এবছরের শুরুর দিকে রাইফেল স্কয়ারে হাঁটছিলাম কিছুটা উদ্দেশ্যহীন ভাবে । উদ্দেশ্য সামনে যদি ভাল কিছু চোখে পড়ে কিনবো। আসলে ঐ সময়ে আমার কোন কিছুই দরকার ছিল না। কিছুটা অলস সময় পার করা আর কি! আমার পথের অন্য পাশ দিয়ে লোকজন হেঁটে যাচ্ছে যার যার নিজেস্ব ভাবনা নিয়ে । আমি মনে হয় কিছুটা অন্যমনস্কই ছিলাম । তাই সব কিছু চোখে পড়লেও আসলে কিছুই দেখছিলাম না। এমনি সময় একজন খুব সুন্দরী মহিলা আমার নাম ডাকাতে আমি থমকে দাঁড়াই। সে বলতে থাকে “ আরে তুমি রুপা না ?’’ আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়তেই তিনি আমার হাত ধরে বলতে থাকেন “ তুমি আমাকে চিনতে পার নাই?” হঠাৎ করেই যেন আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। দেখি আমার স্কুলের বান্ধবী লুনা। আমি প্রায় চিৎকার করে বলি চিনবো না মানে ? তুমি লুনা ? হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছিলে আমাদের ছেড়ে । তাই না? আমি জড়িয়ে ধরি ওকে । লুনা হাসছে আমার কথা শুনে। বলে তোমার সময় আছে? চল একসাথে বসে কফি খাই। এতদিন পর স্কুলের বন্ধুকে দেখতে পেয়ে আমি আপ্লূত । আমরা পা বাড়াই ফুট কোর্টের একটা নিরিবিলি টেবিলের দিকে। লুনা আমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে একের পর এক। কোথায় আছি ? কেমন আছি? কি করছি? বাচ্চারা কত বড় ? কর্তা কি করে? ইত্যাদি , ইত্যাদি। আমি বলি আরে থামো থামো । একটা একটা করে উত্তর দেই । ও হাসে আগের মত মিষ্টি করেই । আমাদের কফি এসে যায় সাথে ফুচকা। আমি ফুচকা মুখে দিতে দিতে বলি ক্লাশ নাইনে থেকে তুমি হঠাৎ হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে কেন? শুনেছিলাম তুমি কোন এক নায়কের সাথে পাড়ি জমিয়েছিলে। এখন কেমন আছো তোমার স্বপ্নের নায়কের সাথে? আমার প্রশ্ন শুনে লুনার হাসিমাখা মুখটায় কেমন যেন বিষণ্ণতার ছায়া পড়ে । আমার খুব মায়া লাগতে থাকে ওর দিকে তাকিয়ে । আমার মনে হয় লুনা কথা গুছাচ্ছে মনে মনে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে “ যা শুনেছিলে সেটা ঠিকই শুনেছিলে। আমি খুব ছোট ছিলাম তখন। আবেগকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারিনি বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমাদের প্রতিবেশি এক ছেলেকে। সে অতটা লেখাপড়া করেনি। বেকারই বলতে পারো। আমার বাবা মা সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না । তারা প্লান করে আমাকে বাড়ীতে নিয়ে আসে। আর বুঝাতে থাকে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে । আর ঐ ছেলেকে শর্ত দেয় আবার পড়াশুনা শুরু করার । কিন্তু তার পক্ষে পড়াশুনা করা সম্ভব ছিল না । ওদের বাড়ি থেকে প্রেসার ছিল ওকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার । সব মিলিয়ে আমাদের বিয়েটা এক বছরও টিকেনি । তারপর বাবা মা পছন্দ করে আবার বিয়ে দেয়” কথাগুলো বলতে বলতে লুনা কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় । ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় । আমি জানি ও ঐসময় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না নিজের ফেলে আসা অতীত ছাড়া। আমি ওর হাত ধরে ঝাকুনি দেই। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে বাদ দেই এসব । তুমি তোমার কথা বল ? আমি বলি “ কাজ করছি একটা স্কুলে । বাচ্চাদের পড়াই । থাকি শ্যামলী স্কুলের পাশেই । স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে । টুকটাক করে চলে যাচ্ছে দিন।” লুনা আমার বর আর বাচ্চার ছবি দেখতে চায় । আমি মোবাইল থেকে দেখাই ওকে । ও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে । এভাবে কথা বলতে বলতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে টের পাইনি। আমার বাসায় ছোট বাচ্চা তাই দুই বন্ধুর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিয়ে পা বাড়াই যার যার গন্তব্যে ।
এরমাঝে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। কাজের ব্যস্ততায় লুনার কথা প্রায় ভুলেই গেছি । ছুটির এক ক্লান্ত দুপুরে আমার ছেলের পাশে শুয়ে শুয়ে গল্প পড়ে শুনাচ্ছি । এমন সময় মোবাইল বেজে উঠে। কিছুটা অলস ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি লুনার নাম্বার । হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হাসিমাখা স্বরে প্রশ্ন আসে “ কেমন আছো বন্ধু ? তুমি কি ফ্রি আছো? তোমার ছেলেকে নিয়ে চলে আসো আমার বাসায়। দুই বন্ধু একটু আড্ডা দেই । আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো লুনা ভাল নেই । আমি আমার ছেলেকে তার বাবার কাছে রেখে দ্রুত রেডি হয়ে রওয়ানা দেই ওর মিরপুরের বাসায় । আসলে লুনার কথা বলার ধরনে এমন কিছু ছিল আমি ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। আমি যখন রিক্সা থেকে নামি দেখি ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার জন্যই অপেক্ষা করছে । আমি কলিং বেল টিপার আগেই ও দরজা খুলে দিয়ে আমাকে নিয়ে যায় বসার ঘরে । ওর দুইরুমের বাসা । একটা বেডরুম আরেকটা ড্রয়িং রুম । আমি ওকে জিজ্ঞেস করি বাসার আর মানুষ কোথায় ?” ও বলে আর মানুষ কোথায় পাব এই বাসায় থাকি আমি আর আমার মেয়ে। ও তো এসময় বাসায় থাকে না । সে টিউশনি করতে গেছে । আমি যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। তোমাকে তো সেদিন বলা হয়নি আমার হাসবেন্ডের সাথে আমার সম্পর্ক নেই । আমি আমার মেয়েকে নিয়ে ছোট এই বাসাতে থাকি । ওর বাবা নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করে আলাদা থাকে । তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর আমার কি যে ভাল লেগেছিল তোমাকে সেটা বোঝাতে পারবো না । আমার মনে হচ্ছিল অনন্ত একটা বন্ধুকে পেলাম যার সাথে আমার কথাগুলো শেয়ার করতে পারবো। আজ সকাল থেকে মন এতটা খারাপ লাগছিলো । হঠাৎ তোমার কথা মনে হওয়াতে ফোন করলাম। লুনা কথা বলছে আর আমার জন্য একগাদা খাবার রেডি করছে । আমি বসে বসে ওর সাজানো বাসাটা দেখছি । আর মনে মনে তৈরি হচ্ছি লুনার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্বিষহ দিনগুলোর গল্প শোনার । লুনা চা নাস্তা রেডি করে আমার পাশে বসে । আমি দেখি এত সাদামাটা ভাবে ঘরের আটপৌঢ়ে কাপড়েও লুনাকে কেমন দেবী দেবী লাগছে । আমি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলি তোমার স্বামী কেন এমন করলেন? লুনা চায়ের চিনি মেশাতে মেশাতে বলে সবই ভাগ্য। আমি তখন কেবল কলেজে ভর্তি হয়েছি । তার ছয় মাস আগেই জাহিদের সাথে আমার ডিভোর্সটা হয় । আমার বাবা মা কেন যেন আমাকে নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে দিন পার করতেন । এর মধ্যে এই ভদ্রলোক বিয়ের প্রপোজাল দেয় । পরিবারের সবাই ভাবে ব্যবসায়ী , বউ মারা গেছে । বয়স একটু বেশি তাতে কি! আমার জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটবে যেহেতু আমার একটা অঘটন ঘটে গেছে । সবদিক বিবেচনা করে গার্জিয়ানরা ভাল ছেলে হাত ছাড়া করতে চায়নি। আমার বিয়েটা হয়ে যায় । বিয়ের এক বছর পর্যন্ত সে ভালই ছিল । আমার মেয়ের জন্ম হয় । আর তারপর ্থেকেই দেখতে পারি তার আসল চরিত্র। বয়স আমার চেয়ে দ্বিগুনের বেশি হওয়ায় সে আমার সব কাজেই ভুল ধরতো । বাইরে গেলে আমার দিকে খুব বিরক্ত মুখে তাকিয়ে থাকতো আমি কারো দিকে তাকাই কিনা । সে গাড়িতে বসেই আমাকে এমনভাবে মারতো যে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না আমার কি হচ্ছে । আমি কাউকে কিছু বলিনি এইভেবে যে কেউ আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করবে না । কারন সে মানুষের সামনে এমন সুন্দর অভিনয় করতে পারতো সবাই ভাবতে বাধ্য হত এরচেয়ে বৌ পাগল মানুষ আর হতে পারে না । বাচ্চাটাও ছোট বলে বছরের পর বছর সহ্য করেছি । তার বাইরেও মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল । এদিকে আমার মেয়েটাও বড় হচ্ছিলো । দিন দিন তার বাবার অত্যাচার বাড়তেই থাকে আমার উপর । ফোন আর ম্যাসেঞ্জারে তার বান্ধবীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে । এক পর্যায়ে সে ঘোষণা করে সে আবার বিয়ে করেছে । এমন অবস্থায় আমার মেয়ে আমাকে বলে তার বাবার থেকে আলাদা থাকতে । ওর ধারনা হয় এভাবে থাকতে থাকতে একসময়ে আমি পাগল হয়ে মারা যাবো । এরপর আমি আমার সাজানো এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসি । প্রথমে বাবার বাড়ি কিছুদিন থেকে নিজেকে একটু গুছিয়ে এই ছোট বাসাটায় উঠি । একটা মেশিন কিনে নিয়েছি । অর্ডার নিয়ে কাপড় সেলাই করে দেই । মেয়েটা এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে । পড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে আমাকে সাহায্য করে । এভাবেই চলে যাচ্ছে মা মেয়ের সংসার ।
আমি ওর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম অপলক দৃষ্টিতে । আর ভাবছিলাম আমার বয়সী এতো সুন্দরী একটা মেয়ে দিনের পর দিন কি অমানবিক জীবন পার করছে । প্রথম জীবনের একটা ভুলের মাশুল সারাজীবন দিয়ে যাবে ? মানতে খুব কষ্ট হয় । পরিবেশ স্বাভাবিক করতে লুনা বলে কই তুমি তো কিছুই খাওনি । একটু খাও তো আমার সামনে বসে । আমি হেসে ওর হাত ধরি । এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠে। লুনা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে “ঐ বুঝি অতুশি এলো ।” দরজা খুলতেই খুব সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে ঘরে ঢুকে । আমাকে সালাম দিয়ে আমার পাশে বসে । আমি জিগ্যেস করি ভালো আছো অতুশি ? তোমার নামটা তো অনেক সুন্দর । তুমি আমাকে চেনো ? অতুশি হেসে মাথা ঝাকিয়ে বলে আন্টি তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আম্মু তোমার কথা এতো বলেছে এজন্য তোমাকে আমার খুব চেনা লাগছে । সে আমার আর একটু কাছে এসে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে । আমি আস্তে আস্তে বলি জীবনটা অনেক সুন্দর লুনা । তোমার অতুশির মতো একটা মিষ্টি আর বুদ্ধিমতি মেয়ে আছে । কষ্ট করছো কিন্তু তুমি মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত আছো । তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়ে যাবে । আমি উঠার জন্য পা বাড়াই । দরজা খুলে আমাকে বিদায় জানায় লুনা আর অতুশি । একটু এগিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি ওরা হাসি মুখে হাত নাড়ছে । আমার মনটা কেমন করে উঠে । বুকের ভেতর থেকে যেন বলে উঠে এভাবেই হাসি মুখে মাথা উঁচু করে থেকো সারা জীবন। আর যেন কোন ভুলের মাশুল তোমাদের দিতে না হয়।