-মোঃ মনিরুজ্জামান
এ বছর আমরা ক্যাম্পিং এ গিয়েছিলাম ‘POG LAKE CAMPGROUND’-এ। অন্টারিও প্রভিন্স তথা সারা বিশ্বে সামার টাইমে যারা ক্যাম্প করে থাকেন তাদের কাছে ALGONQUIN এর বিশাল জঙ্গল এলাকায় অবস্থিত ক্যাম্পগ্রাউন্ড গুলি অত্যান্ত জনপ্রিয়। ১৪ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ছয়টি পরিবারের মোট ২৫ জন সদস্য এ বছর ক্যাম্পিংয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিবারের সদস্যরা সবচাইতে এ বছর বেশি বেশি আনন্দ উপভোগ করেছে। কারণ এবার আমাদের সাথে বাংলাদেশ থেকে আগত আমার ছোট ‘ব্রাদার –ইন –ল‘ও তার পরিবারসহ আমাদের সাথে ক্যাম্পিং এ গিয়েছিল। সেই সাথে ছিল আমার ছোট ভাই মুকুল ,আমার স্ত্রীর কাজিন হাফিজ সাহেব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমলের আমার এক বন্ধু মনজুর ও আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধুবান্ধব ও তাদের পরিবার।
প্রতি বছর ক্যাম্পিং এ আমরা প্রচুর আনন্দ উপভোগ করে থাকি। এবারও তার বাতিকক্রম ছিল না। ক্যাম্পিংয়ের দ্বিতীয় দিনে টরন্টো থেকে হাসান ভাই টেক্স করে আমাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানান ও ক্যাম্পিংএর উপর প্রবাসী ব্লগের জন্য লেখা দিয়ে বলেন। পরবাসী ব্লগের একজন “কর্তাব্যাক্তি” আমাদের সাথে এবারের ক্যাম্পিংয়ে আছেন। আমি ক্যাম্পিং থেকে ফেরার পর অপেক্ষা করছিলাম যে তিনি হয়তো কোন লোখা দেবেন। কিন্তু তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হলেও তার কোন লেখা না দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই হাসান ভাইয়ের অনুরোধ রাখতে ক্যাম্পিংয়ের উপর কিছু লেখার উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রতি বছর ক্যাম্পিংয়ের সব আয়োজন আমার ছোট ভাই করে থাকে। তার সু–দক্ষ ব্যাবস্থাপনায় আমরা ১৪ জুলাই সকাল ১০টায় আমরা টরন্টো থেকে রওয়ানা করে অসোয়ার একটি টিম হর্টনে মিলিত হই। সেখান থেকে বেলা ১১ টায় একত্রে আমরা রওয়ানা করি। হাফিজ সাহেবের পরিবার বিকালে আমাদের সাথে বিকালে মিলিত হবে ক্যাম্প গ্রাউন্ডে। হান্টসভিলের একটি মলের ফুডকোর্টে আমাদের দ্বিতীয় ব্রেকে আমরা দুপুরের লাঞ্চ করে আবার যাত্রা শুরু করি। হাইওয়ে ৬০ এর নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা ঘন্টা খানেক পরে পগ লেক ক্যাম্প গ্রাউন্ডে যখন পৌঁছাই তখন বিকাল ৪টার বেশি বেজেছে। ক্যাম্প অফিসে রেজিস্ট্রেশন ও অন্যানো আনুষঙ্গিকতা সেরে ক্যাম্প সাইটে টেন্ট সেট করে রাতের খাবারের আয়োজনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। প্রথম দিনের ডিনারের আয়োজন আমরা ও আমার বন্ধু মনজুরের পরিবারের ভাগে পড়েছে। ডিনারের আয়োজনের ফাঁকে ইতোমধ্যে হাফিজ সাহেব তার সুযোগ্য ও কর্মঠ স্ত্রীসহ এসে পড়েন। আমরা সমস্বরে ও সাড়ম্বরে তাদের অভ্যার্থনা করি। তিনি আসার পরে ক্যাম্পের পরিবেশ যেন আরো আনন্দমুখর হয়ে উঠল। খাবার পরে ক্যাম্প ফায়ারের সময় হাফিজ সাহেব ও মনজুরের অনবদ্দ্য জোক ও কৌতুকের মাধ্যমে আমরা প্রথম দিন অতিবাহিত করে যার যার টেন্টে ঘুমাতে গেলাম।
পগ লেক ক্যাম্প সাইটে রাতের ক্যাম্প ফায়ারের একটি ছবি:-
দ্বিতীয় দিনে আমাদের কর্মসূচি ছিল ‘নর্থ বে‘ এয়ার ফোর্স মিউজিয়াম পরিদর্শন ,লেক নিপিশিং এর বিচে স্নান ও ফেরার পথে ডোয়াইট বিচ পরিদর্শন এবং সেখানে ‘বার বি কিউ‘ ও রাতের ডিনার। সবাই এক সাথে আমরা নর্থ বে রওয়ানা করলাম বেলা সাড়ে ১০টার সময়।আমাদের ক্যাম্প থেকে নর্থ বে দুইশত কিলোমিটারেরও বেশি। যাবার পথে আমরা হান্টসভিলে একটি ব্রেক নিলাম। হাফিজ সাহেব ও আমি সকলের আগেই নর্থ বে রওয়ানা দিলাম। বাকিদের নিয়ে আমার ভাই মুকুল আস্তে আস্তে আসবে। কারণ কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আবার খুঁজে পেতে সময় নষ্ট হবে। অনেকেরই এদিকের পথ ঘাট সম্পর্কে ধারণা নাই।
এখানকার এয়ারফোর্স মিউজিয়াম একটি ছোট মিউজিয়াম। তবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় থেকে বিভিন্ন সময় কি ধরণের বিমান ও যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সে বিষয়ে এখন থেকে অনেক তথ্য জানা গেল। হাফিজ সাহেব তার বোনদের নিয়ে (আমার স্ত্রী ও শ্যালিকা) মিউজিয়ামে এয়ারফোর্সের পোশাক পরে বিভিন্ন এঙ্গেলে প্রচুর ছবি তুললেন । পরে সেগুলি দেখে সবাই বেশ মজা করেছিল । আমি অবশ্য পরে ফেসবুকে এ সব ছবি দেখেছি।
নর্থ বে এয়ারফোর্স মিউজিয়ামের সামনে হাফিজ সাহেবের একটি দুর্দান্ত ছবি:-
নর্থ বে মিউজিয়াম দেখে সবাই লেক নিপিশিং এর দিয়ে রওয়ানা দিলাম। অন্টারিও প্রভিন্সের নর্থ এলাকায় লেক নিপিশিং সবচেয়ে বড় লেক। সেখানে দেখলাম বিশাল বিস্তৃত লেকের পাড়ে প্রচুর জনসমাগম। তবে তীরের কাছে লেকের পানি খুব একটা পরিষ্কার নয়। ছোট বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে গেল। আমরা অবশ্য তাদের আশস্ত করলাম দুপুরের লাঞ্চের পর তাদেরকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও লেকের পানিতে নামতে দেয়া হবে।
পার্কিং লটের অদূরে একটি বড় গাছের নিচে আমরা দুটি পিকনিক টেবিল দখল করলাম। ভাবিরা দুপরের লাঞ্চের আয়োজনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আমরা কেউ কেউ বিচের বিভিন্ন দিকে হাঁটতে গেলাম। হাফিজ সাহেব একজন সুদক্ষ ক্যামেরাম্যান। তিনি বিচের বিভিন্ন দৃশ্য,লাঞ্চের আয়োজন ও বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলী তার ক্যামেরায় ধারণ করেন। তার কিছু কিছু আমরা ইতোমধ্যে ফেসবুকে দেখেছি। এদিকে আমার শ্যালিকা ও ব্রাদার -ইন-ল’ও নিজ নিজ ক্যামেরা ও সেলফোনে প্রচুর ছবি ধারণ করেছে। আমার শ্যালিকা ফটোগ্রাফির উপর বিশেষ কোর্স করেছে এবং তার তোলা ছবিও অসাধারণ। আমার ব্রাদার -ইন- ল খোকনকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানালো ,আমাদের এ ক্যাম্পিং তার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। বাংলাদেশে তাদের এ ধরণের চিত্ত বিনোদনের তেমন কোন সুযোগ হয় না। তাই এসব স্মৃতি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এক সময় ভাবীদের কাছ থেকে খাবারের আমন্ত্রণ এলো। সকলে বেশ মজা করে দুপুরের লাঞ্চ করে গাছের নিচে বসে অনেক্ষন কাটালাম। ঐদিনের আবহাওয়া খুবই চমৎকার ছিল। ক্যাম্পিংয়ে এসে আবহাওয়া ভালো পেলে ক্যাম্পিংয়ের আনন্দ দ্বিগুন বেড়ে যায়। আমরা আবার সে সুযোগ পেয়ে তার যথাযথ সদ্ব্যাবহার করেছি। লাঞ্চের পর মুকুল ও টোকন ভাই বাচ্চাদের নিয়ে বিচের পানিতে নামতে গেল। আমার ছেলে ও মনজুরের ছেলে মাছ ধরতে গেল। আর আমার শ্যালিকা তার ছেলেকে নিয়ে বিচ ও তার আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আমরা কয়েকজন গাছের নিচে বসে হাফিজ সাহেব ও মনজুরের চুটকি ও জোক শুনে হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। জোক বলতে এদের জুড়ি নাই। বিশেষ করে হাফিজ সাহেবের জোকের স্টক যেন অফুরন্ত।
ছবি:- ভাবিরা সবাই লেক নিপিশিং এর একটি গাছের ছায়ায় দুপুরের লাঞ্চ আয়োজনে ব্যাস্ত
বিচ থেকে অন্নান্য সবাই ফিরে আসলে আমরা ডোয়াইট বিচের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।এবার আমি ও হাফিজ সাহেব আগেই বেরিয়ে আসলাম। আমরা ডোয়াইট বিচে এসে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছি। ডোয়াইট বিচটি ‘লেক অফ বে ‘ এর উল্লেখযোগ্য বিচ। বিচটি খুব বড় না হলেও পরিষ্কার পানি ও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। ছেলেরা ইতোমধ্যে ডোয়াইট বিচের পানিতে নেমে গেছে। বাকি সবাই এসে পড়লে অনেকে এখানে পানিতে নামল এবং কেউ কেউ বিচের আসে পাশের ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। মুকুল ,শামীম লেকের পাড়ে “বার বি কিউ”র আয়োজন শুরু করল। বার বি কিউ এবং রাতের খাবার শেষ করে আমরা পগ লেকে আমাদের ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। রাতে খাবার ইতোমধ্যে শেষ হলেও ভাবিরা আমাদের চা ও তরমুজ পরিবেশন করল। ক্যাম্প ফায়ার শুরুর সাথে সাথে হাফিজ সাহেবের জোকের ভান্ডারও অবমুক্ত হল। মনজুরও তার সাথে যোগ দিল। জোকের পর্ব শেষ হলে মনজুর ও আমি ও হাফিজ সাহেব কিছুক্ষন ক্যাম্প গ্রাউন্ডের চারিদিকে হাটাহাটি করে এলাম। এ ভাবেই গভীর রাত পর্যন্ত আমরা অত্যান্ত আনন্দঘন সময় কাটিয়ে টেন্টে ঢুকলাম।
পরদিন আমাদের কর্মসূচিতে ছিল সকালে আলগোনকুইন ইস্ট গেটে ভিজিটর সেন্টার ও মিউজিয়াম পরিদর্শন ও দুপুরে লেক এবং অপেঙ্গা’তে ক্যানোয়িং ও সংলগ্ন আলগোনকুইন আউটফিটে গিফট আইটেম বা অন্যানো সামগ্রী কেনাকাটা। ঐ দিনের আবহাওয়া কিঞ্চিৎ বৃষ্টিবহুল থাকলেও আমরা যথা সময়ে ভিজিটর সেন্টারে পৌছালাম। অবশ্য, হাফিজ সাহেব তার পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক মুসকোকোর বৃহৎ লেকে ক্যানোয়িং করতে চলে গেলেন। আমরা ভিসিটর সেন্টারের মিউজিয়াম ঘুরে দেখলাম এবং আলগোকুইনের প্রাচীন জীবনযাত্রা ও জীবজন্ত সম্পর্কে ধারণা পেলাম। দুপুরের আগেই আমরা অপেঙ্গা লেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। অপেঙ্গা লেকটি বিশাল এবং পানি পরিষ্কার। তবে এখানে বিচের পানিতে নামার সুযোগ নাই। শুধু ক্যানোয়িং করা যাবে। আমরা তিনটি কেনো ভাড়া নিলাম এবং অনেকেই পর্যায়ক্রমে কেনোকরে লেকের অনেকদূর পর্যন্ত ঘুরে এলাম। অনেকে আলগোনকুইন আউটফিটে ঘুরে সময় কাটাল। ছেলেরা ও মেয়েরা কেউ কেউ মাছ ধরে সময় পার করল। দুপুরের খাবারের জন্য আমরা ক্যাম্পে চলে আসলাম বিকাল সাড়ে তিনটায়। খাবার পর আমরা ‘লেক অফ টু রিভারে’র একটি বিচে গেলাম। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। ছেলেমেয়েরা এখানে বিচের পানিতে নেমে অনেক্ষন আনন্দ-ফুর্তি করেছিল। এক সময় হাফিজ সাহেব ফিরে এলেন তার কোনোয়িং শেষে। তিনি ফেরার পথে আলগোনকুইনের বিখ্যাত প্রাণী ” মৌজ ” দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তার একাকী ভ্রমণ সফল বলে তিনি জানালেন।সন্ধ্যার পরে আমরা ক্যাম্পে ফিরে এসে যথারীতি ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করলাম। অবশেষে এক সময় রাট গভীর হলে যার যার টেন্টে গেলাম।
হাইওয়ে ৬০ এর পাশে হাফিজ সাহেবের দেখা “মুজ “এর একটি ছবি:-
পরদিন আলগোনকুইনের এই ছোট্ট ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমাদের শেষ দিন। সকালের ব্রেকফাস্ট শেষে সকলে টেন্ট গোছানো শুরু করলাম। সব কিছু গোছগাছ সম্পন্ন হলে আমরা বেলা বারোটার দিকে রওয়ানা দিলাম। ফেরার পথে আমাদের হান্টসভিলে জি -৮ সামিট সেন্টার ও সংলগ্ন লেগুনা পরিদর্শন করার প্ল্যান আছে। আমরা হান্টসভিলে হাইওয়ের পাশে একটি টিম হর্টনে সবাই একত্র হলাম। হাফিজ সাহেব জরুরি প্রয়োজনে সেখান থেকে আগেই টরন্টো রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমরা সবাই সামিট সেন্টারে গেলাম। অনেকে সেন্টারে কিছুক্ষন ঘুরাফেরা করে ছবি তুলল। পরে আমরা সংলগ্ন লেগুনার একপ্রান্তে গেলাম। লেগুনাটি পাড় ঘেঁষে সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর ও রিসোর্ট। এখানকার পরিবেশটি খুবই সুন্দর। কানাডাসহ বিশ্বের অনেক ধনী লোকদের বাড়ি আছে এখানে। সামারে অনেক এসে এখানে অবকাশ যাপন করে থাকেন।
ছবি:- মুকুলের BBQ আয়োজন
লেগুনার স্বচ্ছ পানিতে নেমে ছেলেমেয়েরা অনেক্ষন জলকেলিতে মগ্ন থাকল। আমরা সেখানে দুঘন্টা অতিবাহিত করে ফেরার পথ ধরলাম। টরন্টো ফিরে আসতে রাট আটটা বাজল। সেই সাথে আমাদের এ বছরের ক্যাম্পিংয়েরও পরিসমাপ্তি হল। ছোট খাট কিছু ভুলভ্রান্তি বা অসুবিধার সৃষ্টি হলেও এবারের ক্যাম্পিং সুন্দর ও উপভোগ্য হয়েছে। আমার নিজের পরিবারের সবাই ,দেশ থেকে আগত আমার শ্যালিকা ও ব্রাদার-ইন -ল এবং অন্যানো সকলে মিলে এবারে ক্যাম্পিংয়ে যে আনন্দ করেছি তা নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
মনির ভাই , অনেক ধন্যবাদ ক্যাম্পিং ট্রিপ নিয়ে বিশদভাবে লেখার জন্য . বুঝা যায় অনেক পরিকল্পিত ও গুছানো ছিল আপনাদের ক্যাম্পিং. পরবাসিব্লগে আপনার লেখা পড়ে আরো ও অনেকেই উৎসাহিত হবেন বলে আশা করছি.