ট্রেনের একটু দূরে ফর্সা রোগা মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেদের মতো গলার নিচের টুটি দূর থেকে দেখা যায়। সন্ধ্যার একটু পরে নদীর ধারে জোৎসনা ফিনিক দিয়ে ফুটেছে। তার একটু দূরেই নদী বুকে কুল কুল শব্দে স্রোতের ওঠানামায় চাঁদের আলো লুটোপুটি খেয়ে মরছে। মেয়েটি একহাতে পুটলি আর আরেক হাতে খাবারের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
জটলা ফাঁক করে এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে মেয়েটির কাছে জানতে চায় আমাতলী যাবার লঞ্চ কখন ঘাটে ভিড়বে। মেয়েটি জানেনা সূচক মাথা নাড়ে। চাঁদপূরের ঘাঁটে অন্য দিনের তুলনায় আজ ভিড় বেশীই মনে হয়। বৃদ্ধ চলে যায়, রোগা মেয়েটির সাথে থাকা তার বাবা দুটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর জলে পড়া চাঁদের আলোর ঝিলিক মেয়েটির মুখ স্পর্শ করেছে। কানের বাজারি দুলের দুটো পাথর যেন পরশ পাথরের মতো আলোর বিচ্ছুরণ চারদিকে ছড়াচ্ছে।
দূরে বসে বি এ ক্লাসে পড়ুয়া এক যুবক মেয়েটির পাথরের বিচ্ছুরণ দেখছিল। চাঁদের আলোয় মেয়টির ফর্সা মুখ তার মুখের দিকে চেয়ে যেন হাজার বছরের প্রেমের জয়গান গাইছে। পুলকিত সংগীতের মুর্চ্ছনায় যুবকের হৃদয়ের আকূতি পদ্মার শাখা নদীর ঢেউয়ের ওঠানামায় তরঙ্গায়িত হচ্ছে। লঞ্চ আসতে দেরী হওয়ায় বাকপটু যুবকের মেয়েটির বাবার সাথে খাতির জমে যায়।
মেয়েটির অসুখের কথা জেনে যুবকের মনে খুব লাগল। সে ভাবে, পদ্মার জলে ইলিশের জালের পাশে টিমটিমে আলোর মতো মেয়েটির আলো নিমিষেই নিভে যাবে। এর থেকে বড় কষ্টের আর কি হতে পারে!
ঘাটের একটা লঞ্চ গন্তব্যের পথে ছেড়েছে। দূরের বাঁকে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আরেকটা লঞ্চ পল্টুনের দিকে সরীসৃপের মতো ধেয়ে আসছে। চাঁদ পৃথিবী গর্ভে তার আলোর ফিনিক অকৃপণভাবে ছড়িয়ে দিয়ে এক অদ্ভূত সৌন্দর্যে আলোকিত করেছে।
ঘাটের কুলি হাঁক ছাড়ে, নদীর ওপারে স-মিলের মিস্ত্রি গাছের গুড়ি ছড়াগীতের বোল আবৃত্তি করে চেরাই করার জন্য পাটায় তুলেছে। ঘাটের পাশের ট্রেন হুইসেল ছেড়ে গন্তব্যের পথে যাবার জন্য হামাগুড়ি দিচ্ছে। মেয়েটির ফরসা মুখ চাঁদের আলোয় অবাক সুন্দর না হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে এল। হাতের বাটি ছেড়ে দিয়ে গো গো করে বমি করে বুক ভাসায়। যুবক দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। ওড়নার আঁচলে মুখ মুছিয়ে মেয়েটির মাথা কাঁধের উপর রেখে একটা লোহার কবাটের উপর বসে । একটা রুগ্ন, নিশ্চুপ প্রাণ কিছুটা স্বস্তি পেতে যুবকের বুকের উপর নিজের শরীর এলিয়ে দেয়। বমি শেষে উচ্ছিষ্ট লালাটুকু যুবকের জামার সাথে লেপ্টে যায়। একটা অজানা আহাজারি কলিজা বিদীর্ণ করল। জোছনার বিচ্ছুরণ যেনো নিভে গিয়ে পৃথিবীময় ছাই রংয়ের আধাঁরে ঢেকে গেলো। ক্লান্ত হরিণ শাবকের মতো মেয়েটি যুবকের বুকের উপর ঢলে পড়ল। জ্বরের উত্তাপ মেয়েটির বুকের থেকে সংক্রমিত হয়ে যুবকের বুকে ছড়িয়ে যায়। বুকের ধুকপুকানির শব্দে যুবক ডুকরে উঠল। মৃত্যুর যমের হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে কোলাহলহীন কোথাও যেতে ইচ্ছা করে তার।
লঞ্চ ঘাটে ভিড়ল, মেয়েটির বাবা যুবকের থেকে মেয়েটিকে কেড়ে নিলো। বাবার কাঁধের উপর হাত দিয়ে মেয়েটি ধীর পায়ে লঞ্চের ডেকে উঠল। যুবক স্তব্ধ হয়ে দূর পদ্মায় মাছ ধরা নৌকার দিকে চেয়ে রইল। আবার ভেঁপু বাজল, লঞ্চ ছেড়ে দিল,আসন্ন নিভু প্রদীপের মতো মুমূর্ষূ প্রাণ আমতলীর গন্তব্যে যাত্রা করল।
সাপের চলার গতির মতো লঞ্চ পদ্মার বুকে জোর গতিতে চলেছে। যুবক মাথায় হাত দিয়ে লোহার কবাটের উপর বসে রইল। জোছনার আলো পদ্মার ওপারে গিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। নদী পাড়ে যুবকের এই সত্য মনে উদয় হলো, ক্যান্সার তার স্বপ্ন ভঙ্গ করেছে। মুমূর্ষু প্রাণ মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলছে। এ পথের অনন্ত যাত্রা থেকে কেউ আটকাতে পারেনা।