৈরী করে । দুধ অনেক সময় নিয়ে জাল দিয়ে ঘন লালচে রং করে চা তৈরী করে, তা ছাড়া দুধের সর আলাদা বিক্রি করে । চিনি আর খেজুরের গুড় দিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে লোকদের পছন্দ মতো চা তৈরী করে অতি যত্ন সহকারে কাস্টমারের মনো-রঞ্জনের চেষ্টা করে ।
লোকজনের বসার সুন্দর ব্যবস্থা এবং চা খেয়ে তৃপ্তি পায় বলে এই দোকানেই ভিড় বেশি । তাছাড়া দোকানে (ভিলেজ পলিটিক্স) বিভিন্ন দলের রাজনীতির আলাপ আলোচনা হয় বলে সবাই এসে জড়ো হয় । জুনা কায়দা করে পত্রিকা এবং টেলিভশন রেখেছে যেখানে লোকজন নিত্য তাজা খবর ও আমোদ-প্রমোদ উপভোগ করে । ক্রিকেট আর ফুটবল খেলা দেখার জন্য লোকজন আগে থেকেই গিয়ে জায়গা নিয়ে বসে, এমনকি দোকানের বাহিরে ও দাঁড়িয়ে টেলিভশন দেখে হৈ হৈ করে চিৎকার করে বাজার মাতিয়ে তোলে ।
এখানে রাজনৈতিক সব দলের সমর্থক আছে, যা নিয়ে লোকদের মধ্যে সব সময় তর্ক বিতর্ক এমন কি কখনও কখনও হাতাহাতি ও হতে দেখা যায় । সবাই ছোট নেতা, বড়ো নেতা, রাজনীতি পছন্দ করে, যে দল সরকারে থাকে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে সতর্ক হতে হয়, নতুবা তর্ক বিতর্ক থেকে শুরু করে হাতাহাতি ও হয়ে থাকে । জুনা জ্ঞানী লোক, সে বুঝে এই পরিস্থিতিতে নিজেকে সামাল দিয়ে কথা-বার্তা বলে । সে ও একজন নেতা,এক সময় উনিয়নের মেম্বার ছিল, তবে কোন পক্ষ সমর্থন দেয় বলা মুশকিল, বেশির ভাগ সময় ব্যবসার খাতিরে সে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে ।
লোকজন সুযোগের সন্ধানী, নেতা আর পাতি নেতাদের পিছনে ঘুরা ঘুরি করে যে যেভাবে পারে কাজ বাগিয়ে নিতে চেষ্টা করে, যেমন গ্রামে রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজে মেরামতের কাজ শুরু হলে, অনেকে সুযোগ নিতে চেষ্টা করে ।
যার যত বড়ো হাত, (স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে উপরে মন্ত্রী পয্যন্ত), তার ততো বেশি শক্তি । সোনা মিয়ার ছেলে মন্ত্রীর অফিস পিয়ন , কাজেই সোনা মিয়ার হাত লম্বা এবং সেই হিসাবে দোকানে একটু সমাদর বেশি পায় । মন্ত্রীর অফিসে লোক নেবে, সোনা মিয়ার ছেলে দিনু বলে দিলেই চাকুরী হয়ে যেতে পারে, সোনা মিয়া গ্রামের টিটুর ছেলের জন্য তদবির করে আজ দুই বৎসর । কিন্তু এ পয্যন্ত চাকুরীর সিরিয়েল পাওয়া যায় নি । টিটুকে দেখা মাত্র সোনা মিয়া বলে হয়ে যাবে, মন্ত্রী সাহেব একটু ব্যস্ত আছেন, আবার কখনও কখনও বলে মন্ত্রী সাহেব বিদেশে আছেন ।
হাসমত স্থানীয় ইউনিয়ন সদস্য প্রতিদিনই চায়ের দোকানে বসে চা খায় এবং লোকজনের সঙ্গে আড্ডা জমায় । জাফরকে দেখে বলে কিরে জাফর মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে কেন, জুনা জাফরকে এক কাপ চা ও একটা টোস্ট বিসকুট দাও । জাফর হাসমতের ভোটের সময় অনেক খেটেছে। সে হাসমতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ।
কিরে জাফর কিছু বলবি?
চাচা কি আর বলবো, নদী ভাঙ্গনে আমাকে ফকির বানিয়েছে । দেখ জাফর, এই এলাকায় শুধু তুমি একা না, অনেকের জমি জমা সব কিছু হারিয়েছে নদীর ভাঙ্গনে । যারা তোমার মতো, আমার মতো খেয়ে দেয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকতো, তারা আজ পথের ফকির ।
জাফর বলে, চাচা আপনাদের অফিসে জনগণের জন্য সরকারি রেশন আসার কি কোনো সম্ভবনা আছে ?
না, ভবিষ্যতে যদি আসে, তোমার নাম ঢুকিয়ে দেব ।
ঠিক আছে চাচা একটু মনে রাখবেন ।
চাচা অনেকে বলে নদী ভাঙ্গনে যারা জমি হারিয়েছে, চরে জমি উঠতে ও কম পক্ষে ১৫ বৎসর লাগবে,সে পয্যন্ত বেঁচে থাকবো কিনা আল্লাহ জানে ।
ওই জমি উঠলেও তার প্রমান কি ?
অনেক মস্তানের হাত হয়ে আমার মতো লোক কিছুই পাবে না । সেও ঠিক-ই বলছো । তথাপি কাগজ পত্র যত্ন সহকারে রেখে দিও, তুমি জীবিত না থাকলেও তোমার ছেলেরা যদি কোনোদিন সুযোগ পায় । কি করবে সব-ই ভাগ্য, না হয় তোমার আমার লোক বাপ্- দাদার সম্পত্তি চাষ করে কোনো রকমে আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম ।
এই কথা সেই কথা বলতে বলতে নেয়ামত আলী মিয়া হাতে লাঠি নিয়ে আস্তে আস্তে এসে চায়ের দোকানে ঢুকছে । স্থানীয় বয়স্ক নামি-দামি লোক, জুনা এবং সবাই সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে দাদা আপনি বসেন, বসার জায়গা করে দিলে নেয়ামত আলী মিয়া বসে এ দিক সে দিক তাকিয়ে বলে কি নিয়ে কথা বলছো?
চাচা, জাফরের সংসারের দুরবস্থা দেখে সবাই দুঃখ করে ।
কিরে জাফর আজ কাজ করিস নি ?
না, দাদা কাজ কোথায় পাবো?
আমাদের জমিতে নিড়ানি দরকার আছে কি ?
আপনাদের জমিতে কাজ তো করতে পারি দাদা , কিন্তু চাচা কেরামত আলী মিয়া গত ৩ দিনের পয়সা দেন নি এবং তার আগেও একদিন গত মাসে কাজ করেছি তাও দেয় নি । বুঝেন তো আমি কাজ করে সঙ্গে সঙ্গে মজুরি নিয়ে চাল,ডাল কিনে ঘরে গেলে রান্না খাওয়া হয় ।
মুখের উপর কি বললি তুই, আমরা কারো ও পয়সা মেরে খাই ?
না দাদা তা বলছি না । সংসার তো চলছে না, কি করবো ?
তাই বলে মুখের উপর এভাবে অপমান করে কথা বলবি?
হাসমত মেম্বার বাধা দিয়ে বলে ও বুঝতে পারে না কার সঙ্গে কি বলে । নেয়ামত আলী মিয়া পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলে এই নিয়ে যা তোর মজুরির পয়সা । জাফর টাকা নিয়ে বলে দাদা আমাকে মাফ করবেন, আমি গত মাসে এক দিন কাজ করেছি, সেই মজুরি ও কেরামত আলী মিয়া দেন নি?
নেয়ামত আলী মিয়া চোখ লাল করে বলে তোকে পয়সা হয়তো দিয়েছে, তুই খেয়ে ভুলে গেছিস । হাসমত বলে ওই পয়সা পরে দেবে, তুমি জমিতে কাজ করবে তো যাও উনি পয়সা দেবেন । জাফর সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায় ।
হাসমত বলে দাদা ও গরিব মানুষ পেটের খিদায় কার সঙ্গে কি বলে জানে না ।
কিছুক্ষনের মধ্যে কেরামত আলী মিয়া বাজারে এসে দোকানে ঢুকতেই ওর বাবা নেতামত আলী মিয়া বলে তুমি জাফরকে তিন দিন কাজ করার পয়সা দাও নি, সে সবার সামনে আমাকে অপমান করে বলে, আপনাদের কাজ করলে মজুরি পাওয়া যায় না ।
কি আব্বু ! তার এত বড়ো সাহস ?
হাসমত মেম্বর বলে ও গরিব মানুষ পয়সা না পেলে স্ত্রী ছেলেরা না খেয়ে থাকে ।
আমি কি তার পয়সা না দিয়ে থাকবো?
আব্বু ও কেন তোমার কাছ থেকে পয়সা নেবে?
আমি তাকে তিন দিনের মজুরি দিয়েছি , সে বলে গত মাসে ও একদিন কাজ করেছে, তুমি পয়সা দাও নি ।
এইরে হাবিব তুই জাফরকে গিয়ে ডাক, বল আমি দোকানে তাকে ডাকছি । এখন দেখবেন তাকে আমি কি ভাবে শিক্ষা দেই ।
হাবিব জাফরের ঘরে গিয়ে বল কেরামত আলী মিয়া তোমাকে বাজারে যাইতে বলেছে । ও যাওয়ার পূর্বে হাসমত মেম্বারের চোখের দিকে তাকালে, সে চোখে ইশারা করে বলে ওকে আসতে নিষেধ করবে । সে জানে কেরামত আলী মিয়া ওকে মানুষের সামনে অপমান করবে ।
হাবিব জাফরের ঘরে গিয়ে বলে বাজারে দরবার বসছে,কেরামত আলী মিয়া ওখানে এসেছে এবং তোমাকে যাইতে বলছে । তবে হাসমত মেম্বার আমাকে চোখে ইঙ্গিত করে নিষেধ করেছে । জাফরের স্ত্রী এবং ছেলেরা বলে তুমি যাবে না ।
ও বলে কেন আমাকে ডাকছে?
আমাকে কিছু বলে নি, তবে ও রাগ করেছে ওর বাবার সঙ্গে , কেন তোমাকে মজুরি দিয়েছে ?
জাফরের স্ত্রী ও ছেলেরা বলে তুমি এখন যাবে না । কেরামত আলী মিয়া অত্যন্ত বদ মেজাজি লোক, তুমি গেলে হয়তো তোমার সঙ্গে মারা মারি বা তোমাকে মানুষের সামনে অপমান করবে। হাবিব তুমি গিয়ে বলো যে ও ঘরে আসে নি । হাবিব গিয়ে বলে যে দাদা জাফর ঘরে যায় নি, হয়তো কারো জমিতে কাজ করতে গেছে । নেয়ামত আলী মিয়া বলে, সে কেবলই এখান থেকে বাড়ির দিকে গেলো । কেরামত আলী মিয়া বলে কোথায় যাইতে পারে, যেখানে পাওয়া যাবে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে ।
জাফর হনুফাকে বলে রহমত ও আনোয়ারকে আমি আর পড়াশুনা করাতে পারবো না । ওরা বরং যেখানে যা পারে কিছু করুক,তাতে সংসার চলবে । হনুফা বলে না পারলে কি করবা, ওরা বাড়ি থেকে চলে যাবে এবং কিছু না কিছু করে বেঁচে থাকবে ।
এটা চৈত্র মাস, মাঠ ঘাট রোদে খাঁ খাঁ করে, রবি শস্য বুনা হয়েছে, অনেক দিন থেকে বৃষ্টি নেই, পানির অভাবে সব ছাই হয়ে গেছে । দেশে আকাল, কোথায় কাজ পাবো?
লোকজনের জমিতে মজুরের কাজ এবং এ বাড়ি সে বাড়ি মাটি কাটা, ঘরের কাজ, যেখানে যা পায় করে জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলতো । কিন্তু আজকাল কাজ তো পাওয়া যায় না ।
রহমত সবে মাত্র প্রাইমারি স্কুল শেষ করেছে, জাফর বলে আমি তোদের আর স্কুলে পড়াশুনা করাতে পারবো না । রহমত মনের দুঃখে কেঁদে বলে আব্বু আমি পড়াশুনা করতে চাই । জাফর বলে আমি কি করে তোকে পড়াশুনা করাবো?
হনুফা বলে দেখ তোর বাবা তো একা সংসার চালাতে পারে না ।
রহমত বলে আম্মু আমি কি কাজ করবো?
হনুফা বলে যা পারিস কিছু কর, সংসার তো একদমই চলে না ।
সে পথ ঘাট চিনে না, বাড়ি থেকে না বলে কোথায় ও যায় নি । কিন্তু আজ মনের দুঃখে না বলে কাঁদতে কাঁদতে ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করে ।
কিন্তু কোথায় যাবে ?
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে বড়ো রাস্তার পার্শে দাঁড়াতেই বাস এসে থেমেছে । সে কিছু চিন্তা না করে বাসে উঠে বসে, জানে না কোথায় যাচ্ছে, বাস কন্ডাকটর এসে বলে টিকেট নাও ।
রহমত বলে এই বাস কোথায় যাবে?
বাস কন্ডাকটর বলে এই বাস চাঁদপুর যাবে, সে কিছু না বলে সিটে বসে পড়ে । বাস কন্ডাকটর বলে পয়সা দাও , সে বলে পয়সা নেই ।
এক প্যাসেঞ্জার বলে এই গরিব ছেলে কোত্থেকে পয়সা দেবে?
পয়সা না থাকলে বাস থেকে নেমে যাও, ” এই ড্রাইভার সব বাস থামান , ওকে নামিয়ে দেন ” পাশের লোক ওর পয়সা দিয়ে বলে ওকে যাইতে দাও । বাস চাঁদপুর গিয়ে থামার পর রহমত হাঁটা শুরু করে । চারিদিকে বড়ো বড়ো দালান,দোকান, দেখতে দেখতে সে এক সময় কালীবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনে এসে দাঁড়ায় ।
লোকজন যার যার কাজে কেউ হেঁটে, কেউ রিক্সা করে এদিক সেদিক যাচ্ছে । রহমতের খিদে পেয়েছে , মনে পড়ে ঘরে মা রান্না করে কিছু না কিছু খেতে দিতো । মায়ের কথা মনে পড়তেই ওর দুই চোখ জলে সিক্ত হয়ে উঠে । ফুটপাথে একটা লোক গরম গরম পিঠা তৈরী করে চার পয়সা করে বিক্রি করে । রহমত দাঁড়িয়ে দেখে রিক্সাওয়ালা একটা দুইটা করে কিনে নিয়ে খাচ্ছে ।
একটা রিক্সাওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে বলে এই ছেলে পয়সা নেই ?
ও মাথা নেড়ে বলে নেই । দোকানদারকে বলে ওকে দুইটা পিঠা দাও বলে পয়সা দিয়ে চলে যায় । রহমত পিঠা দুইটা ও এক গ্লাস পানি খেয়ে এ দিক সে দিক তাকাতে তাকাতে রেল লাইন দিয়ে হাঁটতে শুরু করে ।
কালী বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড়ো স্টেশনে গিয়ে লঞ্চ ঘাটে অবাক হয়ে দেখে কি সুন্দর নদীর দৃশ্য?
ঘাটে লঞ্চ এই আসে,এই যায় । সে চিন্তা করে, এত লঞ্চ আসে, কোথায় যায় এবং কোথা থেকে এত লোক আসে ?
লঞ্চ ঘাটে ভিড়তেই ছোট ছোট ছেলেরা দৌড়ে উঠে প্যাসেঞ্জারদের মালামাল নিয়ে ঘাটে রিক্সা বা গাড়িতে উঠিয়ে দেয় । সে দেখে চিন্তা করে, আমি যদি ওদের সঙ্গে কাজ করি, কিছু পয়সা পাবো । সারা দিন কাজ করে যা পাবো, তা দিয়ে নিজে খেয়ে কিছু পকেটেও থাকবে, রাতে এখানে সেখানে ঘুমাবো । কিন্তু ওখানে ও সমস্যা, এই কাজ করতে হলে ঘাটে এদের সর্দারের অনুমুতি নিতে হবে এবং যা রোজগার করবে তার একটা অংশ সর্দারকে দিতে হবে । প্রথমে সে এত কিছু জানতো না, সে লঞ্চে গিয়ে কারো লাগেজে হাত দিতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে যে সর্দারের অনুমতি ব্যতীত কাজ করা যাবে না ।
ছোট ছোট ছেলেরা বলে তুমি কি নুতন এসেছো?
হ্যাঁ ।
কাজ করবে?
হ্যাঁ, কাজ করবো ।
অলি নামের এক ছেলে তাকে নিয়ে সর্দারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে এ ছেলে নুতন এসেছে, আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায় । এই করে সে লঞ্চ ঘাটে খালাসির কাজ শুরু করে । চাঁদপুর লঞ্চ ঘাট অনেক ব্যস্ত, এই ঘাটে ২৪ ঘন্টা লঞ্চ আসা যাওয়া করে । লঞ্চ ভিড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের লঞ্চ থেকে নেমে যাওয়া ও লঞ্চে উঠার হিড়িক পড়ে যায় । কিন্তু কারো কিছু ধরতে গেলে বলে আমাদের কোনো সাহায্য দরকার নেই । তাছাড়া সব ছেলেরাই দৌড়ে গিয়ে লোকজনের মালামাল নিয়ে টানাটানি শুরু করে । একমাত্র কেবিনে যে সব লোক উঠে, মাঝে মধ্যে বড়ো ধরণের লাগেজ থাকলে সাহায্য দরকার হয় । সারা দিনের পর যে পয়সা পাওয়া যায় তা দিয়ে নিজের খাওয়ার পয়সা ও হয় না ।
রহমত যা কিছু দেখে তাই তার কাছে আশ্চর্য রকম সুন্দর বলে মনে হয় । নদী থেকে জেলেরা তাজা ইলিশ ও হরেক রকমের মাছ ঘাটে উঠাচ্ছে । পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা ভিড় করছে, এর মধ্যে লঞ্চের যাত্রী ও বাড়িতে ইলিশ মাছ খরিদ করে লবন দিয়ে পাতিল ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে । রহমত ভাবে আমি যেদিন বাড়ি যাবো, পকেটে অনেক টাকা থাকবে এবং মাছ কিনে নিয়ে গেলে মা অনেক মজা করে ভাজি ও রান্না করে আমাদের খাওয়াবে । তার চোখে অনেক স্বপ্ন, ভাবতে ভাবতে সে দু হাত দিয়ে সিক্ত চোখ মুছে ।
রহমত বাড়ি থেকে না বলে এসেছে, হয়তো তার জন্য মাবাবা কান্নাকাটি করে । সে মনে মনে বলে এত অভাবী সংসার ,এরা কয়েকদিন কান্নাকাটি করে চুপ করে থাকবে । পয়সার নেশায় সে দিন রাত এক লঞ্চ থেকে আর এক লঞ্চ ছুটাছুটি করে । খাওয়ার সময় হলে স্থানীয় রাস্তার পাশের হোটেলে গিয়ে কিছু না কিছু খেয়ে আসে, ঘুমের দরকার হলে লঞ্চেই ঘুমিয়ে পড়ে বা টার্মিনালে কোথায় ও একটু জায়গা পেলে ঘুমিয়ে থাকে । কিন্তু তার ঘুম নেই , লঞ্চ এসে ঘাটে ভিড়তেই দৌড়া দৌড়ি শুরু হয় এবং কে কার আগে গিয়ে পেসেঞ্জারদের মালামাল নিয়ে টানা টানি শুরু করবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় । তার পরে কে কত টিপস পেয়েছে হিসাব করে ।
কিন্তু লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমাতে গেলে সিকিউরিটি এসে উঠিয়ে দেয় । সিকিউরিটির ভয়ে কয়েক জন কালীবাড়ি রেল লাইনের পার্শে ঘুমায়, তাও আবার খোলা আকাশের নিচে বা রেল লাইনের পার্শে কোনো বস্তিতে ।
কয়েক দিন না ঘুমায়ে রহমতের অবস্থা এমন হয়েছে যে তাকে চিনাই যায় না । কিছু দিনের মধ্যে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে । গরম,ঠান্ডা ও বৃষ্টিতে ভিজে সে জ্বর ও সর্দি কাশিতে ভোগছে । অলি তার বিশেষ বন্ধু, সে দুইবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে ঔষধ আনিয়ে দিয়েছে । খেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছে, তবে সময় মতো খাওয়া ও ঘুম নেই যে জন্য প্রায় অসুস্থ থাকে ।
সে আর এই কাজ করতে চায় না, এতে যে রোজগার হয় তা দিয়ে নিজের খাওয়া ও হয় না । এই শহরে এত সুন্দর সুন্দর দালান, বিল্ডিং, দোকান সবার রাতে ঘুমানের জায়গা আছে । কিন্তু আমার রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথা গোজার ঠাঁই নেই । আমার পরনে বাবার দেয়া শর্ট প্যান্ট, একটা ছিড়া জামা তা ও পরিষ্কার করতে পারি না ।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে রিক্সা ওয়ালাদের কাজে সাহায্য করে এবং এ করে রিক্সা চালানোর কাজ শিখে । সে মনে মনে ভাবে যদি আমি একটা রিক্সা কিনতে পারি তাহলে বাড়িতে চলে যাবো, নিজের এলাকাতে রিক্সা চালিয়ে মা বাবাকে সাহায্য করতে পারবো । কত দিন মায়ের হাতের রান্না খাই নি, ছোট ভাই আনোয়ারকে দেখি না, গ্রামে ছেলেদের সঙ্গে খেলা দুলা করতাম, তাও পারি না । খালাসির কাজ করে যে পয়সা রোজগার করি তা দিয়ে নিজের দুই বেলা খাওয়ার পয়সা ও হয় না ।
অলি ও মনি এই কাজ করে এবং রাতের অন্ধকারে মাঝে মাঝে প্যাসেন্জারের পকেট মারার কাজ ও করে । ওরা রহমতকে কু-পরামর্শ দিয়ে চুরির কাজে লাগাতে চেষ্টা করে । ওরা রাতের অন্ধকারে লোকজনের মালামাল চুরি করে । রহমত তার বন্ধু অলিকে বলে আমার ভয় লাগে চুরি করতে । অলি বলে তুই চুরি না করলে খালাসির কাজ করে পয়সা রোজগার করে কিছুই করতে পারবি না । লোক জন তোকে বড়ো জোর কয়েক পয়সা টিপস দেবে, তাতে সারা দিন ক’টাকা রোজগার করবি?
আমার ভয় লাগে, আমি ধরা পড়বো, অলি তুই কর, আমি এই কাজ পারবো না ।
অলি বলে এই দেখ কাল রাত আমি একজনের মানিব্যাগ চুরি করেছি , তাতে ৫০ টাকা পেয়েছি । তুই ৫০ টাকা দশ দিনে ও খালাসির কাজ করে পাবি না ।
এক দিন অলি রাতে চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে । মাঝ রাতে দোতালা লঞ্চ ঘাটে ভিড়লে সব খালাসিরা প্যাসেঞ্জারদের মালামাল ঘাটে নিতে গিয়ে হুড়াহুড়ি করে । অলি অন্ধকারে এক মহিলার গলার চেন ধরে টান দিতে গিয়ে ধরা পড়ে । মহিলা চোর চোর বলে চিৎকার করলে লোকজন ভিড়ে অলিকে ধরে ফেলে এবং মারধর করে পুলিশে দেয় । পুলিশ ওকে হাত কড়া লাগিয়ে নিয়ে যাইতেছে এবং রহমত দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে এবং ভয়ে লুকিয়ে থাকে । রহমত মনে মনে বলে আমি এই খালাসির কাজ আর একদিনও করবো না ।
রহমত পর দিন এক এক করে কয়েক জন রিক্সাওয়ালাকে কাজের জন্য বলতে বলতে একজন বলে আমি আর রিক্সা চালাবো না । তুমি আমার সাথে গেলে মালিকের নিকট পরিচয় করিয়ে দিতে পারি । মালিক রহমতকে বলে আমি তোমাকে চিনি না, রিক্সা দিতে পারি না । তবে যদি কেউ গারান্টর হয়, আমি রিক্সা দিতে পারি ।
রহমত বলে স্যার আমি গারান্টর কোথায় পাবো ?
দেখো যদি কোনো লোক পরিচিত আনতে পারো, আমি দেব । স্যার, তাহলে আমাকে আপনার গ্যারাজে কাজ করতে দিন । মালিক দেখে ছেলেটা অনেক সিরিয়াস হয়ে কাজ খোঁজ করতেছে, তাই গ্যারাজের কাজে লাগিয়ে দিয়ে বলে ভালো ভাবে কাজ করবে । সে রিক্সার সিট পরিষ্কার করে, চাকা ও চাইনে তেল দিয়ে ঝলমল করে রাখে, সকালে বা বিকেলে রিক্সাওয়ালা ভাড়ার পয়সা দিলে রেজিস্টারে লিখে রাখে এবং দিনের শেষে মালিককে বুঝিয়ে দেয় । এ ছাড়া ও মালিকের বাসার বাজার করা থেকে আরম্ভ করে নানাহ কাজে সাহায্য করে । এ সব কাজের বিনিময়ে সে বাসায় খাওয়া এবং হাত খরচের জন্য কিছু পয়সা পায় । রাতে সে গ্যারাজে ঘুমিয়ে থাকে ।
মালিক দেখে রহমত বিশ্বস্ত, সে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে । সে খুবই দায়িত্ব নিয়ে গ্যারাজে কাজ করে এবং কয়েক মাস দেখার পর মালিক রহমতকে বলে তুই আমাকে তোর তিন কপি ছবি দিবি, আমি তোর বাড়ির ঠিকানা জেনে তোকে রিক্সা দেব । এ ভাবে সে রিক্সা নিয়ে কাজ শুরু করে ।
সে যতবার বড়ো স্টেশনে বা রেল লাইনে যায়, ততবারই অলির খবর নেয় । অলি এ পয্যন্ত কোর্ট হাজোত থেকে ছাড়া পায় নি ।৬-৭ মাস পর একদিন অলি কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে বড়ো স্টেশনে এসে হাজির । অলির ময়লা ছেড়া জামা,উসকো-খুসকো চেহেরা, লম্বা লম্বা চুল, শুকিয়ে যেন কাঠ,চোখের কালো চামড়া দেখলে মনে হয় বহুদিন না ঘুমিয়ে আছে । অলিকে দেখে ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
সে বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর দুই দিন তাকে থানা কয়েদি হিসাবে রেখে মারধর করেছে । বাড়ি থেকে খবর শুনে তার মাবাবা এসে তাকে দেখে অনেক কান্না-কাটি করে । কিন্তু তারা অলিকে থানা থেকে মুক্ত করে নিতে পারে নি । থানা তাকে জেল হাজোতে পাঠিয়ে দিলে কেস কোর্টে উঠতে ৬ মাস লেগেছে এবং এ সময় সে অনেক নির্যাতন ভোগ করেছে । অবশেষে কোর্টে হাজির করলে জজ শিশু অপরাধ হিসাবে কিছু শর্ত-স্বাপেক্ষে মুক্ত করে দেয় । অলির বন্ধুরা যারা খালাসি হিসাবে কাজ করে জিজ্ঞেস করে ,তুমি কি খালাসি হিসাবে কাজ করবে?
সে বলে জজ বলেছে ,আমি এ কাজ করতে পারবো না ।
তাহলে কি করবে?
জানিনা, তবে কিছু একটা করবো ।
রহমতকে রিক্সা স্ট্যান্ডে পেয়ে অলি জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেলে, তুমি ঠিক বলেছিলে, চুরি করা ভালো না । আমি যদি তোমার কথা শুনতাম, তাহলে জেলে যেতে হতো না । রহমত অলিকে রিক্সা করে নিয়ে গিয়ে পালের বাজার এক রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া দাওয়া করিয়ে বলে তুমি রিক্সা চালাতে চাইলে আমি তোমাকে আমার মালিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব । অলি বলে আমি বাড়ি যাবো, মাবাবা এবং ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করবো ।
রহমত বলে তোমাকে যখন লোকজন মারতে ছিল, তুমি চিৎকার করে বলতেছিলে,” আমাকে মারবেন না,আমাকে মারবেন না ” । আমি কাদঁতেছিলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে, আর মনে মনে ভয় পাইতেছিলাম যে আমাকেও তোমার সঙ্গে সন্দেহ করে ধরতে পারে, সেই ভয়ে একটু দূরে দূরে ছিলাম । তোমাকে পুলিশ যখন নিয়ে যায়, আমি দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম ।
অলি বলে সে সময় আমার ভয় হয়েছিল যে লোকজন হয়তো পুলিশে না দিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে। পুলিশ আমাকে থানাতে রাতে রেখেছে এবং আমার পানির পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছিলো । আমি কেঁদে কেঁদে বলছিলাম , আমাকে একটু পানি, একটু পানি বলে কাঁদতে ছিলাম । একটা পুলিশ একটু ভালো ছিল,আমাকে পানি ও এক প্লেট ভাত দিয়ে বলেছিলো খেয়ে শুয়ে থাকো ।সে তালা লাগিয়ে দিয়ে একটা কম্বল পুনরায় এনে দিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলে প্রচণ্ড জ্বর । কিছুক্ষন পর একজন মহিলা নার্স এসে আমাকে দেখে কয়েকটা জ্বরের ট্যাবলেট দিয়ে চলে যায় ।
আমার মাবাবা থানায় আমাদের উনিয়নের মেম্বারকে নিয়ে এসে অনুরোধ করেছিল আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য । মনে হয় টাকা দিলে ছেড়ে দিতো, কোত্থেকে টাকা দেবে আমরা গরিব মানুষ , সে জন্য দুই দিন অপেক্ষা করে কোর্টে চালান দেয় । আমার বাবা জেল হাজতের গেটে অনেকবার এসেছে, কিন্তু কিছু করতে পারে নি । একবার উকিল নিয়ে এসে আমাকে বুঝিয়ে বলেছে যে আমি শিশু আইনে ছাড়া পেয়ে যাবো । সে জন্য আমি আশা করেছিলাম যে করেই হোক একটু দর্য্য ধরে থাকি ।
রহমত বলে, আমরা অভাবী মানুষ, বেঁচে থাকার জন্য সর্বদা লড়াই করে থাকি । ভুল সবাই করে এবং ভুল থেকেই আমরা সবাই শিক্ষা গ্রহণ করি । থাক যা হয়েছে, তা নিয়ে আর দুঃখ করো না ।
জেল খানায় আমাকে ৬ মাস ফেলে রেখেছে এবং আমার উপর দিয়ে অনেক নির্যাতন ও চালিয়েছে । ঠিক মতো খাইতে দেয় নি, ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারি নি । এত এত আসামি বিভিন্ন শিফটে ঘুমাতো, আমি ঘুমানোর মতো জায়গা পেতাম না । সারাক্ষন আমাকে দিয়ে লোকজন কাজ করিয়েছে । অনেক সময় মারধর ও করেছে । কখনো কখনো মা বাবা এসে ১০ টাকা ৫ টাকা দিয়েছে কিছু কিনে খাইতে, তা ও আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে জোর পূর্বক ।
জেল হাজতে অনেক লোক অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মারা যায় । আমি অনেক বুড়ো বুড়ো লোক দেখেছি যারা মনের দুঃখে কান্না কাটি করতো । অনেকে বৎসরের পর বৎসর বিনা বিচারে পড়ে রয়েছে । অনেকে দাগি চোর,বহু বৎসর থেকে চুরি করে, আবার কেউ কেউ আমার মতো ছোট চোর, দুই একবার চুরি করেছে এবং ধরা পড়েছে । কেউ কেউ আবার জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে মারামারি করে জেলে রয়েছে । অনেক মিথ্যা মামলাও আছে ,লোকজন নেই এবং টাকা পয়সা নেই , জেলে আছে । অনেকে আবার জেলে অত্যাচারে মারা ও গেছে ।
অলি বলে রহমত আমরা সাত ভাইবোন । সংসারে রোজগার নেই, অতিষ্ট হয়ে ঘর থেকে চলে এসেছি, আমি আজ বাড়ি চলে যাবো, আবার আসলে তোমার সঙ্গে দেখা করবো । বাড়ি থেকে আসলে আমার সঙ্গে দেখা করবে এই বলে পকেট থেকে ১০ টাকা তার হাতে দিয়ে বলে যাও পরে দেখা হবে । অলি বলে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ ।
জাফর মাসে একবার কি দুই বার চাঁদপুর রহমতের সঙ্গে দেখা করে কিছু টাকা নিয়ে যায় । মাঝে মধ্যে হনুফা এসে ও ছেলেকে দেখে যায় । রহমত মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে তোমরা আমাকে পড়াশুনা করালে না । হনুফা বলে তোমার পড়াশুনা না করার পিছনে আমাদের দারিদ্রতা ছিল এক মাত্র কারণ । আমরা দুই বেলা খেতে পাই না, গ্রামের পারিপার্শিক অবস্থা অনেক খারাপ,তোমার বাবা নেয়ামত আলী মিয়ার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছে, এখন ও পরিশোধ করতে পারে নি । ওরা দেখলেই বলে টাকা ধার দিয়েছি, কিন্তু তুমি ফেরত দেয়ার নাম করো না । তোমার বাবা কোত্থেকে দেনা পরিশোধ করবে?
রহমত রিক্সা চালিয়ে সে টাকা আস্তে আস্তে পরিশোধ করে দিয়ে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা এনেছে ।
নেয়ামত আলী মিয়ার ছেলে কেরামত আলী মিয়া গ্রামে জমি বন্দক নিয়ে যাদের জমি আছে সাহায্য করে এবং টাকা অনাদায়ে পরে জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে নিয়ে থাকে । এই করে গ্রামে অনেকের জমি কিনে নিয়ে পরে বেশি দরে বিক্রি করে । তাছাড়া সুদের ব্যবসা করে লোকজনকে টাকা দিয়ে পরিশোধ না করতে পারলে জমি নিয়ে থাকে । রহমত বলে মা তোমরা আর দেনা করবে না, কেরামত আলী মিয়া দেনা পরিশোধ না করলে আমাদের শেষ সম্বল এই বাড়িটুকু ও নিয়ে নেবে ।
ক্রমশ: