শিক্ষা জাতিকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দেয় :
শিক্ষা যে কোনো জাতিকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার অন্যতম নিশ্চিত উপায়। শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার যা মানুষের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়। এটি আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রচারের অন্যতম শীর্ষ উপায়। আজ যেখানে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ শিশু স্কুলে যেতে পারে না,তাদের সে সুযোগ নেই। ” শিক্ষার সুযোগের অভাব দারিদ্র্যকে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত করার একটি প্রধান ভবিষ্যদ্বাণী। অন্য কথায়, শিক্ষা এবং দারিদ্র্য সরাসরি সংযুক্ত।” যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারকে প্রায়শঃই চিন্তা করতে হয় তাদের শিশুকে স্কুলে বা অন্যান্য মৌলিক চাহিদা (রুটি রোজগার) মধ্যে কোনটি সঠিক বেছে নিতে হয়। দরিদ্রতম পরিবারগুলির জন্য স্কুল ব্যয়বহুল, দুই বেলা খেয়ে বেঁচে থাকা প্রথম কাজ। শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হলে মৌলিক কাপড়,বই খাতা, পেন্সিল এবং সর্বোপুরি দুইবেলা খাবার ব্যবস্থা ঘরে থাকতে হবে। যে পরিবারে দুবেলা খাবার ব্যবস্থা নেই ,তার জন্য শিশুকে স্কুলে পাঠানো ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় না। কাজেই শিশুকে বাড়িতে বসে কাজ করতে বাধ্য হয় বা কাজ করার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া একটি দেশে যদি সরকারি পর্যাপ্ত স্কুল, সবার জন্য অবৈতনিক পড়ার ব্যবস্থা না থাকে, সে ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সুযোগ পেলে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে পড়াশুনা করে দারিদ্রের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। যাইহোক, মৌলিক শিক্ষার অভাব মানুষের পক্ষে স্বাবলম্বী হওয়া কঠিন করে তোলে এবং তাদের অদক্ষ, কম বেতনের চাকরিতে সীমাবদ্ধ করে। অতএব, সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষায় বিনিয়োগ করা জরুরী।
কানাডায় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি ছেলেমেয়ের জন্য উন্মুক্ত শিক্ষা এবং সমান সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া সরকারি কি বেসরকারি বা কলকারখানা,যেখানেই কাজ করুক না কেন ; বেতন স্কেল বাজারের সঙ্গে মিল করে রাখা হয়েছে যাতে প্রতিটি মানুষ খেয়েদেয়ে মোটামোটি বাঁচতে পারে। এ দেশে যে যাই কাজ করুক না কেন, কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে না, তুমি কি কাজ করো ? কাজের জন্য কেউ কাউকে হেয় করে দেখে না বা সমালোচনা করে না। অনেক সময় দেখা যায় যারা বেশি পরিশ্রম করে, তারাই অল্প সময়ে বাড়ি গাড়ি কিনে প্রতিষ্ঠিত হয়। কানাডা সরকার সে ভাবেই দেশের নিয়ম কানুন তৈরী করেছে। এই সমস্যা আমাদের তৃতীয় বিশ্বে রয়েছে যার ফলে মানুষ মানুষে পার্থক্য দেখা যায় । আমরা বসকে স্যার বলে সম্ভোদন করি; কিন্তু এ সব দেশে স্যার বলতে কিছু নেই , ” জো হুকুম জাঁহাপনা ” নেই।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এর ব্যাতিক্রম, না আছে পর্যাপ্ত পরিমান স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি, না আছে সু-শিক্ষিত টিচার যারা ছেলেমেয়েদের সু-শিক্ষা দেবে। তাছাড়া সব শিশুরা স্কুলে গেলে বসার ব্যবস্থা দেয়া যাবে না। আমি যে প্রাথমিক স্কুলে পড়তাম,তা লম্বা দোচালা টিনের ঘর, মুলির বেড়া, কাঁচা ভিটি,প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা মাটিতে হোগলার উপর বসতো। মাস্টারগণ বেত ছাড়া ক্লাসে আসতো না। ঝড়ের দিনে স্কুলের ছালা ও বেড়া উড়িয়ে নিয়ে যেত। কয়েকবার ক্লাসরুমে সাপ এসেছে ; ভয়ে চিৎকার করে ক্লাস থেকে বের হয়েছি। আমার গ্রামের ১০% ছেলেমেয়ে স্কুলে যেত ; ১% মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতো। শিশু ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে ক্ষেতে-খামারে কাজ করে মাবাবাকে সাহায্য করতো ।
আমার আজ ও মনে পড়ে আমার ছোটবেলার স্কুল জীবনের কিছু কাহিনী। আমি পড়াশুনায় মোটামোটি ভালো ছিলাম, আমার চারিপাশে শিক্ষার কোনো পরিবেশ ছিল না। গ্রামের ৯০% ছেলেমেয়ে স্কুলে না গিয়ে কাজ করে মাবাবাকে ও পরিবার পরিজনকে সাহায্য করতো। আমি ছেলেমেয়েদের মাবাবাকে বলতে শুনেছি , ” আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দরকার নেই। আবার কেউ কেউ স্কুলে গেলে ও বাড়িতে পড়াশুনার কোনো পরিবেশ ছিল না বিধায় ভালো করে নি । অনেকেই প্রাথমিক স্কুলের ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শেষ করলেও উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি হতো না; আমাদের থানায় (উপজেলায়) ৫টা উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ছিল, পায়ে হেঁটে বা নৌকা করে অনেক দূরে যেতে হতো। যারা পরের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করতে পারতো, তারাই ভর্তি হতো। মেয়েদের পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব ছিল না বা মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে পড়াশুনা করবে ? মেয়েদের বেলায় ১০০ % -৫ম শ্রেণী পর্যন্ত না গিয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়তো। বৈশাখ,জ্যৈষ্ঠ বা অসাড় মাসের শুরুতেই অবিরত বৃষ্টির ফলে খাল বিল, মাঠঘাট ভরে যেত ; গ্রামে মেঠো পথ বা রাস্তা বলতে যা আছে তাও বৃষ্টির পানিতে ভরে যেত, নৌকা ব্যাতিত স্কুলে যাওয়া যেত না।
এই পরিস্থিতি শুধু আমাদের তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় ছিল না ; এই সমস্যা অতীতে এবং আজ ও পৃথিবীর বহু দেশে আছে। বিশ্বব্যাংক এবং ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলির ৫৩ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশুনা শেষে একটি সাধারণ গল্প পড়তে এবং বুঝতে পারে না। এই হলো আমাদের অনুন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
২
সিরিয়ার ঘরোয়া যুদ্ধ এবং বর্তমান পরিস্থিতি :
এরিস্টটলের মতে ” যেখানে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র, সেখানে গণতন্ত্র চলে না ; তার কারণ দরিদ্র অশিক্ষিত লোক গণতন্ত্রের অর্থ বুঝবে না। দরিদ্ররা দৈনন্দিন ভাত -কাপড়ের চিন্তায় মগ্ন, নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে ব্যাস্ত , কী ভাবে দেশের অর্থনীতির চাকা চলে, সে সম্পর্কে অজ্ঞ; “কামারের দোকানে ধর্মের আলোচনা করার মতো। ”
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ভোটের কারচুপি, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, যোগ্যতা নিয়ে তো লড়াই করে না; ক্ষমতায় কে যাবে এ নিয়ে লড়াই। এ সব দেশে এক জাতীয় শিক্ষিত চতুর লোক জনগণকে ধোকা দিয়ে অসদুপায়ে ক্ষমতা নিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। অধিকাংশ দেশগুলিতে দেখা যায় ভোটার কারচুপি, ব্যাঙ্ক থেকে অসৎ উপায়ে অর্থ নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে দেশকে দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখায়।
সিরিয়ার হাফেজ আল-আসাদ ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা, বিপ্লবী নেতা ও রাজনীতিবিদ যিনি ১২ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১০ জুন ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিরিয়ার ১৮ তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আসাদ মৃত্যুর পর্বে তাঁর ছেলে বাসার আসাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার সব ধরণের কায়দাকানুন শিখিয়ে গিয়েছিলেন যাতে কোনো শত্রু/মিত্র চিনে দেশ পরিচালনা করতে পারেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে নিশ্চিত করেছিলেন , তাঁর ছেলে বাশার একটি অনুগত সামরিক বাহিনী উত্তরাধিকার সূত্রে পায়; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুগত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরী করেছিলেন তাঁর পরবর্তীতে রাজবংশ সঠিক ভাবে টিকে থাকে। সে থেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হয় নি; এই ১২ বৎসরের গৃহ যুদ্ধে দেশের ক্ষতি যতটুকুই হোক না কেন , তাঁকে শাসন ব্যবস্থা থেকে সরাতে পারে নি। এতেই প্রমাণিত হয় যে তাঁর বাবা মৃত্যুর পূর্বে একটি আনুগত্য সরকার এবং সামরিক বাহিনী রেখে গেছেন।
সিরিয়ার বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধের প্রায় তেরো বৎসর, দেশটি প্রায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং গভীরভাবে বিভক্ত, ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট , সীমিত রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং বিশ্বের বৃহত্তম বাস্তুচ্যুত সংকটের মুখোমুখি, যেখানে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের এখন মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। এই দেশে গৃহযুদ্ধের ফলে ৫থেকে ৬ লক্ষ লোক বা তার ও বেশি এ যাবৎ মারা গেছে। ৬ থেকে ৭ মিলিয়ন লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য দেশের বিভিন্ন অংশে, ৫ মিলিয়ন বা তার ও অধিক প্রতিবেশী দেশ, ইউরোপ,আমেরিকা বা কানাডায় আশ্রয় নিয়েছে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণগুলি জটিল এবং বহুমুখী, তবে কিছু প্রধান কারণ হ’ল:
ক) ১৯৭০ সাল থেকে হাফেজ আসাদ রাজনৈতিক নিপীড়ন ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা শুরু করেন । তিনি সেনাবাহিনী, সচিবালয় আমলাতন্ত্র এবং সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশ শাসন করেন। সুন্নি মুসলমান ৭৪% হওয়া স্বত্তে ও তাঁর শাসনামলে সব ধরণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। তাছাড়া শাসন ব্যবস্থা নিজের পরিবারে মধ্যে রাখার জন্য উত্তরসূরি পুত্র বাসার আসাদকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ঠিক ঠাক মতো ব্যবস্থা করেন। তাঁর আমলে শিয়া সুন্নি অসন্তোষ চরমে পৌঁছে; তবে গৃহ যুদ্ধ বাঁধে নি ।
খ)) সুন্নি (৭৪% )সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শিয়া ১৩ %(আলাউই ১২%,১% ইসমাইলিয়া ) সংখ্যালঘুদের মধ্যে মতাদর্শ এবং সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পার্থক্য বহুদিনের । সুন্নি এবং শিয়া মতপার্থক্য মুহাম্মদ (সা: ) এর মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকে গত ১৪ শত বৎসর চলে আসছে যার কোনো সমাধান আজ ও হয় নি। বাসার পরিবারের শাসনামলে সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিমরাই রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী; অফিস , বড়ো বড়ো ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ওদের প্রাধান্য যার দরুন শিয়া সুন্নীর মধ্যে অনেকদিনের অসন্তোষ দানাবেঁধে ছিল।
গ) খরা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অসম অর্থনীতি যা অনেক সিরীয়দের জীবনযাত্রার অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলে । সিরিয়ার খরা, যা ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, দেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং সমাজের উপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছিল। খরার ফলে ফসল নষ্ট হয়, গবাদি পশুর মৃত্যু , খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং গ্রামের জনগণ শহরের দিকে ধাবিত হয়। এই কারণগুলি সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত করে । তাছাড়া বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে ; ছাত্র- ছাত্রীরা পড়াশুনা শেষ করে বেকার; দেশের জনগণের দৈনন্দিন রোজগার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সঙ্গে বৈষম্য দেখা দেয়।
ঘ ) আঞ্চলিক ও বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপ এবং সমর্থন :সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদেশী সম্পৃক্ততা, সংঘাত, হস্তক্ষেপ এবং সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ । সিরিয়ার পরিস্থিতি জটিল ও বহুমুখী। যদিও বিদেশী হস্তক্ষেপ সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এটি একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্যতা , রাজনৈতিক দমন এবং ঐতিহাসিক অভিযোগ। শিয়া বনাম সুন্নি দমন নীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এ সমস্যা চলে আসছে । ইরানের শিয়া সরকার সিরিয়ার সংখ্যালঘু সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য হেজবুল্লাহ বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে । এ ছাড়া দেশ অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক দমননীতির ফলে গৃহযুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে ।
চ) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় দমন, সহিংসতা ও হস্তক্ষেপ আর একটি কারণ । সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী ও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ব্যাপক। স্বৈরশাসক বাশার আসাদের সরকার ২০১১ সালের গণতন্ত্রপন্থী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে নৃশংসভাবে দমন করতে গিয়ে গৃহ যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। গত ১২ /১৩ বছরে হাজার হাজার বিরোধীদের কারারুদ্ধ , নির্যাতন এবং হত্যা করেছে বলে অনেক অভিযোগ রয়েছে। বিদেশিরা সরাসরি সরকার এবং শিয়া-সুন্নিকে অস্ত্র দিয়ে পরস্পর বিরুধী সংঘর্ষ, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ করে বলে জানা গেছে।
সিরিয়ার পুরা দেশ আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, এখন পর্যন্ত ১২% (ইদলিব,উত্তর আলেপ্পো, তাল আবিয়াদ এবং রাস আল-আইন ) অঞ্চল বিরুধীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে । প্রতিনিয়তই এখানে যুদ্ধ ,আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশ থেকে ও আক্রমণ হচ্ছে, সারা দেশেই ক্ষণে ক্ষণে বম্বিং, রকেট হামলা চলছে। বিদেশী শক্তিগুলির মধ্যে ইরান,রাশিয়া, তুরস্ক এবং আমেরিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি পুরা দেশকে সংঘাতময় করে তুলেছে।
৩
ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর) এর মতে ‘ সিরিয়া এ সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক ও শরণার্থী সংকট। ” এ বৎসরের ফেব্রুয়ারির দিকে দক্ষিণ-পূর্ব তুরকি এবং উত্তর সিরিয়ায় দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এবং এই অঞ্চলজুড়ে বাড়িঘর ও অবকাঠামোর অবর্ণনীয় ক্ষতি হয় । অভ্যন্তরীণভাবে ও বাস্তুচ্যুত সিরীয় শরণার্থীদের করুন অবস্থা, হাজার হাজার আশ্রয়স্থল ধ্বংস এবং কয়েক লক্ষ শরণার্থী বিপদগ্রস্থ, “মরার উপর খাঁড়ার ঘা “, এক বিপদের উপর এর এক বিপদ দেখা দিয়েছে ।
সিরিয়া সংকট যখন দ্বাদশ বছরে প্রবেশ করছে, তখন মানবিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন এবং জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত রয়েছে – প্রতিবেশী দেশগুলিতে বসবাসকারী কয়েক মিলিয়ন শরণার্থী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে । বাস্তুচ্যুতদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি নারী ও শিশু।
৪
সংঘাত, নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সহিংসতার ফলে বিশ্বব্যাপী ১০০ মিলিয়ন বা তার ও অধিক মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে । সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও মায়ানমার বাস্তুচ্যুত মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ ; বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪২ শতাংশই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
বছরের পর বছর ধরে, সিরিয়ানরা অসাধারণ ধৈর্য দেখিয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ অব্যাহত থাকার সাথে সাথে আশা দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সিরিয়ার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। লেবাননে বহুদিনের অভ্যন্তরীণ গৃহ যুদ্ধ, ইসরাইলের সঙ্গে সংঘর্ষ ; তদুপুরি সিরিয়ার ১৫ লক্ষ শরণার্থী যা দেশের অর্থনীতিকে চেলেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হুমকি, এর অনুপস্থিতি এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার ফলে পৃথিবী ব্যাপী ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছে । আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশে অযোগ্য স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার লোভ বা প্রবণতার ফসল এই সমস্যা। কোনো নেতা বা নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে শত শত কেস দিয়ে বাকরুদ্ধ করে ;রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে ধরে নিয়ে পুরা পরিবারকে আতঙ্কে ফেলবে ও বিনা বিচারে বৎসরের পর বৎসর জেলে রেখে দেবে।
সমাপ্ত