ফ্লোরিডা থেকে:-

আকাশের চোউক্ষে লক্ষ কোটি হাজার টন ছাই ঢাইলা দিছে কে যেন । তাই আকাশের চোউখ বাইয়া জল ঝরতাছে। সারা দিন, সারা রাইত শেষে অহন এই সকালেও ঝরতাছে। টিভি রেডিও ইন্টারনেট হৈ হৈ কইরা ভয় ঢুকাইয়া দিতাচে ,এক্কেবারে বরফ কুচির মতন ভয়। ভয় ঢুকতাছে নাক দিয়া , কান দিয়া , চোউখ মুখ চামড়া ,সবকিছু দিয়া। কারণ, আইজ একটা কিছু অইব, ভীষন কিছু । চালগুলা উইড়া যাইব ,গাড়ি গুলারে সাথে লইয়া ,গাছ গুলা ভাইঙ্গা পড়বো, পাখী গুলা চেচামেচি করবো, আর মানুষ , মানুষ গুলা মইরা যাইব,নয় চিল্লাইয়া জ্ঞান হারাইব। অথবা কিচ্ছুই অইবনা।

তর মনে পড়ে আমির হোসেন, হেইদিন আমরা বটগাছের তলায় খেইলতে আছিলাম এবং হঠাৎ চাইরদিক কাইলশা কইরা বৃষ্টি, বিজলী আর ঠাডা আগাইয়া আইল পাগলা হাতীর মতন? আমরা দৌড় দিলাম দুইজনে দুই উল্টা দিকে ।

তুই লম্বা গগন শিরীশ গাছটার নীচে যাইয়া দাঁড়াইলি আর তহনই ঠাডাডা পড়লো। তর মাথার উপরে মস্ত গাছটা পুইড়া ছাই অইয়া গেল। আর গাছের কান্ডডা লম্বালম্বি দুই ভাগ। তুই মূর্তিডার মতন খাড়াইয়া রইলি । আমি যেই তরে নাড়া দিয়া কইলাম ” ল বাড়ী যাই” তুই ধপাস কইড়া পইড়া গেলি, আর তর দুই কান আর নাকে দেখলাম রক্ত জইম্মা রইছে।

আমির হোসেন ,কাউলকা তর ৫৫ বচ্ছর বয়েস অইছে এবং এতগুলা মোমবাত্তি তুই নিভাইতে পারস নাই । চীনারা খুব ফাজিল, অরা অহন এমুন মোম বাত্তি বানাইছে যে ফু দিলে প্রথমে নিইভ্ভা যায়, তারপরে আবার জ্বইল্যা উঠে । আহ্ তর জীবন বাত্তিডা যদি এমন ফু দিয়া জ্বালান যাইত, অন্তত আর একটা বার,আমরা দাইরা বান্দা খেইলতে যাইতাম বট গাছের নীচে। নেংটা অইয়া ডুবাইতাম গাঙে এক নাগারে ঘন্টার পর ঘন্টা , যতক্ষন না আমাগো চোউক্ষে রক্ত জবা গুলা ফুইট্টা উঠতো। তারপরে আমরা লাইন ধইরা এক জন আরেকজনের কান্দে হাত ধইরা চোউখ বন্ধ কইরা রেল গাড়ীর মতন হাঁইট্টা যাইতাম।

আমাগো দেশ যহন অল্প আয়ের দেশ আছিল তহন কানা ভিক্ষুকেরা একে অন্যের কাঁন্দে ধইরা “আল্লা রসুলের নাম ” কইয়া গান গাইতো আর ভিক্ষা করত। আমগো ডুবাইন্না শেষ হইলে উপরে উইট্টা প্রথমে দাঁড়াইতো “আইল্লা” ,অর কাঁন্দে ধইরা আমি, আমার কাঁন্দে ধইরা তুই ,তরপরে নিয়ামইত্যা, তারপর শহীদুল, মরা, দিলীপ্পা, অজিত, সুজিত, কাশেম আর গৌতম । ১১ জনের রেলগাড়ি চলতো। আমাগো লুংগী যা ঢাকবার তা না ঢাইক্কা ঢাকতো চান্দি । বড্ড দীর্ঘ আছিল পদ্মানদীর পথ , আর জাহান্নমের চাইতেও তীব্র গনগইন্না সূর্য।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে চোউখ বুইজা কাউয়ার মিলাদ পড়তাম,যেন কাউয়ায় আমগো লাল চোউখ নিয়া তার পরিস্কার চোউখ দেয় । লাল চোউখ থাকলে ইস্ মাইরের আর বাপ মা আছিলনা । তাই কাউয়ার চোউখ ছিল আমাগো ভরসা।
কাউয়ায় চোউখ, আহ্ কি সুন্দর !

আমাগো চেয়ারমেনের তেজের ঠেলায় অজিত, সুজিত,গৌতমরা ইন্ডিয়ায় চইল্যা গেছে। কাশেম, রানা প্লাজায় বড় একটা এক্সিডেন্ট অইছিলনা, হেই সময় মইরা গেছে,অর বৌ অহন ভিক্ষা কইরা খায়। মরা আর দিলীপ্পার কোন খবরই নাই। শহীদুল এখন ল্যাংরা, স্কুলে মাস্টারী করে, খুব কষ্টে আছে, অগো বাড়ীডা পদ্মায় ভাইঙা গেছে। নিয়ামইত্যার বউ অলি আউলিয়া শেখেদের দেশে ঘাম বীর্য, রক্ত ও চউক্ষের পাইনতে ধুইয়া যে টাকা গুলা পাঠায় তা দিয়া আরেকটা বিয়া কইরা নিয়ামইত্যা ভালোই আছে ।

আর আমাগো সবার সামনে চোউখ খোলা থাকতো যেই বিটকলডার , “আইল্লা” , যারে আমরা বাবা কদম বা সাধক সাধক কইতাম ও অহন আর ছোট্ট নাই। হে অনেক বড় অইছে, অনেক …অনেক .., হেই গগন শিরীষের চাইতেও । হে এত বড় আমলা যে ভাবতেই গা শির শিরাইয়া ওডে ।
অরে আমরা সাধক কইতাম কারন মাদ্রাসায় হুজুর আমাগো বুঝাইছিল যে পীর পরোয়ারদিগার যারা, তারা অইল সাধক মানুষ, তারা সামনে পিছনে সব দেখতে পায়। তাঁরাই বোকা চোদা অন্ধ লুলাগ পথ দেহায়। আমগ মইদ্দে খালি অরই তো চোউখ খোলা থাকতো ,অই হালায় ঐতো দেখতে পাইত সামনে পিছে উপরে নীচে সব কিছু । অর দৃষ্টি খোলা ,আমাগো বন্ধ । আমরা আছিলাম অর পিছে দশজন কানা ও ন্যাংটা ।
আমার অহনও অরে সাধক বইলাই মনে হয় ,ও আমাগো দেশ চালায়, আমাগো দেশ অহন মইদ্দ আয়ের দেশ, খুঁইজ্জাও অহন আর ভিক্ষুক পাওয়া যায়না। আমগ জাকাত ফেতরা নেওয়ার মানুষও আর পামু কিনা সন্দেহ । আহ্ আমাগ কানা রমেশ কাকা যদি বাইচ্যা থাকতো তাইলে তার ভিক্ষার ঝুলিডা অহন আর খালি থাকতোনা।

অথচ আমির হোসেন আমি সারা জীবন ধইরা একজন সাধক খুঁজতাছি, যার পেছনে হেই পোলাপান কালের মতন ন্যাংটা আমি হাঁটতে পারতাম,যে আমারে পথ দেখাইত , এই অন্ধকার অরইন্যের মধ্য থিকা লইয়া যাইতো আলোয়। কিন্তু নাইরে ভাই ,নাই, চারিদিকে সাধু সাধকের বাজার জমছে কিন্তু আসল মাল একটাও নাই ।

ওই যে ঘাসফুল গুলা বৃষ্টির জলে ডুইব্যা গেছে , ওগো শ্বাস লইতে কস্ট খুব হইতাছে । তুই কি শ্বাস লছ ? তর কি শ্বাস লইতে কখনও কস্ট অয়? আমার মাঝে মাঝে অয়, আগে খুব অইতো, পরে একটু ভালো আছিলাম, অহন আবার অয়, খুব অয়, বুকের বাম দিকডায় চিন চিন করে।

তুই কি কোনদিন কোন মাইয়্যারে ভালোবাইস্যা ছিলি ? না, তা কেমনে অইব,অত ছোট্ট বয়সে কেউ মায়রে ছাড়া অন্য কাউরে চিনেই না।

কোন মাইরারে ভালোবাসলে কি ধরনের অনুভূতি কষ্ট দেয় তুই তা বুঝবিনা । আমি যখন ওই মাইয়্যাডারে ভালোবাসতে শুরু করলাম আমার খুব ইচ্ছা অইতো অর অই কলম ধরা হাতডা ছুইয়া দেই, কিন্তু কি কইরা তা অইব? আমাগো মধ্যিখানে ওই যে বৃষ্টি জলে ডুবা মস্ত বড় মাঠডা তার সমান একটা টেবিল আছিল । আর আছিল গোয়ালীমান্দ্রার মুক্তিযুদ্ধের মতন ভয়। অরে আমি অংক করাইতাম , ও থাকতো আমার দেওয়া অংক লইয়া ব্যস্ত আর আমি তহন ফার্স্ট বয় , আমি তহন সব জানি। অহন না সব ভুইল্লা গেছি, তহন তো সব জানতাম। এমন একডা মাইরারে আমার মনে অইল দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দর , আমি ভেদা মাছটার মত অইয়া গেলাম। ক সুন্দরের পাশে বেকার বইয়া থাকলে ভালো না বাইস্যা কি পারন যায়?
আহা, আমির হোসেন তুই থাকলে এমুন অইতো না, তর বুদ্ধি ছিল চাক্কুডার মতন ।

না, তরে কইয়া কি অইব , তুই এইসব কি বুঝবি ! আইচ্ছা আমির হোসেন, তুই তো অহন আল্লার কাছেই থাকস , আল্লাও তো সব কাজ আমগো আতে ছাইড়া দিছে ,হেও কি কাজকর্ম না থাকলে এমুন ভালোবাইস্যা ফেলে ? হে কারে ভালোবাসে রে ?

গোয়ালীমান্দ্রার কথা তো তর মনে আছে। আমরা গুদারা পার হইয়া কনকসার বাজারের পুল দিয়া যাইতে যাইতে জলে ছায়ারে ভেংচি মারতাম । দাদা খে খে কইরা উঠতো আমাগো দাঁড়াইয়া থাকতে দেইখ্যা , অথচ অই ছায়া গুলির কি যাদুই না আছিল । আমরা হইলদা বাজার পার কইরা , সাতঘইরা গোরস্থানে বু’র কব্বর ডাইনে ফালাইয়া যাইতাম, তারপর হাঁটতে …হাঁটতে ….হাঁটতে গোয়ালীমান্দ্রার হাটে পৌছাইতাম প্রতি মঙ্গল বার । দাদা আমাগো মুরলী ভাজা কিইন্যা দিত, কোনদিন শন পাপড়ি , কোনদিন লাঠি বিস্কুট। দাদার তখন ১০২ বচ্ছর বয়স হইছিল অথচ হে আমাগো কালো ষাঁড়ডার মতন আছিল ।
তুই যেই বচ্ছর গেলিগা হেই বচ্ছরই দাদাকে অরা মাইরা ফালাইল, তার কয়দিন পরেই আমাগ জরিনা বুবুরে ধইরা লইয়া গেল। তার নাকি একটা বাচ্চা পেডে আইছিল ,হে গলায় দড়ি দিল। তারে অরা অত্যাচার করছে হেই দু:খে যতডা না, তার চাইতে গেরামের মানুষের মুখে বেকা হাসি দেইখ্যা। ততদিনে দেশ স্বাদীন অইয়া গেছে। জড়িনা বুবুর স্বাদীন অইয়া মরতে অইব এমন কোন কতা আছিল না । আগে মেলিটারির আতে মরলেও পারতো।
কিন্তু কি কমু ক ?
মতলব ভাই’র বন্ধু আমজাদ ভাই একদিন হাওয়া অইয়া গেল যুদ্ধ লাগবার পর পরই। লোকে তারে মুক্তি আমজাদ কইতো, মেলিটারিরা তার বাপরে-মারে মাইরা হালাইছে পোলা মুক্তি যুদ্ধে গেছে বইলা। তাগো বাড়ীডা পুইড়া ছাই কইরা দিছে। হে তো আর ফিইরাই আইলো না , কেউ কয় হে মরছে, কেউ কয় বাইচ্যা আছে, ক এই দেশে কারে বিশ্বাস করুম ?
আমাগো কলিমদ্দি কাকার পোলা আহাম্মদ ভাই মিস্টির পাতিল লইয়া শ্বশুর বাড়ী যাইতাছিল,রাস্তায় মেলিটারী দেইখ্যা মসজিদে পলাইছিল, কিন্তু তারে দেইখ্যা ফালায়। আহারে মসজিদের সামনেই গুল্লী কইরা…।

তর মনে আছে কত সুন্দর বাঁশী বাজাইতো হে? চাঁন্দনী রাইতে তার বাঁশী শুইন্যা বাঁশঝার থাইকা একটা পেত্নী সুন্দরী মাইয়া সাইজা পুলের উপর বইসা তার বাঁশী হুনতো । হে জানতো ওই মাইয়ারে পাত্তা দিলে তার ঘাড়ডা মটকাইব। অথচ দেখ আমি আহমদ ভাইয়ের অই কথা জাইন্নাও কি কামডা করলাম ? একডা মাইয়ার দু:খে দেশ ছাইড়া পলাইলাম ।

আমাগো গোয়ালীমান্দ্রার বিলে কি যে যুদ্ধ অইছিলরে , আল্লা মাবুদ সাক্ষী। লন্চভর্তি মেলিটারী আইছিল, কিন্তু আমগ মুক্তিরা অগো এমন কেচকা কলেই ফালাইছিল যে একটাও ফিরত যাইতে পারে নাই। কিছু পানিতে নাইম্যা ডুইব্যা থাইক্যাও রেহাই পায় নাই ,বৈঠা দিয়া বাইড়াইয়া অগো চৌদ্দ গুষ্টি দেহাইয়া দিছিল। এমুন উচিত শিক্ষা অরা আর পায় নাই এইর আগে ।
না তুই আছিলি না, আর আমিই বা কতডু আছিলাম? আমার যদি বয়স হইতো আমি ঠিক মুক্তিযুদ্ধে যাইতামরে। আর শেখ মুজিব যহন অস্ত্র জমা দিবার কইছিল, আমি তারে কইতাম : “বাজান , একটা অস্ত্র আমারে রাখতে দেও ,আমি তোমারে পাহারা দিমু , তুমি খালি মুগাবের হাত হইতে আমাগো দেশডারে রক্ষা কইরো । “
আমির হোসেন ,তগ অইহানে যুদ্ধ হয় ?
কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেরে ?
কে জিতে ? কেউ জিতে না ?
কে হারে ? মানবতা?
ও যুদ্ধ হয়না ?

না , তারপরে ও আমার তর ওহানে যাইতে ইচ্ছা করেনা। আমার কথা বার্তা বা শব্দ না হুনলে ভাল্ লাগেনা। বাতাসে গাছের পাতা গুলি লইড়া লইড়া যেই শব্দ করে, টিনের চালে বৃষ্টি , কুত্তার ঘেউ ঘেউ, মৌমাছির গুন গুন, পানিতে বৈঠা আর লগ্গির শব্দ এই সব ছাইড়া থাকতে পারুম নারে।
হুনছি তগ ওহানে একটা পাতাল গঙা আছে,তুই কি ওহানে আগের মত ডুবাইতে যাস ? তরা কয়জন ? অহনও চোউখ লাল হয়?

২য় পর্বে শেষ দেখুন

শাহাব আহমেদ
জুন ৭-৮,২০১৬

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন