সুমিত মাবাবা এবং ভাইবোনদের ভিজিটর ভিসা দিয়ে এনে রিফুজি হিসাবে দরখাস্ত করলেও অভিবাসন শুনানি তে দরখাস্ত বাতিল করে দিয়ে বলে ” তোমাদের কেসের কোনো সত্যতা নেই, তবে ব্যক্তিবিষয়ক সততার ভিত্তিতে আবেদন করার সুযোগ চেয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারো । এতে আরও বলা হয়েছে যে , তোমরা গত দুই বৎসরে এ দেশে এসে কোনো কাজ করো নি, শুধু সরকারি ভাতা নিয়ে সংসার চালিয়েছো । তোমরা প্রমান করতে ব্যর্থ হয়েছো যে এ দেশে থাকার যোগ্যতা অর্জন করলে, সরকারকে ট্যাক্স পে করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে । কমল,আরতি সোশ্যাল ভাতা নিয়ে কোন রকমে দুবেলা রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করে চলছে যদিও সুলতা এবং সুব্রত স্কুলে যায় ।
কোর্ট থেকে বের হয়ে কমল সুমিতকে বলে আমি দেশে ভালো ছিলাম, তুমি প্রলোভন দিয়ে আমাদের এখানে এনে ঝামেলায় ফেলেছো । দেশে আমি পূজা পার্বণ করে ভালো সময় কাটাতাম । আমি ঠাকুর বংশের লোক, আমার বাবা মহেশ ঠাকুরের জমি জমা, দালান কোঠা, পুকুর ভরা মাছ,গোলা ভরা ধান,বাগানে আম ,জাম,কাঁঠাল,লিচু,পিয়ারা , কলা সবই আছে । আমাদের বাগানে মৌমাছি , সারা বৎসর আমরা খাঁটি মধু পাই । জমির সরিষা ঘানিতে খাঁটি তৈল করে ঘরে রেখে দিয়ে সারা বৎসর খাই । বাজার থেকে একমাত্র কাপড়, লবন,চিনি ও সামান্য এটা সেটা কিনতে হয় । দেশে আমরা অনেক সুখে আছি । আমাদের গরু,হাঁস,মুরগি সবই আছে ,আমরা ডিম্ দুধ ঘরে পাই । বাড়ির আঙিনায় কাছ কলা, সবজি করে, তাজা সবজি খাই ।
আমাদের কিসের অভাব?
কমল বলে আমি বংশানুক্রমে ব্রাহ্মণ এবং সারা বৎসর পূজা পার্বণ করে এটা সেটা নিয়ে ঘরে আসি । পূজা ও অন্যান্য উৎসবাদী থেকে আনিত মিষ্টি আমার ঘর থেকে কখনও শেষ হয় না । তুমি কেন আমাদের পরামর্শ দিয়ে এখানে এনে বসিয়ে রেখেছো?
সুমিত বলে ,বাবা কাগজ হলে মা এবং তুমি দেশে চলে যাবে, সুব্রত এবং সুলতা এখানে থাকবে । কমল বলে, তুমি যে গ্রাউন্ড দেখিয়েছো, এতে কোনো দিন ও কাগজ হবে না, অযথা এখানে সময় নষ্ট করা । ওরা কি ভাবে রিপোর্ট বের করেছে, তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণ দেখিয়ে আমাদের এখানে এনে কাগজের জন্য দরখাস্ত করিয়েছো , আমাদের রেফিউজি হিসাবে দরখাস্ত করার কোনো গ্রাউন্ড নেই । এরা দেখো দেশ থেকে সব রিপোর্ট এনেছে, তুমি কাকে উকিল ধরেছো, সে উল্টাপাল্টা কেস লিখে দিয়েছে?
দেশে আমার ভাই প্রসন্ন এই সুযোগে গ্রামের পূজা পার্বণ ও জমি জমা নিজের নামে করিয়ে নেবে ।
বাবা এটা কি মগের মুল্লক যে সে চাইলেই আমাদের জমি জমা নিয়ে যাবে?
আরতি বলে সুমিত তুমি জানো না, তুমি পড়াশুনার জন্য বিদেশে চলে এসেছো, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তোমার কোনো ধারণা নেই । দেশে সব কিছুই দুই নম্বরি । সেটেলমেন্ট জরিপ আসলে একজনের জমি অন্য একজনের নামে উঠিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে । কয়েক বৎসর পরে বলে এই জমি আমার, এ ছাড়া গোপনে গোপনে আরও কত রকম সমস্যা করে । তুমি এবং আমরা ছেলে মেয়েদের নিয়ে এ দেশে এসেছি ওরা দেখো গিয়ে বাড়ির সব কিছু দখল করে বসে আছে । প্রসন্ন এবং তার ছেলেরা মনে করে ভগবান ওদের সুযোগ দিয়েছে, ওরা এখন সব কিছুর মালিক ।
সে দিন আমাদের প্রতিবেশী বাসুদেব চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে তোমার কাকা প্রসন্ন জমি জমার কাগজ পত্র নিয়ে তহসিল এবং উপজেলা AC ল্যান্ডের অফিসে ছুটা ছুটি করছে । হয়তো দেখবে আমাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবে, তাছাড়া আমরা দুই জন দেশে একা গেলে তোমার কাকার ছেলেরা আমাদের ঘরে ঢুকতে দেবে কিনা তাও সন্দহ ।
মা কাকা কি এত খারাপ লোক?
হ্যাঁ, সুমিত তুমি জানো না, সে ভালো কিছু করতে পারে নি, ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা দেয় নি, তবে খারাপ পরামর্শ দিয়ে মানুষের পিছনে লাগানোর ব্যবস্থা করে । আমাদের লোকজন নেই, সব সময় গাছের আম, নারিকেল, কাঁঠাল, লিচু এবং পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে যায় এবং ফিরে ও আমাদের দিকে তাকায় না । জোর যার মুল্লক তার এটাই দুনিয়ার নিয়ম চলছে ।
সুমিত তোমার মনে নেই , তুমি ওদের সঙ্গে স্কুল গিয়েছো, তোমাকে স্কুলে রেখে নৌকা নিয়ে চলে এসেছে । আমরা তোমাকে না দেখে চিৎকার করে বলি এই বর্ষার দিনে সুমিত কি করে আসবে?
শেষে হেডমাস্টার রহিম সাহেব তোমাকে এনে দিয়ে গিয়েছে এবং পরদিন থেকে আমরা আর তোমাকে ওদের সঙ্গে স্কুল পাঠাই নি ।
তোমার এ সব মনে নেই?
মা মনে আছে, তবু আমরা বিদেশে থাকি, আমাদের সঙ্গে ওদের অনেক তফাৎ, ওরা মূর্খ, পড়াশুনা করে নি আর আমরা পড়া শুনা করেছি, আমাদের সঙ্গে ওদের কোনোদিনও মিল হবে না । এই ছোট্ট জিনিসকে বড়ো করে দেখলে জীবনে আমরা কিছুই করতে পারবো না ।
সুব্রত ও সুলতা বলে দাদা তুমি ঠিকই বলছো ।
মা তুমি কি চাও আমরা বিদেশ ছেড়ে দিয়ে দেশে গিয়ে ওদের সঙ্গে ঝগড়া, মারা মারি করি ?
না, তা বলি না, তবে মনের দুঃখে এ সব বলি ।
সুলতা বলে মা তুমি শুচিতার সঙ্গে যে আচরণ করেছো, ওটা ঠিক হয় নি ।ওটা তোরা ঠিক বুঝোস নি, শুচিতা বেশি দেমাগী এবং সব কিছুতেই বেশি বাড়া বাড়ি করে । ও প্রকাশ্যে আমাকে বলেছে, আমরা গ্ৰাম্য ভুত, আচার আচরণ শিখিনি । ওর বংশের সঙ্গে আমাদের কোনো দিন কি মিল হতে পারে?
শুচিতার পূর্ব পুরুষ মুচি এবং বাবা শিপে খালাসির কাজ করতো । প্রীতম এবং আভা এ দেশে এসে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে জীবন শেষ করেছে, একমাত্র শুচিতাকে পড়াশুনা করিয়ে আমার ছেলের পেছনে লাগিয়েছে । সুলতা বলে মা ও সব জাত বংশ নিয়ে যারা বড়াই করে, ওরা স্রেফ মূর্খ লোক । মা, জাত বংশে না, কাজে মানুষ বড়ো হয় । দুনিয়াতে যত বড়ো বড়ো লোক দেখ, ওরা কঠোর পরিশ্রম করে বড়ো হয়েছে । তোমরা এ দেশে এসে সরকারি ভাতা খাও, কেস দিয়ে কাগজ বানাতে চেষ্টা করছো, আর ও দিকে বলো বড় বংশের লোক ।
তোমরা কি মূর্খ লোক?
সুলতা তোর এত বড়ো সাহস আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করিস । থাকগে মা আর তর্ক করবো না,তোমার জাত বংশের দেমাগে একটা সংসার ভেঙে যাচ্ছে ।
তুমি কি একবার ও ভেবে দেখছো?
হ্যাঁ, ভেবে দেখেছি ।
ভাইয়া বোকা মানুষ তোমার সামনে কোনো কথা বলে না, তুমি কি ভাইয়ার মুখের দিকে একবার ও তাকিয়ে দেখছো, সে কোন সুখে আছে?
সুমিতের সংসারের অশান্তির ব্যাপারে আমি কি করলাম, তোরা খামাখা আমাকে দোষারুপ করিস । শুচিতা নিজ থেকে আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে ।
আম্মু তুমি কি দেখেছো, আমাদের বাসায় একটা সুন্দর বিড়াল আছে, এটা সব সময় তোমার আমার পায়ে পায়ে হাঁটে । বিড়ালটা আমাদের আদর পায় বলে কাছাকাছি ঘুরে এবং সব সময় মেও মেও করে । তুমি এটাকে দু–চার বার তাড়িয়ে দেখবে, ওটা আর তোমার কাছে আসবে না । মানুষ ও এই ধরণের– ই, তুমি সব সময় সমালোচনা করবে, মেজাজ দেখিয়ে কথা বলবে ,দেখবে ও আর তোমার ধারে কাছে ও আসবে না । এমন লোক আছে, যারা খল–স্বভাবের , হয়তো দুই চার দিন বাহাদুরি নেয়, তাদের মানুষ এড়িয়ে চলে, এরা ভিতরে ভিতরে এ সব লোকদের খারাপ চোখে দেখে ।
বাহ্ তুই অনেক কথা শিখছিস তো । মা আমি তোমাকে সব সময় দেখি রাগারাগি করে কথা বলো, বাবা ততো রাগ করে না ।
আরতি বলে তোরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে দল বেঁধেছিস, এই বলে সে দুই চোখের জল মুছে । সুমিত এতক্ষন চুপ থেকে বলে, মা সুলতা যা বলে তা কিছুটা ও বটে । শুচিতা এবং তার মাবাবা তোমার সম্পর্কে নানাহ কথা বলে, কিন্তু বাবা সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলে না ।
বাহ্! তোরা যদি আমাকে পছন্দ না করিস, আমাকে মা বলে ডাকিস না । আমাকে বরং টিকেট কেটে দে, আমি দেশে চলে যাই । আমি তোদের জন্য কি কিছু করি নি?
মা তোমার সঙ্গে আমরা কেউ ঝগড়া করতে চাই না । আমি শুচিতাকে বহুদিন থেকে ভালো বেসেছি । তাকে বিয়ে করেছি, আমি এক ছেলের বাবা হয়েছি, এখন আমি স্যাম রাখি না , কুল রাখি এই অবস্থাতে আছি । আমি তোমাদের সামলাতে পারছি না, আবার শুচিতাকে ও ।
সুমিত অনেক দিন থেকে বেকার ,কিছু শর্ট কোর্স করতে ছিল , তাও শেষ পয্যন্ত স্টপ করে দিয়ে ঘরে চুপটি মেরে বসে আছে ।
কমল বলে, তুমি একা একা বসে কি সব ভাবছো?
সুমিত চোখ লাল করে কমলের দিকে তাকিয়ে কোনো কথার জবাব দেয় না ।
কমল বলে আমি এবং আরতি কানাডা থাকার কোনো দরকার নেই । আমাদের টিকেট কেটে দাও, আমরা দেশে চলে যাই । সুমিত বলে তোমরা দুইজন দেশে গেলে ইমিগ্রেশন কেস হালকা হয়ে যাবে, সুব্রত এবং সুলতার জন্য সমস্যা হবে এবং ওদেরকে দেশে চলে যেতে হবে । সুলতা বলে আমি এবং সুব্রত যত সমস্যায় পড়ি না কেন, দেশে ফেরত যাবো না । সুমিত বলে মানবীয় কারণে তোমাদের কেস চলছে, সিদ্ধান্ত না হওয়া পয্যন্ত হুট্ করে কিছু করা ঠিক হবে না ।
কমল বলে কাগজ হলে একবার গিয়ে বাড়িঘর জমি জমা ঠিক করে কাউকে দেখা শুনা করার জন্য রেখে আসবো । আরতি বলে আমাদের এখানে আর আসার দরকারই বা কি?
সুমিত বলে সিটিজেনশিপ না হওয়া পয্যন্ত তোমাদের এখানে থাকতে হবে । পরে তোমরা ইচ্ছা করলে দেশে চলে যেতে পারো এবং যখন ইচ্ছে আসতে পারবে ।
কমল বলে কবে আমরা কেস পাবো, তার পরে সিটিজেনশিপ?
তিন মন তেল ও পুড়বে না, রাধা ও নাচবে না । সে অনেক দিনের ব্যাপার । দেশে আমরা যা খেয়েছি, এখানে তার কিছুই পাচ্ছি না । এখানে আমাদের কে চিনে?
সুমিত বলে এখানে নিকটে কোনো মন্দির নেই. তা ছাড়া আমাদের কোনো গাড়ি নেই । অধর আংকেল মাঝে মধ্যে তোমাদের মন্দিরে নিয়ে যায়, সে ও আজকাল আসে না । কমল বলে অধর নিজের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, সে সপ্তাহে সাত দিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে ।
বিকেলে অধরা আন্টি রেস্টুরেন্ট থেকে যাওয়ার পথে কিছু খাওয়া ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে এসে ঘরের দরজা নক করে । সুলতা গিয়ে দরজা খুলে বলে আদাব,আন্টি আসেন । অধরা অনেক ধরণের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে এনে টেবিলে রেখে দিয়ে বলে আজ কয়েক দিন আসা হয় নি । গাড়ি ঠিক করতে কয়েক দিন সময় লেগেছে । আরতি বলে গাড়ি তো নুতন মনে হয় । না, পাঁচ বৎসরের পুরানো গাড়ি, এটা সেটা সব সময় ঠিক করতে হয় । এ কথা সে কথা বলে জিজ্ঞেস করে শুচিতা ও তার ছেলেকে দেখছি না । আরতি বলে শুচিতা আমাদের পছন্দ করে না, সে তার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে ।
ওমা এ কি কথা!
আর কি বলবো, সে অনেক কাহিনী । আজকালকার বউরা কারো সঙ্গে থাকতে চায় না । আমরা শ্বশুর শ্বাশুড়ি ননদ দেবর নিয়ে সেকালে থেকেছি, কারো সঙ্গে টু শব্দটি ও করি নি । কমলকে দেবতার মতো মান্য করে সব সময় চলেছি ।
তা করবেন না কেন, স্বামী তো দেবতার অবতার । তাছাড়া আপনার স্বামীর মতো এমন দেবতুল্য স্বামী পাওয়া ও তো অনেক ভাগ্যের ব্যাপার । কমল এ কথা শুনে মিচকি মিচকি হাঁসে ।
শুচিতা সুমিতের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে আঙ্গুল দেখিয়ে ঘর থেকে চলে গেছে । শুচিতার বাসায় দেশ থেকে তার আগের জানা শুনা এক বদমাইশ এসেছে এবং তাকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে ।
ওমা এ কি কথা গো?
হ্যাঁ, বোন দেখেন আমার ছেলে কত অসুস্থ, একসিডেন্টের পর থেকে সে ঘরে বসা, শুচিতা একটু খোঁজ খবর ও নেয় না ।
কোন লোক দেশ থেকে এসেছে?
প্রদীপ নামে এক ছেলে যার সঙ্গে শুচিতা আগে থেকে জানাশুনা ছিল ।
রাম রাম এ কি বলছেন গো !
কি আর বলবো সবই আমাদের কপাল ।
এতো কুলক্ষণ, কুলক্ষণ ।
আচ্ছা, আমরা উঠি, একটু তাড়া আছে ।
আপনি বসেন আপা চা খেয়ে যান । না আপা সারা দিন কাজ করে এসেছি আজ না, আর একদিন । আজতো চা খাওয়াতে পারলাম না, আর একদিন এসে খেয়ে যাবেন অবশ্যই ।
আচ্ছা আজ উঠি এই বলে অধরা চলে যায় ।
অধরা চলে যাওয়ার পর থেকেই সুমিত অসুস্থ বোধ করে, সে ঘাড় ও বুকে ব্যথা, শরীরে ঘাম,প্রচন্ড বমি ও নিঃশ্বাসে কষ্ট পাচ্ছে । বাসার সবাই অস্থির হয়ে বলে তোমার কি হয়েছে?
সুমিত বলে বুঝতে পারছি না শরীরে কেবল ঘাম দিচ্ছে এবং বুকে ব্যাথা অনুভব করছি । কমল কিছুক্ষন অপেক্ষা করে অবস্থা খারাপ দেখে ৯১১ কল দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ প্যারামেডিক নিয়ে এসে ওকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করিয়ে দেয় । ডাক্তার ও নার্স সাথে সাথে ট্রিটমেন্ট শুরু করে । ওরা বিভিন্ন প্রকারের টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয় যে সুমিতের সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং ইমিডিয়েট ওপেন হার্ট সার্জারি লাগবে । সুমিতের বাবা কমল অনুমতি দিলে ওকে সব কিছু রেডি করে পোস্ট অপারেশন রুমে নিয়ে ডাক্তার ও নার্স তৈরী হয়ে ওই রাতেই অপেরেশন করিয়ে নেয় ।
পরদিন খবর পেয়ে সুমিতের বন্ধু আজিজ ও মনিকা হাসপাতালে দেখতে আসে এবং শুচিতাকে জানায় যে তোমার স্বামী সুমিতের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং সে হাসপাতালে আছে । খবর পেয়ে শুচিতা, প্রীতম ও আভা ইমার্জেন্সিতে এসে খবর পায় যে সুমিতের অপারেশন হয়েছে এবং ICU তে আছে ।
আরতি শুচিতাকে দেখে হাউ মাউ করে কান্না জড়িত হয়ে রাগান্নিত সুরে বলে আমার ছেলের অসুখের জন্য তুমি দায়ী । তোমার জন্য আমার ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে, আজ অসুস্থ এবং যদি কিছু হয়, আমি তোমাকে তার জন্য দায়ী করবো ।
আভা বলে শুচিতা তুমি কোনো জবাব দেবে না, চুপ করে থাকো ।শুচিতা আরতি কে বলে মা তুমি কি ভাবে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করো ?
আরতি বলে তুমি পুরা পরিবারকে অসুস্থ করে তুলছো, ঘর ছেড়ে দিয়েছো, এমন কি তোমার ছেলেকে আমাদের কাছে আসতেও দাও না । শুচিতার মা আভা বলে, চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই, তা না হলে এখানে অনেক ধরণের কথা বার্তা হবে । শুচিতা একবার সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলে ভালো থেকো এই বলে আভা ও প্রীতমকে নিয়ে বাসায় চলে যায় ।
শুচিতা তার মা কে বলে তুমি খেয়াল করে দেখছো, আরতি কি ধরণের আচরণ করে ?
আভা বলে, এটা তোমার এবং আমাদের জন্য অনেক যন্ত্রনা দায়ক । ওরা আমাদের সহ্য করতে পারে না এবং সব সময় শত্রু ভাবে । শুচিতা বলে মা আমার শ্বাশুড়ি মানসিক রোগী এবং ওর আগে ট্রিটমেন্ট হওয়া দরকার । কিন্তু কে ওকে এই কথা বলবে?
মা এদের পুরা পরিবার কাউন্সেলিং দরকার । ওদের মাথায় এখনও বড়োছোট, জাতবংশ নিয়ে আছে । এদের কে এ সব বুঝাতে যাবে ?
এদের মুখের ভাষা এবং কথা বার্তার জন্য আমি আলাদা হয়েছি ।
প্রীতম শুচিতার ছেলে দ্রুবকে নিয়ে হাসপাতালের পার্কিং লটে গাড়িতে বসে ছিল, সে জিজ্ঞেস করে সুমিতকে কি দেখেছো?
আভা বলে ওকে এক নজর দেখেছি । ও শুচিতার সঙ্গে কথা বলেছে, কি বলেছে জানিনা । শুচিতা বলে ও পুরাপুরি এনেস্থেসিয়া কেটে উঠতে পারে নি । এখনও ঘুমে আছে, মাঝে মধ্যে চোখ খুলে এ দিক সে দিক তাকায় । আমাকে দেখে বলেছে তুমি কেমন আছো?
আমি বলেছি আমরা ভালো,তবে তোমার কি অবস্থা?
চোখ বন্ধ করে রেখেছে , কিছুই বলে নি । আমি শ্বাশুড়ি আরতির কথা শুনার কোনো দরকার মনে করি না । ও যা খুশি তাই বলুক, এতে আমার কিছু যায় আসে না ।
কমল,সুলতা এবং সুব্রত আমার সঙ্গে কথা বলেছে । দ্রুবকে নিয়ে গিয়েছি এবং বাবার সঙ্গে গাড়িতে রেখে হাসপাতালে গিয়েছি । ওরা কেউ ওর সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করে নি, আমি ও কিছুই বলিনি, না হয় আবার ঝামেলা হতো ওকে নিয়ে । আরতি যে ধরনের মানুষ হয়তো বলে বসতো দ্রুব আমাদের নিকট থেকে যাক আজ । আভা বলে এটা কি মগের মুল্লক যে সে বললেই দ্রুবকে দিয়ে দেব?
দ্রুব এখনো এক বৎসর বয়স হয় নি, সে মাকে ছাড়া কি ভাবে থাকবে?
মা, আমার শ্বাশুড়ি অনেক ঝামেলার মানুষ, ওকে কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না ।
প্রদীপ কাজ থেকে বাসায় এসেছে । সে সুমিতের হার্ট এট্যাক হয়েছে শুনে দুঃখ প্রকাশ করেছে । সে বলে সুমিতের এক্সিডেন্ট, হার্ট এট্যাক এ সব-ই দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে । লোকটা অনেক ভেঙে পড়েছে মন থেকে এবং সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে ।
প্রদীপ বলে শুচিতা এই অবস্থাতে তোমাকে ভেবে চিনতে দেখতে হবে কি করবে?
শুচিতা বলে আমার কি করার আছে, ওরা আমাকে কেউ সহ্য করতে পারে না । আরতি আমাকে দেখলে অমনি ঝগড়া শুরু করে এবং বলে আমার জন্য সুমিত এই অসুবিধায় পড়েছে এবং যদি ওর ভালো মন্দ কিছু হয় তারা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে । প্রদীপ বলে শুচিতা তুমি ভেবে চিনতে বিয়ে করেছো এবং সুমিতের লোকজন এসে সব ঝামেলা লাগিয়েছে ।
অধরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওর স্বামী সুশীলকে বলেছে সুমিত ভালো পরিবার দেখে বিয়ে করে নি । সে অতি নিম্ন বংশে বিয়ে করেছে, যে জন্য মিল হইতেছে না । সুশীল বলে কার দোষ কে বলবে, এরা এক রকম বলে, বাহিরের লোক অন্য রকম বলে । অধরা বলে তুমি কি শুনছো?
সুশীল বলে আমি যতটা শুনেছি, শুচিতা এবং ওর মাবাবা খুবই ভালো মানুষ । কিন্তু সুমিতের মা শুচিতাকে পছন্দ করে না । তাছাড়া এতগুলি লোক দুই কামরা বাসায় থাকে, সুমিতের কোনো ইনকাম নেই । শুচিতা সৰ কিছু সংসারের খরচ এবং বাসার কাজ করে, ওরা শুচিতাকে চাকর বাকরের মতো খাটায় । এ সব নিয়ে ঘরে মনোমালিন্য হচ্ছে, সুমিতের মা ইন্ডিয়া থেকে এসেছে এবং এ দেশের নিয়ম কানুন জানে না ।
অধরা বলে আমি শুনছি শুচিতা প্রদীপ নামে কোন ছেলেকে আগে থেকেই পছন্দ করে । সুশীল বলে তুমি এ সব বিশ্বাস করবে না, ওই ছেলে আমার দোকানে কয়েকবার খেতে এসেছে এবং আমি শুনছি ওকে সুমিত এবং তাদের লোক অযথা সন্দেহ করে ।
পরদিন প্রদীপ কাজ থেকে সরা সরি হাসপাতালে ICU তে গিয়ে সুমিতকে দেখে বলে তুমি কেমন আছো?
সুমিত বলে এই আর কি এনেস্থেসিয়া কেটে উঠেছি , প্রচন্ড ব্যথা ।
ডাক্তার কি বলে?
চারটা ব্লকেড পাওয়া গেছে এবং পায়ের থেকে শিরা (ভেইন) কেটে নিয়ে জোড়া লাগিয়েছে । সারা শরীরেই ব্যথা অনুভব করি । কবে নাগাদ ভালো হবো এবং ছেড়ে দেবে বলতে পারছি না । হাসপাতালে ডাক্তারের কেয়ার এ থাকলেই ভালো হবে । প্রদীপ অনেক সময় ওর কাছে বসে থেকে বলে তুমি ভালো হয়ে উঠবে এই আশা করি ।
প্রদীপ এর মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে একটা পুরানো টয়োটা গাড়ি কিনে নিয়েছে । আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে শুচিতাদের বাসায় এসে বলে আংকেল আমি সুমিতকে দেখে এসেছি । প্রীতম বলে সুমিত কেমন আছে?
ও কথা বলেছে এবং অপারেশন থেকে সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে, এ টুকু বলতে পারি । দ্রুব প্রদীপকে দেখে দৌড়ে এসে বলে আংকেল আসছে , খাওয়া দাও, হাত ধরে টেবিলে নিয়ে বলে বস, নানু আংকেলকে খাওয়া দাও ।
প্রদীপ বলে দ্রুব তুমি আমাদের নক্ষত্র যাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত ও থাকতে পারি না এবং বারবার ফিরে আসি । প্রীতম বলে সে সবার-ই প্রিয় এবং ওকে দেখলে আমরা সব কিছু ভুলে যাই । আমরা বাসায় না হেঁসে থাকতে পারি না । বিকেল হলে ওকে নিয়ে বাহিরে বাগানে বসে গল্প করতে হবে, সে আজকাল বাগানে কাজ করে এবং গার্ডেনে আমার সঙ্গে গাছে পানি দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে । আভা বলে ও বাসার সবাই-কে ব্যস্ত রাখে এবং কেউ বিনা কাজে বসে থাকতে পারে না । টেলিভিশনে ভালো প্রোগ্রাম হলে, সে এসে বলবে আম্মু, নানু তোমরা এস, বিশেষ করে খেলার প্রোগ্রাম হলে, সবার আগে হৈ, চৈ শুরু করবে ।
সে মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ভালো মন্দ সব কিছু বুঝে ।
কি বলছি দ্রুব ঠিক না?
ওই দেখো সে হাঁসে, যাও আংকেল কে একটু আদর করে এসো তার পরে খেতে এস । দ্রুব দৌড়ে গিয়ে প্রদীপকে আদর করে বলে আংকেল খেতে এস ।
প্রদীপ বলে সুমিত আস্তে আস্তে সুস্থ হলে শুচিতা তুমি কি ওকে নিয়ে আলাদা বাসা করবে?
শুচিতা বলে আমি ওকে নিয়ে কি ভাবে বাসা করবো, ওতো ওর মাবাবা ভাই বোন ব্যতীত থাকবে না । আভা বলে ওর মাবাবা ভাই বোন আছে যারা ওকে দেখা শুনা করবে । সুমিতের মা শুচিতাকে পছন্দ করে না, ওখানে গেলে শুচিতা অসুস্থ হয় ।
শুচিতা বলে সুমিত কে আমি হ্যান্ডেল করতে পারি, কিন্তু ওর মাকে আমি পছন্দ করি না । এই মহিলা ঝগড়া ব্যতীত আর কিছু ভালো শিখে নি ।তা ছাড়া সে আমার সামনে অন্য লোককে বলে সুমিত কি দেখে বিয়ে করেছে?
তুমি বলো, শুনলে কেমন লাগে আমার?
প্রদীপ বলে মানুষ কি সব সময় ঝগড়া করে?
যে সব লোকেরা কারণে অকারণে মানুষের সাথে ঝগড়া করে এরা উদ্দেশ্য মূলক ভাবে মানুষকে দাবিয়ে রাখে । এরা লুকানো স্বার্থের জন্য মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করে যাতে তাকে তার কৃত অপরাধ সম্পর্কে কিছু না বলতে পারে । আরতি ও সেই ধরণের লোক, সে মনে করে শুচিতা সরল সহজ লোক । লুটে পুটে তার রোজগার এবং তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবো । তাকে এমন ভাবে দাবিয়ে রাখবো যাতে কিছুই বলতে পারে না ।
পরদিন কাজের পর শুচিতা হাসপাতালে রেস্টুরেন্ট থেকে সুমিতের পছন্দের কিছু খাওয়া নিয়ে দেখা করতে যায় । সুমিত একটা চেয়ার এ বসা এবং ওয়ার্ডে ডাক্তার এসেছে, ডাক্তার সব কিছু রিপোর্ট এবং তার অপারেশন দেখে বলে আরও এক সপ্তাহ তোমাকে হাসপাতালে রাখতে হবে । শুচিতা পরিচয় দিয়ে বলে আমি সুমিতের স্ত্রী শুচিতা এবং জানতে এসেছি আমার স্বামীর কি অবস্থা?
ডাক্তার বলে ওর অবস্থা উন্নতির দিকে এবং আরও এক সপ্তাহ রেখে ছেড়ে দিতে পারি, বাসায় গেলে নিয়মিত ও ঔষুধ এবং দেখাশুনা করতে হবে ।
সুমিত ওকে দেখে আবেগে দুই চোখ সিক্ত হয়ে উঠে, বলে এতদিন পর তুমি আমাকে দেখতে আসলে । শুচিতা বলে আমি আরও কয়েকদিন এসেছি, তুমি ঘুমাচ্ছিলে বা তোমার মা আরতির সঙ্গে কথা বলতেছিলে সে জন্য চলে গেছি । আজ-ই তোমাকে একলা পেয়েছি , আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছি যে তুমি এক সপ্তাহ পর বাসায় যাবে ।
সুমিত বলে ডাক্তার তাই বলে এবং দুই সপ্তাহ বাসায় নার্স এসে আমার অপারেশন এর ঘা দেখে পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ পাল্টিয়ে দিয়ে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেবে । তুমি ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবে আমি খুব-ই আস্বস্ত হয়েছি । তোমার জন্য কিছু খাওয়া রেস্টুরেন্ট থেকে এনেছি, খেয়ে নাও । সুমিতকে খাওয়া খাইয়ে দিয়ে বলে আমি এখন যাই ।
সুমিত বলে দ্রুবকে কি একবার নিয়ে আসতে পারো?
উইকেন্ডে নিয়ে আসবো, ও নিজেও সারাক্ষন বাপ্পি বাপ্পি করে এবং তোমার দেয়া খেলনা নিয়ে খেলা করে । আচ্ছা, আমি এখন যাই বলে বাসায় চলে আসে ।
বাসায় আসার পর শুচিতা বলে আমি সুমিতকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম । আভা বলে ওর অবস্থা কি রকম দেখলে ?
ওর অবস্থা ভালোর দিকে এবং ডাক্তার মনে হয় আগামী সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে বাসায় যাইতে দেবে । প্রীতম বলে ও কোথায় উঠবে?
ও নিজের বাসায় উঠবে এবং সবাই আছে ওকে দেখার অসুবিধা হবে না ।
শুচিতা হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার পর সুমিত আস্তে আস্তে বেড থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহেরার মুখিমুখি হয়। সে অনেকদিন এ ভাবে নিজেকে দেখে নি। সে ভাবে তার চেহেরায় এককালে ছিল লাভলী সুদর্শন ভাব, যে-ই দেখতো,আর একবার ফিরে তাকাতো। আজ তার নিজের চেহেরা দেখে নিজের-ই কান্না পায়, ঘৃণা লাগে। বুকে অপেরেশনের কাটা ঘা এখনো শুকায় নি। পা থেকে অপারেশন করে শিরা(ভেইন) কেটে নিয়ে বুকে জোড়া লাগানো হয়েছে, তাও শুকায় নি। মুখে খোঁচা খোঁচা আধা কালো আধা পাকা দাড়ি, নিজেকে চিনতে পারছে না। সে বালিশে মাথা গুঁজে কান্না বন্ধ করতে চেষ্টা করছে।
ক্রমশ :