চান রাত

-আচ্ছা, তুমি মানুষ না অন্য কিছু, এই লক ডাউনে সারাদিনতো বাসায় বসে অফিস করো, আমরাতো আর সেই কপাল করে জন্মাইনি, তো রান্নার কাজে একটু যোগারদারি করলে মান-সম্মান কি সব চলে যাবে ? নাকি, আদরের কন্যার সাথে বক বক করে একবারে ইফতারির সময় সেজে -গুঁজে মাথায় টুপি পরে বসে গপ গপ করে ইফতারি খাবে ?

কথাগুলি এক নাগাড়ে বলে রুবিনা কিছুটা দম নেয়। স্বামী জামিল উদ্দিন সাহেব কিছুটা চুপসে যেয়ে ধীর পায়ে রান্না ঘড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘটনাটি ঘটেছিলো এই কিছুক্ষন আগে ছোট মেয়ে পলিন যখন বেশ আগ্রহ করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল:

বাবা এবারের ঈদ কি ক্যান্সেল ? পলিন হচ্ছে প্রবাসী জামিল উদ্দিন সাহেবের সর্ব কনিষ্ঠ মেয়ে, টরেন্টোর একটি এলিমেন্টারি স্কুলের পঞ্চম গ্রেডের ছাত্রী। জামিল উদ্দিন ও পলিনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এর মানে আবার এই না যে বাকি  ছেলেমেয়েদের সাথে জামিল উদ্দিনের বন্ধুত্ব নেই। আসলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটু একটু করে সন্তানদের সাথে বাবা/মা -র দূরত্ব বাড়তে থাকে। এখনকার ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার প্রথম লক্ষণ হলো, বেড রুমের দরজা বন্ধ করে থাকা, বাবা/মা দের  সাথে বেড়াতে যেতে অনীহা প্রকাশ করা, উইকেন্ডে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো, কথায় কথায় কাঁধ ঝাকিয়ে বলা ‘এই ডোন্ট কেয়ার’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলির প্রায় সবই জামিল উদ্দিনের পলিন  ছাড়া বাকি ছেলেমেয়েদের যেমন পনেরো বছরের মেয়ে তারিন ও উনিশ বছরের ছেলে তমালের মধ্যে বিদ্যমান।

জামিল  উদ্দিন কৌতুহুলবশতঃ ছোট মেয়েকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন :
‘কেন রে মা ঈদ ক্যান্সেল হবে কেন, এ কথাই বা হটাৎ মনে হলো কেন মা ?’
পলিন অনুযোগের সুরে বাবাকে বলে: ” বড় আপুকে বললাম, আপু পাত্তাই দিলো না, বড় ভাইয়াকে বললাম, বড় ভাইয়া বললো চারিদিকে যে হারে করোনা ভাইরাসের জন্য মানুষ মারা যাচ্ছে, এর মধ্যে আবার ঈদ -টিদ  কি যা ভাগ এই বলে দ্রাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো, আম্মু কে বললাম, আম্মু বললো, যা তোর বাবাকে গিয়ে বল, আমার কথা বলার সময় নেই, উনারতো এখন অফুরন্ত সময়, উনাকেই গিয়ে বল, উনি তোকে বুঝিয়ে বলবে।’

এবার জামিল উদ্দিন বিশেষ মনোযোগের সাথে পলিনকে বুঝাতে থাকে:
-‘এক অর্থে এবারের ঈদ ক্যান্সেল আবার আরেক অর্থে ক্যান্সেল না। প্রথমে, তোমাকে বলছি মন দিয়ে শোনো কোন অর্থে এবারের ঈদ ক্যান্সেল হতে পারে। যেমন, ঈদের অর্থ হচ্ছে খুশি। তোমার বড় ভাই তাই ঠিকই বলেছে, আমরা সারা পৃথিবী জুড়ে এই করোনা ভাইরাস নিয়ে এখন এক গভীর বিপদে আছি মা, আজ প্রায় মাস দুয়েক হলো প্রত্যেক দিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, এই অবস্থায় আমাদের একটি খুশির উৎসব সেলিব্রেট করা কি ঠিক হবে? তোমার কি মনে হয় মামুনি ?’
-‘তা বুঝলাম, এখন বলো বাবা, কোন অর্থে ঈদ সেলিব্রেট করা ঠিক ?’
-‘দেখো মা, এটা হচ্ছে এক ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপার। একটি ধর্মের মানুষেরা সারামাস রোজা শেষে সকালে ঈদের নামাজ আদায় করে পরিবারের সবাই মিলে একটি দিন একটু ভালো খাবার খেয়ে, নতুন কাপড় পরে খুশিতে মেতে থাকবে, এটাতো দোষের কিছু নারে মা। যারা মারা যাচ্ছে, তারাতো মারাই যাচ্ছে, আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, আমাদের বাঁচতে হলে, মনে বল থাকতে হবে, আর মন তাজা রাখতেহলে অন্তত একটা দিন হাসি /খুশিতে থাকা যেতেই পারে, তাইনা মামুনি ! এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই লক ডাউনের মাঝেও আমরা হাসি /খুশিতে ঈদ উদযাপন করবো। এর সুন্দর উত্তর আছে মামনি। সেক্ষেত্রে ইচ্ছা করলে মা আমরা ঘড়ে বসেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আত্মীয়/স্বজন, বন্ধু /বান্ধব, প্রতিবেশী সবাই মিলে ঈদের দিনে খুশিতে থাকতেই পারি!’

-‘এটা  আবার কি বললে বাবা, ঘড়ে বসে কারো বাসায় বেড়াতে না যেয়ে আবার কিভাবে সবাই মিলে ঈদ সেলিব্রেট করবো বাবা, একটু বুঝিয়ে বলবে?’ পলিন বেশ উচ্ছাস প্রকাশ করে জানতে যায়।

জামিল উদ্দিন তার এই আদরের ছোট কন্যার কাছ থেকে এরকম প্রশ্নই আশা করছিলেন।ব্যাচারা জামিল উদ্দিন কেবলি মেয়েকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলবেন বলে গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করতে যাচ্ছিলেন এমন সময় রুবিনা যিনি কাজ থেকে এসে রান্না ঘড়ে ইফতারি ও পোস্ট -ইফতারির খাবারের আয়োজন করতে যেয়ে এতক্ষন প্রচুর ধর্য্যের পরিচয় দিয়ে বাবা ও মেয়ের দীর্ঘ কথা/বার্তা শুনাছিলেন, এবারে সে ধর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে বাঘিনীর মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন।

পলিন মায়ের হুঙ্কারে, কিছুটা ভয় পেয়ে গুটি শুটি মেরে টুলের উপর বসে আছে । এতটুকু এই মেয়েও জানে, বাবা যদি মায়ের কথা অমান্য করে তবে এর ফলাফল ভালো হবে না। মায়ের এই চিৎকার হচ্ছে ট্রাফিকের হলুদ বাতির মতো, এর পরের পর্বটি আরো ভয়াবহ রূপ নেয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। ওদিকে ব্যাচারা জামিল উদ্দিন সাহেব মেয়ের সামনে স্ত্রীর মুখে কড়া কথা শুনে কিছুটা আড়ষ্ট হলেও একেবারে ভেঙ্গে পড়েননি। মেয়েকে বুঝায়ে রান্না ঘড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। আসলে জামিল উদ্দিনের কাছে একটি বাচ্চা মেয়ের কৌতহল নিবৃত করার চেষ্টাকে রান্না ঘড়ে রান্না/বান্নায় সহযোগিতা করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। কিন্তু, পরমুহূর্তেই জামিল উদ্দিন আবার ভাবে, কে জানে, রুবিনাই বোধ হয় ঠিক, মেয়ের সাথে এসব কথা/বার্তা বলার সময়তো শেষ হয়ে যায়নি, পরেও বুঝিয়ে বলা যেত। এরই নাম  হচ্ছে সংসার। অনেকটা ড্রাইভিং এর মতো এখানে ভুল করার সুযোগ খুব কম থাকে, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্বান্ত না নেয়ায় অনেক সময় অনেক ঝানু ঝানু ব্যাক্তিরাও  সংসারে হিমশিম খেয়ে যায় আর জামিল উদ্দিনের মতো নিরীহ টাইপের মানুষের ক্ষেত্রেতো প্রশ্নই আসে না। অগত্যা,  জামিল উদ্দিন বাচ্চা মেযেটির ভয়ার্ত শুখনা মুখকে আমলে না নিয়ে স্ত্রীর চিৎকারকে মেনে নিয়ে,  স্ত্রীর সাথে রান্না ঘড়ে যোগারদারি করাকেই যুক্তি সঙ্গত মনে করলেন।
 
গত বুধবারের দিন বিকাল বেলা  জামিল উদ্দিনের জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে গেলো। স্ত্রী রুবিনার আজ কাজ ছিলোনা বলে বেশ ভালো মুডে ছিল। রুবিনার নেতৃত্বে স্বামী জামিল উদ্দিন, বড় ছেলে তমাল,বড় মেয়ে তিন্নি সহ সবাই রান্না ঘড়ে মায়ের সঙ্গে এটা ওটা কাজে ব্যাস্ত। জামিল উদ্দিন সুযোগ বুঝে এক বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করলেন এবং আশ্চার্যজনক ঘটনা হলো সেই প্রস্তাব সর্ব সম্মতিক্রমে আবার পাশও  হয়ে গেলো। ঘটনাটি হলো, জামিল উদ্দিন সবিস্তারে এই বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের হত দরিদ্র মানুষদের  দুর্গতির কথা উল্লেখ করে বলার চেষ্টা করছিলেন কিভাবে ওদেরকে হেল্প করা যায়। জামিল উদ্দিন জানালেন, এখানে এই প্রবাসে পরিচিত অনেকেই দেশে টাকা পাঠিয়ে বিশ্বস্থ লোকজন দিয়ে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষদের মাঝে খাবার দাবার , ক্যাশ টাকা, জামা /কাপড় ইত্যাদি বন্টন করছেন। জালাল উদ্দিনকে অবাক করে স্ত্রী রুবিনা বললেন:
 একেতো লক ডাউন অবস্থা, তার মধ্যে সামনে ঈদ বাংলাদেশে তোমার সিরাজ আলীকে কিছু টাকা তো পাঠালেই পারো। ও, এই অবস্থায় দরিদ্র মানুষদের হেল্প করতে পারবে। রুবানার এই  আকস্মিক সম্মতিতে জামিল উদ্দিন সাহেব কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন । এক সাথে চব্বিশ বছর ঘড় করেও মহিলাটিকে ঠিক ভালোভাবে চেনা হলো না। আসলে মনে হয়, প্রত্যেক মানুষের যত কঠিন রূপ ই থাকুক না কেন, এর আড়ালে আরেকটি কোমল রূপ লুকিয়ে থাকে। মানুষের মন অনেকটা উদ্ভিদের বীজের মতো । একটু উপযোগী পরিবেশ তথা মাটি, আলো, পানি পেলেই তর তর করে বেড়ে উঠে।

তমাল ও তিন্নি বললো: ‘বাবা, এটাতো খুবই ভালো উদ্যোগ, আমাদের বন্ধুদের বলবো সবাই কিছু কিছু করে দিলে এক সাথে একটি ভালো এমাউন্ট দাঁড়িয়ে যাবে। ছোট মেয়ে পলিন ব্যাপরটি ঠিক বুঝতে পারলো না, তবে বাবা যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন।  

জামিল উদ্দিন বুদ্ধি করে স্ত্রী রুবিনাকে ট্যাগ করে ফেসবুকে এক আবেদনময়ী পোষ্ট দিলেন। এ ছাড়াও,  পরিচিত বন্ধু/বান্ধবদের কাছে বলে কয়ে ফান্ড সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া শুরু করলেন।  তমাল ও তিন্নিও নিজ নিজ পরিচিত সার্কেলে গণসংযোগ শুরু করলো। সবার সফল  প্রচেষ্টায়  ঈদের সপ্তাহ দুয়েক আগে ফান্ডে  দুই হাজার চার শত নব্বই ডলার উঠলো, বাংলাদেশের টাকায় প্রায় লাখ দেড়েক টাকা যা পুরোটাই দেশে পাঠানো হলো।

চান রাতে অর্থাৎ ঈদের আগের দিনের রাত্রে জামিল উদ্দিন সাহেবের বাসায় সবার মাঝে বেশ উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে ।  জামিল উদ্দিন আগে থেকেই মাত্র পঁচিশ ডলার খরচ করে একটি বিশেষ ব্যানারের অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন। সন্ধ্যার দিকে, জামিল উদ্দিন বাচ্চাদের নিয়ে ব্যানার পিক আপ করলেন। চার ফুট বাই তিন ফুট কাপড়ের ব্যানারে বিরাট করে বাংলায়  ও ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ‘ঈদ মোবারক’ । বাসায় এসে বাচ্চারা মহা উৎসাহে  জালাল উদ্দিনের গাড়ির বাম দিকে ব্যানারটি যত্নকরে ফিতা দিয়ে আটকাচ্ছে। এর মধ্যে আবার ডলার ষ্টোর থেকে বেশ কিছু বেলুন ও লাল/নীল ঝলমলে কিছু সাজানো সরঞ্জামাদি কেনা হয়েছে যা দিয়ে গাড়ি সাজানো হচ্ছে। ল্যাপটপ থেকে কানেকশন নিয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো বড় টেলিভিশনে  ইউটিউবে হাবিবের বাংলা গান  ” মায়া লাগাইছে .. দিওনা বানাইছে …… গান বাজছে। জামিল উদ্দিন সাহেবের বাড়িতে চান রাতের আনন্দ যেন উপচে পড়ছে। রুবিনা মেয়ের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দেয়ায় ব্যাচারা গাড়ি সাজানো কাজে অংশ গ্রহণ করতে পাচ্ছে না। রাত প্রায় এগারোটার মতো বাজে। রুবিনা ঈদের রান্নার একফাঁকে চা বসিয়ে ঈদের এডভান্স রান্না নিয়ে ব্যাস্ত। জামিল উদ্দিন ফিস ফিস করে বাচ্চাদের নিয়ে আগামীকালের অর্থাৎ ঈদের প্ল্যান করছেন। । প্ল্যানটি হচ্ছে: আগামীকাল অর্থাৎ ঈদের দিন বাড়িতে ঈদের নামাজ শেষে নাস্তা খেয়ে গাড়ি দিয়ে জামিল উদ্দিনের বন্ধুদের বাড়ির দিকে যাওয়া হবে। পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়িতে হর্ন দিয়ে, গাড়ির জানালা নামিয়ে সমস্বরে বাঁশি বাজিয়ে , ঝুনঝুনিতে শব্দ করে ঈদ মোবারক ধ্বনি দেয়া হবে, কিন্তু গাড়ি থেকে কেউ নামবে না। যাদের বাড়ির সামনে যাওয়া হবে তারাও আবার তাদের গাড়িতে উঠবে। এভাবে মোটামুটি ৭/৮টি বাসায় যাওয়ার পরে ৭/৮ টি গাড়ির বহর নিয়ে টরেন্টোর বাঙ্গালী পাড়ার মেইন রাস্তা ডানফোর্থ দিয়ে কিছুদূর গাড়ির হর্ন বাজিয়ে, হুইসিল বাজিয়ে মাতামাতি করে যে যার বাড়িতে চলে যাবে।

এই প্লানের ব্যাপারটি রুবিনার কাছে গোপন রাখা হয়েছে, পাছে সব ভেস্তে এই ভয়ে। রুবিনাকে বলা হয়েছে গ্যারেজে সবাই মিলে গাড়ি ক্লিন করছে। পলিন কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মা যদি ভুলেও গ্যারেজের দিকে আসে তবে দৌড়ে এসে সবাইকে সংবাদ দিয়ে যাবে, সেই সাথে সবাই সাবধান হবে। কিন্তু বাচ্চা মেয়ে পলিন উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে মা কে সব বলে দিয়েছে। তবে, মা কে যে বলে দিয়েছে সেটা আবার কাউকে বলেনি। ওদিকে, রুবিনার সবকিছু জেনেও না জানার অভিনয় করে যাচ্ছে কারণ প্ল্যান টি রুবানার মনে ধরেছে।  প্রায় দুই মাস ধরে লক ডাউনে ঘড়ে বসে থেকে মানুষটা মনমরা হয়ে আছে, একটা দিন বাচ্চাদের নিয়ে, বন্ধুদের নিয়ে একটু হৈ চৈ, মজা করলে অসুবিধা কোথায়।

বিয়ের পর থেকে রুবিনা দেখে এসেছে তার স্বামী জামিল উদ্দিন বেশ আমুদে টাইপের মানুষ। একবার বিয়ে পর পর তাকে ইমপ্রেস করার জন্য টাকা দিয়ে কোথেকে এক সাপুড়িয়া মহিলাকে বাসায় ধরে এনেছিল। উঠোনে গোল হয়ে বাড়ির লোকজন, পাড়াপ্রতিবেশীরা পরম আগ্রহে মহিলাটির সাপের খেলা দেখছে। বাড়ির ছোটরা সাপ দেখে ভয় পেয়ে মরা কান্না। এদিকে সাপুড়িয় মহিলাটি সাপের খেলা দেখানের চেয়ে দাঁত ব্যাথার ঔষুধ ও দাঁতের মাজন বিক্রির দিকে মনোযোগ বেশী। মহিলাটি কলার পাতার উপর কতগুলি কিলবিল করা ছোট ছোট পোকা রেখে সবাইকে গানের সুরে সুরে বলছে, ‘এই দেখেন এই পোকাগুলি দাঁত থেকে বের করেছি, এগুলি আমাদের দাঁতে বাসা বেঁধে থাকে তাই দাঁত ব্যাথা করে।’ এসব আজগুবি কথা বার্তা শুনে রুবিনার শশুর, গার্লস স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক জনাব ইমতিয়াজ উদ্দিন ছোটোখাটো একটি লাঠি নিয়ে তেড়ে আসলেন সাপুড়িয়ার দিকে। হুড়মুড় করে যে যেদিকে পারলো দৌড়। জামিল উদ্দিন বাবার ভয়ে তাড়াহুড়া করে দৌড়াতে যেয়ে উষ্টা খেয়ে পরে ঠোঁট কেটে যা তা অবস্থা। ওসব কথা মনে করে রুবিনার আজোও হাসি পায় । তো সেই মানুষটা এই লকডাউনের মধ্যে একেবারে নেতিয়ে গেছে। একটা দিন ছেলে মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে একটু চেঁচামেচি, আনন্দ উল্লাস করুক, তাতে ক্ষতি কি।

রুবিনা চা সাথে কিছু সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি, চানাচুর পেঁয়াজ দিয়ে মেখে সবাইকে খেতে ডাকছে :
-তোমাদের গাড়ি ক্লিন হলো ? আমার রান্না শেষ হতে আরো কিছুক্ষন লাগবে, তাই ভাবলম সবাই মিলে চা টা খাই, কাল কে তো আর কাজ নেই, ঈদের ছুটি। জামিল উদ্দিনের চোখ খুশিতে ঝলমল করে উঠলো, কারণ গ্যারেজে আরো কিছু কাজ বাকি। ব্যানারটি গাড়িতে টাঙানোর সময় ঈদ মোবারক লেখার ‘ক’ বর্ণ টি লেপ্টে গেছে, তমাল ওই জায়গায় নতুন করে কালার পেন দিয়ে ‘ক’ লেখার আগে চুনের মতো হোয়াইট-আউট দিয়ে মুছে তাড়াতাড়ি শুকানের জন্য ব্যানারের ওই অংশে সমানে বাতাস দিচ্ছে । রুবিনার কাছে তো এতসব বলা যায় না। জামিল উদ্দিন রুবিনাকে বানিয়ে বানিয়ে বললেন:
গাড়ির ক্লিন মোটামুটি কমপ্লিট, শুধু পিছনের সিট ভ্যাকিউম করলেই হয়ে যাবে, কি বলিস তিন্নি, পলিন ?’

পলিন বাবার এই অভিনয়ে অভিভূত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে, ওদিকে রুবিনাও অভিনয় করে বললেন :
তাড়াহুড়া করার কি আছে, চা টা খেয়ে খেযে আবার সবাই মিলে হাত লাগাও তাড়াতাড়ি গাড়ি ক্লিন প্রজেক্ট শেষ হয়ে যাবে ।

সংসার হচ্ছে খুব ইন্টারেস্টিং একটি যায়গা। এখানে অনেক সময় সবাই জেনে বা না জেনে নিজ নিজ সুখের জন্য অহরহ দক্ষতার সাথে অভিনয় করে চলে। অভিনয়ে একটু এদিক থেকে সেদিক হলেই সংসারে অশান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে । তবে আজ এ মুহূর্তে লক ডাউনের এই চান রাতে একটুখানি সুখ শান্তি, মজার জন্য এতটুকু এই অভিনয় করার জন্য রুবিনার কোনো সংকোচ হয় না।

টরেন্টোতে সামার প্রায় এলোবলে। এখন তাপমাত্রা ১০ থেকে ২০ এর মধ্যে চলে এসেছে। বাহিরে বের হলে এখনো হালকা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বের হতে হয়। আজ এই চান রাতে, রুবিনার শখ মেটাতে বাড়ির সবাই মিলে বাড়ির সামনে পাড়ার মধ্যেই রাস্তায় গল্প করতে করতে হাঁটাহাঁটি করছে। পরের দিন ঈদ, সকালের উঠার তাড়া নেই। কৃষ্ণ পক্ষের রাতে বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। দুই একটি বাড়ির সামনের লনে ঘাসের মধ্যে সাদা সোলার লাইট টিম টিম করে জ্বলছে । জামিল উদ্দিন প্রবল আগ্রহ নিয়ে তার ছেলেবেলার চান রাতের গল্প বাচ্চাদের বলছে। বাচ্চারা গোগ্রাসে বাবার কথাগুলি গিলছে। স্বামীকে নিয়ে রুবিনার মাঝে মাঝে হিংসা হয়। এই সহজ সরল মানুষটির একটি অদ্ভুৎ ক্ষমতা রয়েছে। নিজের যত দুঃখ কষ্টই থাকুক, সব ভুলে সহজেই আনন্দ ফুর্তিতে মেতে থাকতে পারে। রুবিনা এটি পারে না। যেমন এই মুহূর্তে রুবিনার ছোটবেলার এক চান রাতের কথা হটাৎ করে মনে পড়লো।

অনেক ভাইবোনের অভাবের সংসার। ঈদের নতুন কাপড় কেনার বাবার সামর্থ নেই। তেরো বছরের ছোট ভাই মন্টু জেদ ধরেছে নতুন কাপড় কিনে দিতেই হবে। বাবা পাড়ার মানিক দর্জি কে হাত পায়ে ধরে নিজের প্যাণ্ট ছোট করে মন্টুর জন্য প্যাণ্ট বানিয়ে দেয়ার জন্য রাজি করিয়েছে। চান রাতে, অনেক রাত পর্যন্ত মন্টু দর্জির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে রাত এগারোটার দিকে দিকে বাসা এসে, সেই প্যান্ট নিয়ে কি যে আনন্দ !বাসায় কোনো ইস্ত্রি নেই । রুবিনার বুদ্ধিতে মন্টু সেই প্যান্ট ভাঁজ করে বালিশের নিচে সারা রাত রেখে দিয়েছে। মন্টু একটু পর পর বালিশ তুলে তার তথাকথিত নতুন প্যান্ট এর দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় । কখন সকাল হবে, সে ওই প্যান্ট পরে বন্ধুদের বাসা যাবে। মন্টুর সেই চক চকে আনন্দিত মুখ রুবিনার এখনো স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠে। রুবিনার খুব ইচ্ছা করে স্বামীর মতো নিজ জীবনের দুঃখ দুর্দশার দিনের কথা ভুলে এই চান রাতে বাচ্চাদের নিয়ে আঁনন্দে মেতে থাকতে। নিশুতি রাতের নিস্তব্দতা ভেঙ্গে গুন গুন করে গানের মাঝখান থেকে রুবিনা গেয়ে উঠে :

আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা..

——————————————————-

পাঠক, মাত্র ২৪ ঘণ্টা পরেই, গল্পটির মূল অধ্যায় বা ঈদের বিশেষ আকর্ষণীয় মুহূর্তের বিষয়াবলী দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখিত হবে। চোখ রাখুন আমাদের প্রিয় পরবাসী ব্লগে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅন্যরকম ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধঈদুল ফিতর ও কোভিড ১৯
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন