উগ্র জঙ্গিবাদী সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন অশেষ। অল্পের জন্য প্রানে বেঁচে গেছেন। চশমাটা ভেঙে গেছে। চোখের কাছাকাছি বেশ লেগেছে। প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরী বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরছিলেন। আচমকা থামতে হলো তাঁকে। জরুরী বিভাগের সামনেই একটি স্ট্রেচারে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এক অসহায় নারী। মুখ দিয়ে অনবরত ফেনা বের হচ্ছে এবং যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। নারীটির কষ্টের ধরন বা বেদনা কত ইউনিট-এর তা, অশেষের জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে একই রকমের যন্ত্রণা অশেষের ভেতরেও অনুভূত হচ্ছে।

নারীটিকে ঘিরে কয়েকজন স্বজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের চোখেমুখে শঙ্কা এবং ভয়। একজন বৃদ্ধা নারী বিলাপ করছিলেন,
-আমার মাইয়াডারে বাঁচান বাবারা! আমার মাইয়াডারে বাঁচান!

অন্য একজন নারী তাঁকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অশেষ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন যে,
-আমরা সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করবো নারীটিকে বাঁচাতে । বাকীটা আল্লাহর হাতে।
ডাক্তারের কথা শুনে অশেষে কিছুটা সস্থি এবং ভরসা পেলেন। হয়তো মহান আল্লাহ চাইলে এবং ডাক্তারদের আন্তরিক চেষ্টায় হায়াত থাকলে নারীটি বেঁচে যেঁতে পারেন। নারীটিকে জরুরী বিভাগের ওয়াশরুমে নেওয়া হলো। অশেষও অপেক্ষা করতে থাকলেন এবং মনে মনে দোয়া দরূদ পড়তে থাকলেন।

একজন মধ্যবয়সী নারী্র কাছে অশেষ জানতে চাইলেন,
-মা, কি করে এমন হলো?
নারীটি বিস্ময়ভরা চোখে অশেষের দিকে তাকালেন। তারপর বলতে থাকলেন,
-আর কইয়েননা বাপজান! কি এক ভাইরাস আইছে দুনিয়াতে, করোনা নাম। এই করোনা সব শেষ কইরা দিছে। মাইয়াডা আমার বইন-ঝি লাগে। একটা গার্মেন্টসে কাজ করতো। বালাই চলছিলো । ওর স্বামীও ভ্যান গাড়ী চালাইতো। এই ভাইরাসের কারণে হ্যার কাজ বন্ধ অইয়া গেল। জামাইডারও কাজ নাই। দুইডা পোলাপাইন। মাইয়াডার বয়স আট বছর এবং পোলাডার বয়স পাঁচ বছর। দের বছর ধইরাই আধপেটা খাইয়া কোনরকমে বাইচ্চা আছিলো। গত দুইদিন ধইরা ঘরে খাবার নাই। পোলাপান দুইডার ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পাইরা হেয় কীটনাশক খাইছে। মইরা যাইতে চাইছে।

অশেষ স্থির হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সবকিছুই যেন স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। এ আর এমন কি! এমন ঘটনায় যে পরিমাণ কষ্ট অনুভূত হওয়ার কথা, অশেষের তা হলোনা। কেননা চারপাশের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই কভিড-১৯ এর হিংস্র থাবায় দুমরে মুচরে গেছেন। অশেষের জীবনেও এর চেয়ে বেশি ঝর বয়ে গেছে এবং অবিরত যাচ্ছে। এখনও সেই ঝরের ভয়াল থাবায় অশেষ ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন।

নারীটিকে বেশ সাহসী মনে হলো। এই নারীটির জন্য অশেষ মনে মনে গর্ববোধ করলেন। কভিড-১৯ এবং সামাজিক অনাচারে জর্জরিত জায়গা থেকে নিজেকে মুক্ত করার একটি উপায় বের করতে পেরেছেন তিনি। অশেষ তো কিছুই করতে পারেনি। সব সইতে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। সাজাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহান মহান সব মানবিক নেতাদের ছড়াছড়ি। এই দৌড়ে কেউ পিছিয়ে নেই। কতো সব ডিজাইন করা ব্যানার, পোস্টার এবং দলীয় ক্ষমতাসীন নেতাদের ছবি দিয়ে ঠাসা! কত কত মানব কল্যানের ফিরিস্তি দিচ্ছেন তাঁরা। এসব দেখতে আর ভালো লাগেনা। এতো মিথ্যা আর অলীক কল্প কথা না দেখলেই ভালো। বিশেষ প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগ মাধমের পেজটি রেখেছেন অশেষ। এঁরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক সংযুক্তকারীদের সংযুক্তহীন করেছেন বন্ধুত্বের তালিকা থেকে । আরো করবেন। কেননা, এখন পর্যন্ত সত্যিকারের কোন মানবিক নেতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়নি অশেষে। এতো কপোটতা পৃথিবীর আর কোথাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

অশেষের একজন ভগ্নি সমতুল্য লেখক, অনুবাদক এবং কবি, দূরপরবাসে অবস্থান করে বিরতিহীন ভাবে মানবিক সব কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর অনুপ্রেরণায়ই অশেষ কিছুটা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। একবার অশেষ তাঁকে বলেছিলেন যে,
-আমি আর লিখতে চাইনা আপা।
এর জবাবে তিনি বলেছিলেন,
-ভাই, আমাদের ক্ষমতা যেহেতু সীমিত, তাই লিখে আমাদের কাজ করতেই হবে। থামলে চলবেনা। যদি আলো জ্বলে উঠে, এই ভরসায়।
-কিন্তু আমার লেখা কি কেউ পড়ে?
-নিশ্চয়ই পড়ে। সবার কাছ থেকে আপনি সবকিছু আশা করতে পারবেননা। তবে একদিন হয়ত নষ্টদের হাত থেকে সবকিছু মুক্তি পেতে পারে। আবার নাও পারে। তবুও কাজ থামিয়ে দেওয়া যাবেনা।

সেদিন সেই শ্রদ্ধেয় বোনটির কথায় অশেষের বুক শক্তিতে ভরে গিয়েছিলো। যদিও বোনটির সঙ্গে অশেষের আর যোগাযোগ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা কভিড-১৯ এর এলো-পাতারি দমকা হাওয়ার তোরে বোনটিও চিরদিনের জন্যে হাড়িয়ে গেছেন। তবুও অশেষ বোনটির সুখময় জীবনের জন্য প্রতিনিয়ত শুভকামনা করেন এবং আলো জ্বালানোর অদম্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

যদিও এখন পর্যন্ত অশেষের আলো জ্বালানোর সৌভাগ্য হয়নি। আর হবে কিনা অশেষ তা অনিশ্চিত। প্রতিটাক্ষণ অশেষ ঘৃণা আর অবজ্ঞাকে নিত্য সঙ্গী করে পথ চলছেন। এছাড়া আর কিছুই করার নেই।

আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে নারীটির অবস্থা জানার জন্য অশেষেকে! রাত বাড়ছে। বাড়ীও ফিরতে হবে। সকালে অফিস করতে হবে। কি আর করা, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাস্তায় পা বাড়ালেন অশেষ ।

(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন