হযরত ইব্রাহিম বলিল,’বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে,তোমাকে আমি যবেহ করিতেছি,এখন তোমার অভিমত কি? ‘ সে বলিল ,’হে আমার পিত! আপনি যাহা আদিষ্ট হইয়াছেন তাহাই করুন । আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধর্যশীল পাইবেন ।’ (সূরা সাফফাত ৩৭-১০২ ).
হযরত ইব্রাহিম (আ: ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর অতি প্রিয় ছেলে হযরত ইসমাইল(আ: ) কে নিয়ে কুরবানী করতে পাহাড়ে চলে যান । যে সময় ইসমাইল (আ:) কে কুরবানী দিতে ছিলেন, আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর প্রিয় ছেলের পরিবর্তে ভেড়া(দুম্বা) কুরবানী করানোর মধ্য দিয়ে এই নির্দেশ আসে । ঈদ -উল -আজহা মুসলিমদের দ্বিতীয় ধর্ম উৎসব ।
মুসলিম ধর্মের ৫টি স্তম্ভ = ঈমান, নামাজ, রোজা, জাকাত এবং হজ্ব । রমজান বা রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের পর এটা সব চেয়ে বড়ো উৎসব যা সারা পৃথিবীর মুসলিমগন পালন করে থাকে । জিল হজ্ব মাসের ৮থেকে ১৩ তারিখ পয্যন্ত এই ৬ দিন সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্ম প্রাণ মুসলিম সৌদি আরবের পবিত্র ভূমি মাক্কাহ, আরাফাত ও মিনাতে উপস্থিত হয়ে (লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক … হে আল্লাহ আমি উপস্থিত ..) এই ধ্বনি দিয়ে হজ্ব পালন করে ।
” মানুষের নিকট হজ্জ্ব – এর ঘোষণা করিয়া দাও, উহারা তোমার নিকট আসিবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, ইহারা আসিবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম কোরিয়া (সূরা হজ্ব ২২:২৭) ।
“কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না উহাদের গোস্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া ( সূরা হজ্ব ২২:৩৭) ।”
নিজের সৎ রোজগার থেকে পশু কুরবানী দিয়ে নিজে খাওয়া ও গরিবদের দান করার (পবিত্র কোরানে) নির্দেশ দেয়া হয়েছে । এখানে পরোক্ষ ভাবে গরিবদের সাহায্যের কথা বলা হয়েছে । যাদের আল্লাহর প্রতি তাকওয়া বা ভয় ভীতি আছে, তারা নিজেরা সৎভাবে চলা এবং গরিব দুঃখীদের সাহায্য করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে । আজকের দুনিয়াতে ধনী – গরিবের মধ্যে যে তফাৎ রয়েছে, তা দূরীকরণের জন্য এই তাকওয়া অবলম্বন করা প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন । আমাদের মধ্যে তাকওয়া অবলম্বনকারীর অভাব রয়েছে যে জন্য এত দুর্নীতি দেখা দিয়েছে ।
হজ্বের পর প্রতিটি মুসলিম মদিনাতে জিয়ারতের উদ্যেশ্যে যায় ।শুধু তাই নয়, সেখানে হযরত মহম্মদ (সা: ) রওজা জিয়ারত, মসজিদে নববীতে নামাজ পড়া, জান্নাতুল বাকী, জংগে ওহুদ, মসজিদে কেবলাতাঈন যেখানে আল্লাহর হুকুমে কেবলা পরিবর্তন হয় এবং আরও অনেক নিদর্শন অবলোকন করে হাজিরা দেশে ফিরে । এই ঈদকে কুরবানীর ঈদ বলা হয় । সারা বিশ্বে এই ঈদে মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী পশু কুরবানী দিয়ে থাকে ।
আমাদের ছোট বেলার কথা, কুরবানী ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই মনে কেমন যেন একটা খুশির ইমেজ দেখা দিতো । বাবা ও চাচাদের সঙ্গে ঈদের হাঁটে যাওয়া এবং রং বেরঙের কুরবানীর গরু, ছাগল দেখে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী কিনে বাড়ি নিয়ে আসা হতো । গ্রামে প্রতিটি বাড়িতেই কুরবানী দেয়া হতো, কার গরু বা ছাগল কত বড়ো, কত স্বাস্থবান এ নিয়ে হতো একটা প্রতিযোগিতা ।
স্কুল ঈদের ছুটি, নাই কোনো পড়াশুনার চাপ । আগে থেকেই প্ল্যান করা কি ভাবে ঈদের ছুটি কাটাবো। বাড়ি এবং পারা পড়শী ছেলেরা একত্রে হৈ চৈ করে সময় কাটাই এবং সমবয়সী অনেকে মিলে ঈদের আনন্দে মেতে উঠি । বাবা- চাচা ছেলেমেয়ের জন্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের জামা কাপড় কিনে দিতো । নুতন জামাকাপড় পরে ঈদে এবং আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি যাবো কতই না আনন্দ ।
ঈদের দিন সকালে পুকুরে গোছল করে নুতন কাপড় পরে ৯-১০ টা বাজে জায়নামাজ নিয়ে ঈদগাহ ময়দানে গিয়ে উপস্থিত হতাম। সে সময় আমাদের এই ছোটো এনায়েতপুর গ্রামে একটি মসজিদ এবং একটি মাত্র ঈদগাহ ছিল । লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই গ্রামে বর্তমানে ৫টি মসজিদ এবং দুইটি ঈদগাহ হয়েছে।
ঈদগা মাঠে নামাজের শুরুতে সবার মুখে একত্রে “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়ালিল্লাহিল হামদ” সারা মাঠ মুসল্লিরা মুখরিত করতো । ঈদগাহ ভর্তি আপন লোকজন এবং সম বয়সী নামাজের শেষে বুকে বুক মিলিয়ে ঈদের খুশিতে মিলিত হইতাম । সে দিন কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে?
ঈদের নামাজের পর কার আগে কে গরু বা ছাগল কোরবানি দেবে এ নিয়ে হতো প্রতিযোগিতা । যে আগে কোরবানি দেবে তার “তাকওয়া” আগে আল্লাহর নিকট পৌঁছবে। কুরবানী মাংস আগে রান্না হবে এবং আগে আগে খাবে।
আমাদের মা চাচীরা আগে থেকেই রান্নার মশলা তৈরী করে রাখতেন । আজকালকার মতো রাঁধুনি, শান ও অন্যান্ন বাজারের রেডি মেড মশলা সে যুগে পাওয়া যেতো না। সব ধরণের মশলা ভাজি করে ঢেকিতে পাউডার করে আগে থেকেই তৈরী রাখা হতো। রান্না মাংসের রং হতো একটু কালো, কিন্তু অপূর্ব স্বাধ যেন আজও জিহ্বায় লেগে আছে। যে ঘরেই যাই ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে বাধ্যতামূলক ঈদের সুস্বাধু খাবার খেতে হবে ।
পরদিন নানা বাড়ি, খালু বাড়ি বা অন্যান্য আত্মীয়ের বাড়ি না গেলে তো ঈদ-ই হলো না। এর মধ্যে আত্মীয় স্বজন এসে ঈদের আনন্দে যোগ দিতো ।রান্না মাংস ও সুস্বাধু খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার নুতন করে রান্না নিয়ে মা চাচীরা রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকতেন ।
সুদীর্ঘ ৪০ বৎসর পার হয়েছে,মাবাবা এবং আপন জনদের অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন, আমার সেই বয়স, সে আনন্দ ও হারিয়ে গেছে ।
নাইজেরিয়া থাকাকালীন সময় ঈদের মাঠে গিয়ে নামাজ আদায় করে একই নিয়মে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও কুরবানী দিতাম। কানাডাতে ও তার ব্যতিক্রম নেই। আমরা নামাজ পড়ে ফার্মে গিয়ে কয়েকজন মিলে গরু বা ছাগল বা ভেড়া কুরবানী দিয়ে মহা উল্লাসে ঈদ উদযাপন করি। ফার্মে না গিয়ে ও এখানে হালাল মাংসের দোকানে কোরবানি দিয়ে থাকি। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে ও আমরা এখানকার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবে মিলে মিশে ঈদের আনন্দ করি।
১৯৯০ এর কথা, সে সময় টরোন্টোতে এতো মসজিদ ছিলো না ।আমার মনে পরে একবার ঈদের নামাজ পড়তে নিকটে কোনো মসজিদ না পেয়ে মাঠে নামাজ আদায় করে মুসল্লিদের সঙ্গে কোলাকোলি করেছি।তাছাড়া টরন্টো CNE তে সব চেয়ে বড়ো জমায়েত হতো এবং এখানকার বিশিষ্ট ডক্টর আব্দুল্লাহ হাকিম এর ইমামতিতে নামাজ পড়বো, সে তো অনেক আনন্দ ।
গত দুই বৎসর কোভিড-১৯ এর কারণে সারা দুনিয়াতে অৰ্থনীতিতে এসেছে স্থবিরতা। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্ত পয্যন্ত এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি মানুষ ভয় ভীতির মধ্যে বেঁচে আছে, কেউ স্বাভাবিক ভাবে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। এখানকার মসজিদ, মন্দির এবং গির্জা সবই লোকডাউনে রয়েছে। স্কুল কলেজ এবং উনিভার্সিটিতে অন লাইনে ছেলে মেয়েরা ক্লাস করে।
এবার দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের নামাজ পড়া যাবে । মসজিদ কমিটি সে ধরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে । তবে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে হলে আগে থেকে নাম রেজিস্ট্রি করতে হবে কারণ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হলে সব মুসল্লিকে একত্রে accommodate করা যাবে না । সব মসজিদেই একটির বেশি জমাত হবে যাতে সবাই ভিন্ন ভিন্ন সময় নামাজ আদায় করতে পারে ।
কোভিড-১৯ এর কারণে অফিসের কর্মচারীরা বাসা থেকে কাজ করে । দোকান পাট, গ্রোসারী করতে গেলে দূরত্ব বজায় রেখে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরতে হয় ।
কানাডার লোক সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি, অতি দ্রুত গতিতে করোনা ভ্যাক্সিন দেয়া হচ্ছে । সরকার চেষ্টা করছে যত দ্রুত ভ্যাক্সিন দেয়া শেষ করতে।
কিন্তু আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অবস্থা শৌচনীয় বিশেষ করে বাংলাদেশ যেখানে লোকসংখ্যা ১৮ কোটির কাছাকাছি।বিদেশ থেকে ভ্যাক্সিন আনতে হবে ।উন্নত দেশগুলি যারা ভ্যাক্সিন তৈরী করে নিজস্ব চাহিদা শেষ হওয়ার পর অন্য দেশে সরবরাহ করার প্রশ্ন উঠে ।
বাংলাদেশের সরকার এর ভয়াবহ অবস্থা উপলব্দি করলেও ভ্যাক্সিনের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে । গত দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে লোকডাউন চলছে। গরিব মানুষ, যারা দৈনন্দিন কাজ করে রুটির ব্যবস্থা করে ওরা কাজ না করলে কি অবস্থা হবে?
সারা পৃথিবীর অবস্থা দেখলে মনে হয় এই মহামারী সহসা বিদায় নেবে বলে মনে হয় না।
কিছু লোক এই ভয়াবহ করোনাকালীন(কোভিড–১৯) সময় ভ্যাক্সিন নিয়ে ও ব্যবসা করতেছে। এ সব লোক আল্লাহর তাকওয়া বা ভয় ভীতি থেকে দূরে সরে পড়েছে । হজ্ব (কুরবানী )এর নির্দেশাবলী অবলম্বন করে পরোপকারে এগিয়ে এসে দুনিয়া থেকে হিংসা বিদ্বেষ এবং দুর্নীতি দূর হবে, আজকার দিনে প্রতিটি মানুষের এই প্রত্যাশা হোক ।