প্রায় দুই বৎসর হলো কোভিডের ফলে পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত। বেহুলা-লখিন্দরের গল্পের মতো বিভিন্নভাবে সতর্কতা অবলম্বনের পরও হঠাৎ কোভিডে আক্রান্ত হই। শত প্রতিবন্ধকতা সত্বেও কোভিড সাপ হয়ে ঘরে ও দেহে প্রবেশ করে, নিস্তার নেই।
সন্ধ্যা রাতে দেখি রিক্টকার স্কেলে নয়, তাপমাত্রাহীন ভূমিকম্প শুরু হলো শরীরে। একটা কম্বল, একটা কম্ফোর্টার ও দু’টা কাঁথা দিয়েও শরীর প্রবোধ মানে না। বিরামহীন তার কাঁপুনী। স্ত্রী ও ছেলে কাজে, মেয়ে সাওয়ারে তখন। সময় ও সুযোগ বুঝেই দিয়েছে হানা সে। এ যেনো এক হেল্পলেস মুহূর্ত। নাইনএলিভেনে কল দিবো কি দিবো না, ভাবছি। মেডিকেল টীম আসলে এরা জুতাসহ হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে প্যাকেট করে হাসপাতালে নিয়ে ফেলে রাখবে। সহধর্মিণী, পুত্র রাতে বাসায় ফিরলে আমিহীন ঘর দেখলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। দুইটা টায়নল ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করেও কাঁপছি এবং ভাবছি, ওমিক্রন নিয়ে একটা লেখার প্লট পেলাম তাহলে।
রাত দশটায় স্ত্রী, পুত্রের মুখ দর্শনের পর ছেলেকে ডেকে বলি, তোমার ব্ল্যাঙ্কটটা আমার শরীরের উপর দাও। ছেলেরটা ডাবল ও বেশ ভারী। বেশি দামে স্ত্রীর জন্যই কিনেছিলাম, বলেছিল এটা অনেক ভারী তোমার ছেলেকে দিয়ে দাও। আব্বার জ্বর হলে আমাকে ডেকে বলতেন, লেপ দে। একটা লেপ দেবার পর বলতেন, আরেকটা দে। দ্বিতীয়টা দেবার পর বললেন, বাজান আমারে ঠাইসসা ধর। ছেলে আমাকে তাঁর কম্বলটা দেবার পর বললো, বাবা আর ইউ ওকে? এখন তিনটা কম্বল, দুইটা কাঁথা। রিকটার স্কেলের মাত্রা আস্তে আস্তে নেমে আসছে। স্ত্রীকে বললাম, আমার করোনা হয়েছে। আজ রাত থেকে তুমি মেয়ের সাথে ঘুমাও। ক্লান্ত শরীরে ম্লান হেসে বললো, আরে না তোমার করোনা হয় নাই। আমার কিছু হবে না।
পরদিন থেকেই কর্ম বিরতি নেই। বাসায় থাকি, ডিভাইসে চোখ রাখি। ভোর পাঁচটায় উঠলেও দ্রুত সময় চলে যায়, ধরা যায় না। সকালে স্ত্রী দাড়চিনি, এলাচি দিয়ে ভুজংভাজাং গরম চা দেন। গরম, গরম খাও। ঝাল আমার পরম শত্রু, সব সময়ই আমাকে চরমপত্র দেয়। না তোমার ঝাল চা খেতে পারবো না, ক্ষমা করো মহারাণী। তথ্য সংগ্রহে জানা গেলো যে, ওমিক্রন আক্রান্তদের এখন হাসপাতালে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বাধ্যতামূলকভাবে পাঁচদিন বাসায় আইসোলেশনে থাকতে হবে। সিরিয়াস রোগী না হলে হাসপাতালে রেপিড টেস্ট করতে চায় না। পাঁচশ রোগী হাসপাতালে গেলে প্রশ্নত্তোর পর্বের পর চারশজনকেই বাসায় ফেরৎ পাঠানো হয়।
ফার্মেসীতে গিয়ে পকেটের অর্থ ব্যয়ে রেপিড টেস্ট করানো যায়। অর্থ সাশ্রয়ের কথা ভেবে হাসপাতালে যাবার পথ খু্ঁজি। স্ত্রীর বান্ধবী হাসপাতালে চাকুরী করেন, তাঁর সহায়তায় রেপিড টেস্টের কীট সংগ্রহ করি। ছেলে আমার নমুনা সংগ্রহ করার পর হাসপাতালে ড্রপ করি। যথারীতি নিয়মানুযায়ী শুক্রবার দুপুরে হাসপতাল থেকে আমাকে ফোন করে। আমার জন্মতারিখ, ফোন নাম্বার ও নাম সঠিক জানার পর বলে, আমি ডাক্তার বলছি – তোমার কোভিড পজেটিভ। তুমি কবে কোভিড আক্রান্ত হয়েছো? তোমার কি কি সিম্পটম ছিল? হার্ট এ্যাটাক পর পর এই হাসপাতালে দুইবার আমার এনজিওগ্রাম হয়েছিল। হাসপাতালের রেকর্ডে আমার পরিচিতি রয়েছে। আমি কি কি ঔষধ নেই ডাক্তার ঔষধের নামগুলি বলেন। জানুয়ারীর দুই তারিখ রাতে কোভিড এ্যাটাক হয়। গলা ব্যথা ও টাঙ্গ টেস্টলেস। আচ্ছা পাঁচ দিন পর তুমি কাজে যেতে পারো। সেলফ আইসোলেশনে থাকো। বাসায় কারো রেপিড টেস্টের প্রয়োজন নাই। কোভিড আক্রান্ত হলে আইসোলেশনে থাকবে। কোনো ঔষধ দিচ্ছি না।
বাসায় একজন কোভিড আক্রান্ত হলে অন্যরা আক্রান্ত না হলেও ধরে নেয়া হয় তারাও শিকারে পরিণত হবেন। চলমান ঘটনা কর্মস্থলে জানাতে হবে। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে তাদের কর্মস্থলে আমার কথা জানানোর পর স্ত্রী ও ছেলের কর্মবিরতি হয়। মেয়ে বাসা থেকে অন লাইনে পাঁচ দিনই কাজ করে। তাঁর ছুটি মিলেনি। স্ত্রী ও ছেলে কোভিড আক্রান্ত হলে তারা ভুজুংভাজুং গরম গরম চা খায় আর বাসায় থেকে কর্মবিরতি উপভোগ করে। ছেলে অন লাইনে তাঁর ইউনিভার্সিটির ক্লাসে এটেন্ড করে। টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা এক সময় সহনীয় হয়ে উঠেছে। ওদের মতো কোভিড, ওমিক্রন স্বাভাবিক হয়ে উঠবে এক সময়।