মানবিকতা একটি শব্দ যা সব মানুষেরই কম বেশি আছে আর তাই সারা পৃথিবী আজ বাঁধা পড়ে আছে একসূত্রে, শুধুমাত্র মানবিকতার টানে। করোনা ভাইরাস বা কভিট–১৯ সারা পৃথিবীর মানুষকে একত্রিত করেছে শুধুমাত্র মানবিকতা দিয়ে। আর এক্ষেত্রে কাজ করেছে শুধু একটি ধর্ম, মানবধর্ম। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আস্তিক, নাস্তিক, সাদা, কালো, ধনী, দরিদ্র, আমেরিকা, চায়না, উন্নত দেশ, অনুন্নত দেশ, নারী–পুরুষ, যুবক– বৃদ্ধ নির্বিশেষে আমরা সবাই মানুষ। আমরা সবাই একই বিশ্বের একই বাতাসে এখনো শ্বাস–প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি; মৃত্যু হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। করোনা ভাইরাস যেকোনো মুহূর্তে কেড়ে নিতে পারে আমাদের যে কারো প্রাণ।
কানাডাতে করোনার এই মহা দূর্যোগের সময় আমাদের ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল এবং লোকাল গভমেন্ট যেমন কানাডিয়ান সিটিজেন এবং পার্মানেন্ট রেসিডেন্টদের স্বাস্থ্য এবং আর্থিক সূযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুন্। তেমনি আমরাও কমিউনিটির পক্ষ থেকে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি সাধ্যমত । বিপাকে পড়েছে আমাদের এখানকার ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং রেফিউজি ক্লেইমেন্টরা। নিয়ম নীতির ছকে পড়ে তাঁরা গভমেন্টের সুযোগ সুবিধাগুলো তো পাচ্ছেই না বরং ভীষণ মানবেতর জীবন যাপন করছে। এঁরা প্রচন্ড আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়েছে। এরা যেসব পার্ট টাইম জব করতো তার সবই মোটামুটি বন্ধ। আমাদের অনেকেরই ধারণা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা সবাই ধনীর দুলাল, ওদের সম্পূর্ণ খরচ দেশ থেকেই আসে। আসলে কিন্তু তা নয়, অধিকাংশ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট তাদের মা-বাবার জমানো টাকা আর ধার দেনার টাকায় এখানে আসে এবং এখানে কাজ করেই তাদের খরচের অনেকটাই চালাতে হয়। রেফুজিদের সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা – রেফুজিরা দেশে অনেক টাকার মালিক, এখানে মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে রেফিউজি ক্লেইম করে। এই ধারণাটিও সঠিক নয়। কানাডা ঐতিহাসিক ভাবেই রেফুজিদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং কানাডা রেফুজিদের অবদানের কথা সবসময়ই স্মরণ রাখে এবং তাদের মর্যাদা কানাডাতে সব সময়ই সমুন্নত। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা যেমন একদিকে কানাডার জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার উৎস তেমনি ভাবে আজকের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা কালকের যোগ্য পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট। রেফিউজি এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা কানাডার শ্রম বাজারেও বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং কানাডার অর্থনীতিকে সচল রাখে।
ইউনিভার্সিটির ডর্ম এবং ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার পর, বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য যে বড়ো অংকের ডিপোজিট দিতে হয়, তা অনেক ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদেরই নেই, অনেক রেফিউজি ক্লেইমেন্টদেরও নেই – বাড়িওয়ালা হিসাবে এই মুহূর্তে আপনি এই ডিপোসিট নেবেন না, আপনার পরিবারের খাবার ওদের সঙ্গে শেয়ার করুন, পারলে তাঁদেরকে আর্থিক ভাবেও সাহায্য করুন – সেটিই তো আসল ধর্ম, আসল মানবতা, প্রকৃত কানাডিয়ান এর মতো কাজ। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং রেফুজিদের হেলথ ইন্সুরেন্স এর মাধ্যমে ডাক্তার দেখাতে হয় – খোঁজ নিন তারা সুস্থ আছে কিনা, প্রয়োজনে ডাক্তার দেখাতে পারছে কিনা, ঔষুধ কিনতে পারছে কি না।
রেফিউজি এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের কেও বাসা ভাড়া দিতে চায় না; বিশেষ করে করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে ওঁদেরকে নতুন করে তো কেউ বাসা ভাড়া দিতেই চাচ্ছে না, বরং বিভিন্ন অছিলায় ওদেরকে বাসা ছেড়ে দিতে বলছে। আমার প্রতিবেশী এক বাড়িওয়ালা , দুটি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট মেয়ে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে আসলে তাদেরকে করোনা সংক্রমণের ভয়ে উঠতে দেয় নি। তারা কোথায় থাকবে একবার উনি ভাবলেন না। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের অধিকাংশ ডরমিটরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তাদের দেশেও করোনা পরিস্থিতি ভালো না, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট বন্ধ, আমরা বাসা ভাড়া না দিলে ওরা যাবে কোথায়? আপনার সন্তানের ক্লাসমেট, আপনার দূরের আত্মীয় যারা এখানে আটকে পড়েছে, যাদের থাকার জায়গা নেই, যাদের জব নেই, দেশ থেকেও টাকা আসা বন্ধ, যেসব রেফিউজি এখনো ক্লেইম করে উঠতে পারেনি, তাঁদেরকে সাহায্য করুন।
আমাদের বুঝতে হবে রেফিউজি ক্লেইমেন্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা আমাদের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে এদেশে নতুন। এঁরা সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশ, নতুন একটি সংস্কৃতি এবং নতুন আবহাওয়ার মধ্যে এসে পরিবার পরিজনদের থেকে দূর পরবাসে ভীষণ একাকিত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আর তাই এদের জন্য আমাদের সহমর্মিতা আর সহযোগিতা থাকতে হবে অনেক বেশি। এদের ইমিগ্রেশন স্টেটাস নিয়ে প্রশ্ন করে তাদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে না দিয়ে আসুন আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠি, সত্যিকারের কানাডিয়ান হয়ে উঠি, তাঁদেরকে আমাদের সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা করি। কানাডিয়ানদেরকে অন্য দেশ থেকে বিশেষ বিমান দিয়ে, প্লেন ভাড়া দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে- বলা হচ্ছে না যে তোমরা তোমাদের জন্মভুমিতেই থেকে যাও, দল মত ভুলে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এবং সরকার তার জনগণকে কি ধরনের সহযোগিতা করছে দেখুন, এপর্যন্ত কত রেফিউজিদের কানাডা তার বুকে স্থান দিয়েছে, কত ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এখানে স্থায়ী হয়েছে, কানাডা এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যকে পিছনে ফেলে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের স্বপ্নের দেশ হয়ে উঠেছে। তাই আসুন আমরাও প্রকৃত কানাডিয়ানদের মতো মহানুভব হই, মানুষ হই, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং রেফুজি সহ সকলের প্রতি প্রতি আরো বেশি মানবিক আচরণ করি।
করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে অনেক ফোন এবং ইমেইল পাচ্ছি, ভিসিটর ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা, সুপার ভিসা, এপ্লিকেশন, এক্সটেনশন, রেফিউজি ক্লেইম ইত্যাদি বিষয়ে। অনেকেই ভাবছেন এইসময়ে সব কাজকর্ম হয়তো বন্ধ, অনেকেই আউট অফ স্টেটাস হয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। ভিসা এবং ইমিগ্র্যাশন সংক্রান্ত সব কাজ ই কিন্তু অনলাইনে চলছে- এমনকি রেফিউজি ক্লেইম ও কিন্তু আমি অনলাইনএ করছি। আর তাই আপনাদের সবার কাছেই বিনীত অনুরোধ, উইল , ভিসা এক্সটেনশন, রেফিউজি ক্লেইম সহ যেকোনো ইমিগ্রেশন সেবার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন, আমি নামমাত্র মূল্যে ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশনের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে এইসব সেবা অনলাইনে করে দেব, আমার রিপ্রেসেন্টেটিভ পোর্টাল থেকে।
ভ্যালু থাকুন সবাই, দেশে বিদেশ যেখানেই থাকুন। ঘরে থেকেই আমরা সারা বিশ্বে সবার জন্যে আমাদের সাহায্যের হাত বাড়াই , আমরা সবাই আলাদা থেকেই একত্রিত থাকি। জয় হোক মানুষের, জয় হোক মানবতার।
মাহমুদা নাসরিন , আরসিআইসি , কমিশনার অফ ওৎস, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী। , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, [email protected], টরেন্টো, কানাডা