মেপল লিফের দেশ কানাডা! সেইসাথে পৃথিবীর সেরা শিষ্টাচারের দেশ কানাডা!! কথাটা মোটেই অত্যুক্তি নয়। বিনয়, শিষ্টাচার বা ভদ্রতা এর কোনটাতেই কানাডিয়ানরা পিছিয়ে নেই। আমার তো মনে হয় কানাডিয়ানরা একটু বেশি মাত্রায় ভদ্র। পথ চলতে বা লিফটে উঠতে গেলে বা বাস ট্রেনে উঠতে নামতে গেলে যদি কারো সাথে একটু ধাক্কা লাগে তো সঙ্গে সঙ্গে সরি বলেন যে কোনো কানাডিয়ান। এমনকি পথ চলতে সময় ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা থাকলে বা ধাক্কা না লাগলেও অনেকে সরি বলেন। এ ছাড়া আপনি কোনো বিষয়ে আপনার বস বা অধস্তন কেহ কোনো কাজে সামান্য দেরী বা ভুল করলেও বা এ বিষয়ে একটু এদিক ওদিক হলেও সরি বলতে কানাডিয়ানদের কখনও কার্পন্য করতে দেখা যায় না। সরি বলা যেন এদের অস্থি মজ্জার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে, যা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বহিঃপ্রকাশ হতে দেরী করে না।অর্থাৎ ভুল করুন বা না করুন সরি বলতে বা এপোলজি চাইতে কোনো কানাডিয়ান বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেন না।

আবার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে থাংক ইউ বলতেও এদের জুড়ি নেই। রাস্তাঘাট,হোটেল রেস্টুরেন্ট,অফিস আদালত সবখানেই এবং সব বাক্যেই থাংক ইউ বলতে দেখা যায়। এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে আমার কর্মস্থলের লবি দিয়ে আমি আনমনে হেটে যেতে যেতে এক শেতাঙ্গ মহিলা আমাকে অতিক্রম করার সময় বললেন থাং ইউ। আমি হঠাৎ করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, থাংক ইউ ফর হট ? সে একটু অবাক হলো এবং পরে হেসে বলল ,এইযে আমি তোমাকে অতিক্রম কালে তুমি আমাকে রাস্তা ছেড়ে যেতে জায়গা করে দিলে। আমি তখন পাল্টা থাংক ইউ বলে আবার আমার কাজে চললাম। তো কানাডিয়ানদের এই জাতীয় বিনয় বা সৌজন্যবোধ সারা বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে অনেক বেশি। এ কথারই মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়। আসলে এসব আচরণ কানাডার মূলধারার জনগোষ্ঠির প্রাথমিক বা সর্বপ্রথম শিক্ষনীয় বিষয় বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। কিছু কিছু কানাডিয়ান আছে যাদের নাক একটু উচু। তাদের অনেকে এসব সরি বা থাংক ইউ কালচারের ধার ধরেন না। এদের কেহ একটু অহংকারী বা কেহ কেহ কিছুটা বর্ণবাদী। তবে এদের সংখা খুব বেশি নয়। কানাডিয়ানরা সততা ,সহানুভুতি বা অন্যের কোনো বিষয় গোপন রাখা বা বাক্তিসাতন্ত্র কে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে। থাকে। এসব গুনাবলী যেনো একজন কানাডিয়ানের চরিত্রের গভীরে প্রোথিত। মানুষকে আঘাত করে এরা কোনো কথা খুব একটা বলে না।

কানাডিয়ান বলতে আমি এখানে বিশেষভাবে তাদের বুঝাতে চাচ্ছি কানাডায় বসবাসরত সাদা চামড়ার মানুষেদের। সাদা চামড়ার মানুষ যারা এশিয়া আফ্রিকা থেকে আগতদের পুর্ব থেকে এদেশে বসবাস  আসছেন। তবে এদের চাইতে এখন কানাডার নাগরিকদের অধিকাংশই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ইমিগ্রান্ট। এসব ইমিগ্রান্টদের মধ্যে এই কানাডিয়ান শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ কতটুকু বিদ্যমান সেটা দেখা যাক। অপরের প্রতি সৌজন্যবোধ ,বিনয় বা এপোলজি চাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কতটুকু উদার ? কতবার তারা দৈনন্দিন সামাজিক যোগাযোগ ক্ষেত্রে এসব সরি বা থাংক ইউ কথাটি ব্যবহার করেন? এ প্রশ্নের জবাব খুব একটা সন্তোষজনক হবে বলে আমার মনে হয় না।

সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু জরিপে দেখা গেছে কানাডার ইমিগ্রান্ট অধ্যুষিত শহরগুলিতে শিষ্টাচার বা ভদ্র আচরণ কমে যাচ্ছে। ভান্কুভার সান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে থেকে জানা যায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়ানদের শতকরা ৬২% মনে করে গত পাঁচ বছরে ঐ প্রভিন্সের মানুষের শিষ্টাচার বা ভদ্র আচরণ অনেক কমে গেছে। বাসে বা ট্রেনে যাতয়াতকালে ,গাড়ি চালানোর সময়,মার্কেটে কেনাকাটার সময় ভদ্র ব্যবহারের মাত্রা গত পাঁচ বছর অনেক কমে গেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। টরন্টো বা মন্ট্রিয়েল শহরের অবস্থা কি সে সম্পর্কিত কোনো জরিপ বা প্রতিবেদন আমার জানা নাই।তবে এ দুটি শহরের অবস্থা যে ভান্কুভারের থেকে উন্নত নয় বরং আরো খারাপ সে বিষয়ে আমি অনেকটা নিশ্চিত।

উদাহরণ হিসাবে টরন্টোতে বসবাসরত বাংলাদেশী  ইমিগ্রান্টদের মধ্যে এই কানাডিয়ান বিনয় বা সৌজন্যবোধ কতটুকু সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যারা বর্তমান সময়ে বা কিছুকাল আগে কানাডায় ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছেন তারা প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত বা বাংলাদেশের মোটামুটি ভদ্র সমাজের নাগরিক ছিলেন। একটি সূত্র থেকে জানা যায় টরন্টোতে প্রায় বিশ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করেন।আমরা যারা দেশ থেকে লেখাপড়া  করে এসেছি ,সরকারী উচ্চ পদে চাকুরী করে এসেছি বা বড় ব্যবসা করে এদেশে ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছি তাদের অনেকেই কানাডায় এসে কানাডিয়ানদের মত সৌজন্যবোধ এখনো আয়ত্ত করতে পারি নাই। এ দেশে এসে আশানুরূপ কিছু করতে না পারার জন্য আমরা অনন্য কানাডিয়ানদের তুলনায় দরিদ্র। এ দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীরা যা আয় করেন তার প্রায় সবই থাকা খাওয়ার জন্য বায় হয়ে যায়। অনেকেই সপ্তাহের মধ্যে ৬/৭ দিনই কাজ করেন। এতে তারা কানাডায় এসেও কানাডিয়ান কালচার বা শিষ্টাচার কিছুই আয়ত্ত করার সুযোগ পান না। কারণ এজন্য যে সামাজিক যোগাযোগ প্রয়োজন হয় সেটা করার সময় তাদের হয় না। সপ্তাহের মধ্যে যে স্বল্প সময় তারা পান তা বায় করেন বাজার লন্ড্রি বা ঘরবাড়ীর অন্যান্য জরুরি কাজ করার জন্য। কানাডিয়ানদের বা অন্যান্য মানুষের সাথে যোগাযোগ না হলে এই শিষ্টাচার কিভাবে আয়ত্তে আসবে? শুধু বাংলাদেশ নয়,বিশ্বের অনান্য অনুন্নত দেশ থেকে আগত অনেক ইমিগ্রান্টদের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ ছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বা আমাদের পারিবারিক পরিবেশে সরি বা থাংক ইউ বলা কখনো শেখানো হয় না। বিশেষ করে সরি বলাটা আমাদের দেশীয় কালচারে মনে করা হয় যেন পরাজয় স্বীকার করে নেয়া। আমাদের কালচারে সরি মানে নিজের অক্ষমতার প্রকাশ বলেও ধারণা করা হয়। কানাডায় বসবাস করেও আমরা এ মানসিকতার উর্ধে যেতে পারি নাই। আর থাংক ইউ বা ধন্যবাদ দেয়ার প্রবণতাও আমাদের দেশীয় কালচারে খুব একটা প্রচলিত নয়। সেকারণে বাংলাদেশী সহ অন্যান্য সব দেশের ইমিগ্রান্টদের মধ্যে কানাডিয়ান শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ খুব কম বলে মনে হয়।

আসলে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ কখনও চাপিয়ে দিয়ে শেখানো যায় না। কানাডিয়ানদের মধ্যে যেমন জীবনের প্রাথমিক শিক্ষায় বা পারিবারিক পরিবেশে এ বিষয়টি সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে শেখানো হয়। আমাদের সেটা শেখানো হয়নি। তাই কানাডায় বসবাস করা সত্তেও আমরা সত্যিকার কানাডিয়ান নাগরিক হতে পারি নাই। তবে আমরা জানি মানুষ আসলে পরিবেশের দাস। তাই সে যে পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে থাকে আস্তে আস্তে সেখানকার কালচার ও জীবনযাত্রায় অভাস্ত হয়ে যায়। আমাদের সন্তানেরা কানাডিয়ান সামাজিক পরিবেশে প্রথম থেকেই বসবাস শুরু করেছে এবং কানাডিয়ান শিক্ষা লাভ করছে, তাই আশা করা যায় তারা কানাডিয়ান শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারবে।

.

১ মন্তব্য

  1. ধন্যবাদ মনির ভাই, একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে লেখার জন্য. যদিও আমাদের মধ্যে কানাডীয় শিষ্টাচারের সমস্সা নেই বললে ভুল হবে. কিন্তু এখানে বসবাসরত চীন বা পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত মানুষদের তুলনায় আমাদের (বাংলাদেশীদের) শিষ্টাচারগত অবস্থান অনেকটাই উন্নত. বিভিন্ন কারণে নানা দেশে যাওয়া এবং থাকার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু কানাডিয়ানদের মত ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ বা শিষ্টাচার আর কোথাও দেখিনি. এটা নির্ধিধায় বলা যায়. ফলে এদেশের প্রতি “Sense of Belongingness” সহজেই গড়ে উঠে. আবার ও ধন্যবাদ সময় উপযোগী একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্য.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন