দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সার্বক্ষণিকভাবে হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করে থাকি। দেশের মন্দ খবরে মন যেমন কেঁদে ওঠে তেমনি ভালো খবরে খুশিতে মন ভরে যায়। আনন্দে ঝলমল করে ওঠে আমাদের চোখমুখ। মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় যে অবোধ শিশু রেজোয়ান ময়ীন অর্ণব আমাদের সাথে পাকাপাকিভাবে দেশ ছাড়লো, কানাডার আলোবাতাসে বেড়ে উঠলো, সেই ছেলের স্বদেশ প্রেম দেখে আনন্দে মাঝে মাঝেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। যেমন হলো গত রাতে।

অনেকদিন আগে থেকেই অর্ণব প্ল্যান করে রেখেছিলো, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাসায় খেলা দেখবে। আমাকে বললো, ‘বাবা, ফ্রাইডে কাজের দিন, তোমাদের কষ্ট হবে, আমি বাইর থেকে খাবার ক্যাটারিং করি?’ আমি বললাম, ‘অসুবিধা নেই, আমরা আছি, চিন্তা করো না’। হাউজ হাজব্যান্ড উপন্যাস লেখার কারণেই হোক, অথবা মিতার কোচিং এর কারণেই হোক, বিরানি রান্না করতে করতে আমার হাত পেকে উঠেছে। বড়ো সসপ্যানে বিরানি যখন চুলায় তুলে দিচ্ছি অর্ণব তখন মহা ব্যাস্ত। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করছে, অধরাকে দিয়ে নিজের গালে কালার পেন দিয়ে বাংলাদেশের লাল সবুজ জাতীয় পতাকা আঁকিয়ে নিচ্ছে, বন্ধুবান্ধবদের খেলে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আমাকে বললো, ‘বাবা, এতো হইচই করে, আয়োজন করছি, আমরা জিতবো তো?’ আমরা জিতবো না হারবো সেটি বড়ো কথা না, দেশের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ছেলেটি যে ‘আমরা’ শব্দটি বললো , এতেই আমার মন ভরে গেল।

শ্রীলংকা ব্যাট করছে। মাত্র ২য় ওভারেই তাসকিনের বলে বোল্ড হয়ে মাথা নিচু করে প্যাভেলিয়নে ফিরলেন অভিজ্ঞ Kusal Mendis , দলের রানের সংখ্যা তখন ২.৩ ওভারে ২১ রান। অতি সম্প্রতি আইপিএল এ সুখ্যাতি ছড়ানো মুস্তাফিজ জ্বলে উঠলেন। পরের পর পর দুইটি উইকেট নিয়ে ৮.৫ ওভারে শ্রীলংকার দলীয় রান দাঁড়ালো ৩ -৭০ রান। পরে অবশ্য মুস্তাফিজ আরো একটি উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে চার ওভার বল করে মাত্র ১৭ রান দিয়ে তিনটি মূলবান উইকেট নিয়ে দর্শকদের সেই পুরোনো ‘ফিজ’ কে চেনাতে সক্ষম হলেন। ফিজের সাথে পাল্লা দিয়ে আরেক বলার রিসাদ হোসেনের ঝুলিতেও থাকলো তিনটি উইকেট। একেকটি উইকেট পড়ছে আর অর্ণব ও ওর বন্ধুদের গগনবিদারী চিৎকারে কান তালা লেগে যাচ্ছে। ২০ ওভার শেষে শ্রীলংকা মানসম্মান বাঁচিয়ে মোটামুটি একটি স্কোর নির্মাণ করলেন ৯/১২৪ রান। এরপরে ইনিংস ব্রেকে শুরু হলো আমাদের রাতের খাবার। আমি ও মিতা পরম উৎসাহে অর্ণব ও ওর বন্ধুদের খাবার পরিবেশন করছি, ‘প্রায় জিতেই গেছি’ ভাব করে অর্ণবরা গোগ্রাসে খাচ্ছে। আমি অর্ণবকে বললাম, লো স্কোরিং ম্যাচগুলো কিন্তু বেশ টাইট হয় বাবা । অর্ণব আতংকে ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে “ইন্শাআল্লাহ খেলা হবে” হ্যাডিং দিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দিলাম।

আমার ও অর্ণবের আশংকা প্রায় ফলেই যাচ্ছিলো। মাত্র ১২৪ রান টাইগারদের কাছে সহসাই হিমালয়ের মতো সামনে সে দাঁড়ালো। ইনিংসের ৩য় বলে সৌম সাহেব যথারীতি শূন্য রানে বিদায় হলেন। একেকটি উইকেট পড়ছে আর অর্ণবের মলিন মুখ দেখে বিষাদের বিষ মাখানো একেকটি তীর আমার অন্তরে বিঁধছে। জয় পরাজয় খেলারই অংশ। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের টি টুয়েন্টি পারফরম্যান্স প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই আমি তেমন একটা হতাশ হলাম না। তবে বিচলিত হলাম কীভাবে এই ছেলেকে আমি শান্তনা দিবো!

ম্যাচ শেষে সান্তনা আর আমাকে দিতে হলো না। উইনিং মোমেন্ট দেখার আগ্রহে ফেসবুকে লাইভ এলাম। পাশের বাড়ির লিটন ভাই বাংলাদেশের জার্সি গায়ে লম্বা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। উৎসাহী মিলু ভাই ব্যাকুল হয়ে টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তেজনায় অর্ণবের গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না। ১৯তম ওভারের শেষ বলে অভিজ্ঞ মাহমুদুল্লাহ’র ব্যাট থেকে আসা দুই রানের মাধ্যমে ছয় বল হাতে রেখে জিতে গেল বাংলাদেশ, জিতে গেল অর্ণব , জিতে গেলাম আমরা দেশ থেকে দূরে থাকা প্রবাসীরা।

আজ সকালে এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, অন লাইনে প্রথম আলোর দিকে এক পলক তাকাতেই চোখে পড়লো খেলার পাতায় বড়ো বড়ো করে হ্যাডিং করা হয়েছে ” এই মাহমুদউল্লাহকে বাদ দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ, বিশ্বাস হচ্ছে না হার্শা ভোগলের”। খবরে বলা হয়েছে “সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফর্মের কারণে দলে জায়গা পাননি মাহমুদউল্লাহ। ৩৮ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান গত বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগেও দলে নিয়মিত ছিলেন না। তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা।” (প্রথম আলো, আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ০৯: ৪০)

কতই না বিচিত্র এই দেশ !!! বাংলাদেশ

পরিশিষ্ট : ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। দিন কয়েক আগে দেখলাম ইউএসএ এক সময়ের বিশ্বকাপ জয়ী পাকিস্তানকে হারিয়েছে। গতকাল আফগানিস্তান নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে। বাংলাদেশ পরের ম্যাচগুলিতে ভালো খেলুক এই কামনা করি। বিশ্বকাপের আসরে বগুড়ার ছোল হৃদয়ের চোখ ধাঁধানো পর পর তিন বলে তিন ছক্কা অনেক দিন বাংলাদেশী ক্রিকেট প্রেমিকদের হৃদয়ে থেকে যাবে।

শুভকামনা বাংলাদেশ
আমাদের হৃদয়ে বাংলাদেশ

(ছবি: সংগৃহীত)

————————————

জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার
টরেন্ট, জুন ৮ , ২০২৪

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধপোকা
পরবর্তী নিবন্ধউসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন