ললিত-কে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে যে আশ্রমে পাঠানো হয়েছে সেখানে আরও অনেকেই রয়েছে এবং সবাই মানসিক রোগী । রোগের তারতম্য অনুযায়ী কারও অবস্থা ভালো এবং কারও অবস্থা খারাপ । ললিতের মতো অনেকেই বেড পরিষ্কার করে না, বেড শিট পাল্টায় না, দুই সপ্তাহে ও একবার গোছল করে না, গা থেকে দুর্গন্ধ , বাহির থেকে ময়লা এটা সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আসে, শারীরিক দুর্গন্ধের জন্য কেউ কাছে ঘনাতে পারে না। পাশের বেডে শন নামে এক রোগী যার অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো, ললিতের সঙ্গে প্রতিদিন ঝগড়া করে । এ দিকে তার বেডে ছারপোকা হয়েছে, বাসা তেলাপোকা ভর্তি । ললিত রাতে ঘন ঘন লাইট জ্বালায় এবং রুমে শন ঘুমাতে পারে না ।এ নিয়ে প্রতিদিন অফিসে অভিযোগ করে আর কথা কাটাকাটি তো হয়-ই । শন বলে তুমি এই রুমে থাকলে আমি থাকবো না । ললিত বলে তোমার ভালো না লাগলে অন্যত্র চলে যাও । ললিত অসুস্থতার জন্য কিছুই বোঝে না এবং শন যা কিছু বলে সে কেয়ার করে না,ললিতের সে দিকে কোনো খেয়াল নেই । এক দিন দুইজন কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে হাতাহাতি ও হৈ হাল্লা শুরু করে । এ নিয়ে শন পুলিশ কল দিলে, পুলিশ এসে মানাজেমেন্টের সঙ্গে আলাপ করে ওকে অন্য রুমে সরিয়ে দিতে চাইলে,কেউ নিতে রাজি হয় না । মোট ১০ জন এই আশ্রমে থাকে এবং সবাই বিভিন্ন্য সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল থেকে এখানে এসেছে ।
কেউ সাদা,কেউ কালো,কেউ ভারতীয় এই ১০ জন বিভিন্ন রং বেরঙের লোক এক সাথে হাসপাতাল থেকে আশ্রমে পাঠানো হয়েছে । তাদের খাওয়ার ধরণ ভিন্ন যেমন কেউ হাতে,কেউ চামচ বা, কাঁটাচামচ ব্যবহার করে ,ভাষা এবং আচার আচরণ ও সম্পূর্ণ আলাদা । তাদেরকে নিয়মিত ঔষুধ দেয়া হয় । কিন্তু ললিতের মতো অনেকেই নিয়মিত ঔষুধ না নিয়ে ফাঁকি দিয়ে বলে ঔষুধ খেয়েছি ।
ললিত দিনে ঘরে থাকে না, একবার হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায় এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে তার চিকিৎসার পর দুই মাস প্রিয়ব্রতের বাসায় পাঠায় । প্রিয়ব্রত ও অদিতির অনুপস্থিতে ওকে দেখা শুনার জন্য বাসায় নার্স পাঠানো হয় । নার্স তাকে গোছল,খাওয়া, ঔষুধ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করানো থেকে দুই মাসের মধ্যে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে । সুস্থ হলে তাকে পুনরায় আশ্রমে পাঠায় ।
ললিত ডাইনিং টেবিল থেকে খাওয়া নিজের বেডে এনে রেখেছে এবং শন তাকে বাধা দিয়ে বলে তুমি বেড রুম পুরা গার্বেজ দিয়ে ভর্তি করে ফেলেছো । মানাজেমেন্টের লোক এসে বলে, তুমি ডাইনিং টেবিলে খাবে এবং বেডরুম সকাল বিকাল পরিষ্কার করবে । ললিত দিনের পর দিন অসুস্থ থাকে । ললিত বুঝতে পারে না তার কৃতকর্মে অন্যেরা অস্বস্তিবোধ করে । সে পাল্টা তর্ক করে বলে,আমি কি করি?
শন বলে তুমি যেভাবে রুম নোংরা করে রাখো, এখানে আমরা থাকতে পারবো না । কেউ ঘুমাতে পারে না স্বস্তির ভাবে । ওরা ৯ জন দরখাস্ত দিয়ে বলে ললিতকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে, নতুবা আমরা এখানে কেউ থাকবো না ।ম্যানেজমেন্ট অফিসের লোক বলে আমরা দেখে শুনে ওকে অন্যত্র পাঠাবো এবং তোমরা সে পযন্ত ধর্য্য ধারণ করো ।
পরদিন সে সকালে ঘুম থেকে উঠে কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারে না । সকালে নাস্তা,দুপুরে লাঞ্চ এবং রাতের খাওয়া ডাইনিং টেবিলে পড়ে রয়েছে । ম্যানেজমেন্ট অফিস থেকে প্রিয়ব্রতকে টেলিফোন করে জানানো হয়েছে যে ললিতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
নিমি, প্রিয়ব্রত ও অদিতি অস্থির হয়ে সারা শহর ললিতকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । কিন্তু এই ঠান্ডার দেশে কোথায় ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । অবশেষে দুইদিন পর ওকে এক পার্কে নোংরা কাপড় পড়া অবস্থায় ঘুরাঘুরি করতে দেখে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে । ডাক্তার ভালোভাবে টেস্ট করে দুইদিন রেখে আশ্রমে পাঠিয়েছে । কিন্তু সমস্যা হলো ও অন্যদের সঙ্গে মিলে- মিশে থাকতে পারে না । তাছাড়া অপরিষ্কার থাকে এবং বাহিরে যা কিছু দেখে তাই বাসায় নিয়ে আসে । সে রাতে ঘুমায় না, বেড থেকে উঠে এ রুম সে রুম ঘুরা ঘুরি করে । ডাক্তার বলে যে এটা তার ব্রেইনের সমস্যার জন্য হয়েছে এবং তাকে হাই পাওয়ারফুল ঔষুধ দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হচ্ছে ।
নিমি এবং প্রিয়ব্রত ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলে বাবাকে এ অবস্থায় ঘরে ফিরিয়ে আনা কোনোক্রমেই সম্ভব না । নিজেরা কাজ করে, ওকে কে ২৪ ঘন্টা দেখাশুনা করবে?
অদিতি বলে বাবা ওখানেই ভালো থাকবে এবং ডাক্তারের কেয়ার এ থাকলে ওরা প্রয়োজনে হাসপাতালে আনা নেয়া করতে পারবে । আমরা এ অবস্থায় বাবাকে ঘরে রেখে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবো না ।
২৪ ঘন্টা ঘরে বাবাকে কে দেখা শুনা করবে?
প্রিয়ব্রত বলে বাবাকে আশ্রমে রাখা ও সমস্যা , পয়পরিস্কার থাকে না, বাহির থেকে নোংরা আবর্জনা নিয়ে আসে । এ নিয়ে অন্যান্য লোকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝগড়া হচ্ছে ।
অদিতি বলে বাবাকে কোথায় রাখবে?
আশ্রমেই রাখতে হবে, এ ছাড়া কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না । তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন আবার বের হয়ে না যায় ।
নিমি বলে বাবাকে নিয়ে এই অশান্তি কতদিন সহ্য করতে পারবো ?
অদিতি বলে বাবাকে এক সময় দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে । ওখানে ভালো ট্রিটমেন্ট আছে এবং দেশের বাড়িতে লোকজন আছে যারা সর্বক্ষণ দেখাশুনা করতে পারবে। মাসে মাসে কিছু ডলার পাঠিয়ে দিলে সবাই দেখাশুনা করবে ।
কি বলো বৌদি, দেশে বাবার কে আছে?
মা মারা গেছেন,ভাইবোন আমরা এখানে থাকি, কে দায়িত্ব নিয়ে বাবাকে দেখাশুনা করবে?
বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন,আমরা নিষ্ঠুর হতে পারি না ।
প্রতিদিন এখানে একটা না একটা কিছু হচ্ছে । কতদিন এ ভাবে পেছনে পেছনে দৌঁড়াবে?
বৌদি আমি দাদার সঙ্গে আলাপ করবো ।
অদিতি বলে আমি তোমার দাদাকে বলেছি , সে ও এ ব্যাপারে চিন্তা করতেছে ।
নিমি সারা রাত ঘুমাতে পারছে না । পরদিন কাজে গিয়ে তার সহকর্মী নাহিদকে বলে শুনেছ অদিতি বাবা সম্পর্কে কি বলে?
নাহিদ বলে, কি বলে?
অদিতি বলে বাবা রোজ রোজ আশ্রম থেকে বের হয়ে যায়, এখানে সেখানে রাস্তা থেকে পুলিশ ধরে ফেরৎ আনে । এতে আমাদের ইজ্জতের হানি হচ্ছে । বাবাকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিতে বলে । নাহিদ বলে দেশে তোমাদের কে আছে দেখাশুনা করার জন্য?
মা মারা গেছেন, আমরা ভাই বোন এখানে থাকি । তোমার বাবা সারা জীবন তোমাদের জন্য কষ্ট করেছেন । শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় দেশে পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছে?
অদিতি এ সব আমাকে এবং দাদাকে ও বলতেছে ।
তোমার দাদা কথা না শুনলে বাসায় অশান্তি হবে । তার অবস্থা এক দিকে অসুস্থ বাবা, আর একদিকে স্ত্রী,দুই দিক সামলানো অনেক কষ্টকর । তাইতো দেখছি ।
নাহিদ বলে, তোমার বিয়ের কি হলো?
মানস কিছু সময় নিচ্ছে এবং ওর হাতে দেশে যাওয়ার মতো ডলার নেই । দুইজনের যাওয়া আসার খরচ এবং বিয়ের খরচ আছে ,যে জন্য দেরি করতেছে ।
ও কি তোমার বাবার বর্তমান অবস্থা জানে?
হ্যাঁ, জানে ।
ও বলে ওটা বাবার অসুস্থতা এবং আমাদের বিয়ে হলে বাবাকে আমাদের সঙ্গে রাখবে । তুমি ওকে বুঝিয়ে বলে ছোটো করে এখানে বিয়ে করে নাও এবং পরে দুইজনে দেশে গিয়ে অনুষ্ঠান করো । ঠিক আছে দেখি ওকে বলে ।
পরের সাপ্তাহিক ছুটিতে মানস এবং নিমি বাহিরে ঘুরতে গিয়ে সারাদিন কাটায় এবং এর–ই এক পর্যায়ে নিমি মানসকে বলে আমরা ছোটোখাটো করে বিয়ে পর্ব এখানে সেরে নিতে পারি কিনা?
মানস বলে কি ভাবে করতে চাও বুঝিয়ে বলো । নিমি বলে আমরা দুই পক্ষের কয়েক জন নিয়ে ছোট খাটো করে বিয়ে পর্ব সেরে নেবো । পরে এক সময় টাকা–পয়সা হলে দেশে গিয়ে বড়ো করে অনুষ্ঠান করবো ।
মানস বলে এটা এ ভাবে সম্ভব না, আমার লোকজন ইন্ডিয়াতে আছে এবং ওরা আমার মাবাবা আপন জন । ওদের বাদ দিয়ে নিজে নিজে বিয়ে করতে গেলে আমার মাবাবা অনেক দুঃখ পাবে । নিমি বলে আমার নিজের লোকজনও তো এখানে আছে, তুমি এবং আমি কি সবাইকে একত্র করিয়ে অনুষ্ঠান করতে পারি?
মানস বলে দেখো আমার কাছে টাকা পয়সা নেই যে এই মুহূর্তে দেশে গিয়ে বিয়ে করতে পারি । তাহলে এ ভাবে কতদিন ঝুলে থাকবো?
মানস হেঁসে বলে এই ধরো ৫ বৎসর । নিমি বলে আমি সিরিয়াসলি কথা বলছি, তুমি এটা হালকা ভাবে কেন দেখছো?
পকেটে ডলার না থাকলে কি করবো?
তোমার পকেটে কখনও ডলার জমবে না, আর তা হলে বিয়ে ও হবে না, এটাই কি তুমি বুঝাতে চাচ্ছো?
না, তা হবে কেন?
দেখো আমার বাড়িতে অনেক সমস্যা, অভাবী সংসার, বাবা জমি বিক্রি করে এবং লোকজনের নিকট থেকে টাকা ধার করে আমাকে পাঠিয়েছেন । পাওনাদার লোন পরিশোধ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে । আমি এই মুহূর্তে একটু ঝামেলায় আছি ।দেশে গেলে পাওনাদারের মুখামুখি হতে হবে, সে জন্য আমি দেশে যাওয়া দেরি করতেছি।
আচ্ছা এখন যাও, দেখি চিন্তা করে কি ভাবে কি করা যায় । নিমি চখের পানি ফেলে বলে তুমি গত তিন বৎসর আমাকে ঘুরাচ্ছ আর বলে যাচ্ছো যে বিয়ে করবে । এদিকে আমার দাদা ও বৌদি অন্যত্র ছেলে দেখেছে এবং আমাকে চাপ দিচ্ছে রাজি হতে ।
আমি কতদিন ওদের না করবো?
মানস কোনো কথার জবাব না দিয়ে বলে আমার একটু তাড়া আছে, আমি যাই ।
আজ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে । অনেক রাত, ঘুম আসছে না । নিমি বিল্ডিঙের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকাচ্ছে । সে অনেক দিন এই কানাডাতে এত সুন্দর চাঁদ দেখে নি । অনেক সময় সে বাহিরে চাঁদের সোনালী আলোর দিকে তাকিয়ে কত কি ভাবছে। তার মনে নেই পেছনে অদিতি কখন তার পার্শে দাঁড়িয়েছে । অদিতি হালকা ভাবে গায়ে হাত রেখেছে। সে হকচকিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে অদিতি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অদিতিকে দেখে নিমি বলে দেখো কি সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ । অদিতি বলে ছোটকালে আমি গ্রামে বাবার বাড়ি গেলে চাঁদের জোৎস্না ভরা রাতে বাহিরে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতাম । কি অপূর্ব সোনালী রং !
অনেক রাত হয়েছে,তোমার ঘুম আসে না?
আজ কেন যেন ঘুম আসে না । অদিতি বলে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই ।
কি বলবে?
মানসের সঙ্গে তোমার কি কোনো কথা হয়েছে?
বৌদি ওর আর্থিক সমস্যা সে জন্য দেরি করতেছে ।
নরেশ বাবু কলেজে শিক্ষকতা করে, তার সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব আছে । তোমার মনে নেই নরেশ নিলয়ের জন্ম দিনে আমাদের বাসায় এসেছিলো ।হ্যাঁ, মনে আছে । ওর সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা বলছি ।
বৌদি ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে?
নরেশ দাদা বয়েসে আমার চেয়ে অন্তত ১৫ বৎসরের ব্যবধান । ও দাদার চেয়ে ও ১০ বৎসরের বড়ো । আমার সঙ্গে উনার কোনো অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে না । উনি একজন প্রফেসর মানুষ, ওই লেবেলের কোনো শিক্ষিতা মহিলা ভালো মিল হবে ।
নিমি তুমি কি জানো না, দিলীপ কুমারের সঙ্গে সায়েরা বানুর বয়সের পার্থক্য কম পক্ষে ২১-২২ বৎসর ছিল । বৌদি তুমি কি বলছো আমি বুঝতে পারছি না । দিলীপ কুমার,সায়েরা বানু সিনেমা জগতের নায়ক নায়িকা, ওদের মধ্যে সিনেমা জগতে অনেক দিনের ভালোবাসা ছিল । আমার সঙ্গে নরেশ দাদার কোনো মিল নেই । উনি একজন শ্রদ্ধয় ব্যক্তি যাকে আমি নিজ থেকে শ্রদ্ধা করি । তাছাড়া মানসের সঙ্গে আমার এখনও সম্পর্ক রয়েছে ।
তোমাদের এই সম্পর্ক কতদিন এ ভাবে চলবে?
বৌদি আমি ওকে ভলোবাসি ও নেহায়েত সরল মানুষ । ও আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে । আমি একটু সময় নিয়ে ওকে বিয়ে করবো ।
ঠিক আছে এখন ঘুমাতে যাও পরে কথা বলবো ।
নিমি সারারাত ঘুমাতে পারছে না । কি যেন একটা টেনশনে রাত্রি কাটাচ্ছে । রাতের শেষের দিকে মাকে স্বপ্নে দেখে একটা সাদা শাড়ি পরা তার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে । হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, কি যেন কি বলছে । নিমি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি করতে চায় , কিন্তু মা দূরে সরে যাচ্ছে । নিমির চোখ দিয়ে জ্বল গড়িয়ে পড়ছে । মা কি বলছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না । মা মা বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু মা চলে যাচ্ছে । তার চিৎকার শুনে অদিতি ডাকে নিমি নিমি! সে তখনও কাঁদছে, চোখ খুলে দেখে অদিতি পাশে দাঁড়িয়ে বলে তুমি কাজে যাবে না । ও মা তুমি তো কাঁদছো, কি স্বপ্নে দেখলে?
নিমি বলে আমি এতক্ষন মাকে দেখছি । প্রিয়ব্রত রুম থেকে এসে বলে কি দেখেছ?
নিমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না । অনেক্ষন পর বলে আমি মাকে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম এবং কি যেন আমাকে বলতেছিলো, বুঝতে পারি নি । মাকে দেখেছো, ভালো দেখেছো, উঠো নাস্তা করো । তোমার মন ভালো নেই,আজ কাজে যাওয়ার দরকার নেই, বাবাকে আশ্রমে গিয়ে দেখে এস । নিমি তখনও কাঁদছে ?
অদিতি বলে ওমা কি মেয়ে গো তুমি,ওতো স্বপ্ন ?
নিমি বলে বৌদি আমি মাকে এভাবে কখনও দেখিনি । মা কেন আমার কাছে আসলো এবং কি বলতে চেয়েছিলো কিছুই বুঝতে পারি নি । মা দুনিয়া থেকে আমাদের ছোট রেখে বিদায় নিয়েছেন, বাবা মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করেছেন । আজ বাবা অসুস্থ এবং আমরা আপন হয়ে ও পর, বাবাকে একা আশ্রমে ফেলে রাখছি ।
অদিতি বলে কি করবে, এ দেশে কাজ না করলে দুবেলা খাওয়া মিলে না । এটাই এখানকার বাস্তবতা । তাছাড়া বাবা অসুস্থ্য, আমরা কাছে থাকলেও কি করতে পারতাম ।
নিমি ঘুম থেকে উঠে কাজের জায়গায় কল দিয়ে আজকের জন্য ছুটি নিয়েছে । আমি কাজে যাবো না, ছুটি নিয়েছি এবং বাবাকে দেখতে যাবো । প্রিয়ব্রত বলে ঠিক আছে, তুমি থাকো এবং বাবাকে দেখে এস ।
প্রিয়ব্রত ও অদিতি নিলয়কে ডে কেয়ার এ দিয়ে যার যে কাজে চলে যায় । নিমি সকালের নাস্তা করে কিছু রান্না করে বাবা ললিতের জন্য সকাল সকাল আশ্রমে যায় । ললিত নিমিকে দেখে হেঁসে বলে তুমি আজ কাজে যাও নি?
না, বাবা আমি আজ কাজে যাই নি ।
নিমি বাবাকে ডাইনিং টেবিলে খাওয়া দিয়ে বলে বাবা তুমি আস্তে আস্তে খেয়ে নাও এবং আমি তোমার বেড গুছিয়ে দিয়ে দেব । ললিতের বেড শিট, বালিশের কভার এবং শার্ট প্যান্ট ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে এসে রুম পরিষ্কার করে অন্য কাপড় ও বেড শিট লাগিয়ে ম্যানেজমেন্ট অফিস গিয়ে জিজ্ঞেস করে কোনো অভিযোগ আছে কি?
অফিস ম্যানেজার মিস্টার পিটার বলে যে ললিত বেডরুম পরিষ্কার করে না এবং নিয়মিত ঔষুধ খায় না । তা ছাড়া সে না বলে বাহিরে চলে যায় এবং আমরা অনেক সময় খোঁজাখোঁজি করেও পাই না । অনেক সময় টেবিলে খাওয়া পড়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা । সে বাসায় থাকলেও খেতে চায় না ।
নিমি বেডরুম পরিষ্কার করে, লন্ড্রি থেকে কাপড় এনে গুছিয়ে বলে বাবা তুমি চলো আমরা একটু ঘুরে আসি । নিমি ললিতকে নিয়ে নিকটতম শপিং মলে গিয়ে বাবার জন্য প্যান্ট, শার্ট, গেন্জি, সাবান, সেভিং রেজার,আফটার শেভ ও এটা সেটা কেনা কাটা করে টিমহর্টন বসে দুইটা পিক্যান ডেনিস ও দুইকাপ কফি নিয়ে খাচ্ছে ।
নিমি মানসকে টেলিফোন করে বলে তুমি কি আসতে পারবে?
জরুরি কিছু আছে কি?
হ্যাঁ, বাবাকে নিয়ে টিম হর্টনে বসে কপি খাচ্ছি, তুমি আসলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি । ঠিক আছে আমি আসছি । মানস দুই ঘন্টার ছুটি নিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে । নিমি মানসকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে বাবা এই মানসের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, তুমি আমাদের জন্য আশীর্বাদ করো । ললিত মানসকে দেখে খুশি হয়ে বলে আমি তোমাদের জন্য অবশ্য আশীর্বাদ করি,তোমরা সুখী হও ।
নিমি বাবাকে আশ্রমে নিয়ে রেখে বলে বাবা তুমি সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলবে । বাবাকে ধরে আদর করে বলে বাবা আমি কাল রাত মাকে স্বপ্নে দেখে অনেক কেঁদেছি এবং সে জন্য আজ কাজে না গিয়ে তোমাকে দেখতে এসেছি । চোখের পানি মুছতে মুছতে নিমি বলে বাবা আমি আবার তোমাকে দেখতে আসবো এবং আমি বিয়ে করলে তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো । তুমি ভালো হয়ে বাকি জীবন আমার কাছে থাকবে । ললিত হেঁসে হেঁসে বলে শুনে খুশি হলাম। ভালো থেকো।
পর দিন কাজে যাওয়ার পর নিমি নাহিদকে বলে কাল বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম । নাহিদ বলে তোমার বাবা কেমন আছে?
এক রকম-ই । মানসকে ডেকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি ।বাবা খুশি হয়েছে এবং বলেছে আশীর্বাদ করবে । নাহিদ বলে এটা ভাল কাজ করেছো ।
নাহিদ বলে গতকাল এই নুতন বাচ্চা ডে কেয়ার এ এসেছে । নিমি বলে দেখে মনে হয় আগে দেখেছি । জিজ্ঞেস করে তোমার কি নাম ?
সে বলে দ্রুব । আমার কাছে মনে হয় এই হয়তোবা শুচিতার ছেলে । কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারে নি । বিকেলে শুচিতা আসলে নিমি বলে, এ তোমার ছেলে বলে আমি মনে করছিলাম ।কিন্তু নিশ্চিত হতে পারি নি । ওকে কেন ডে কেয়ার এ এনেছো?
শুচিতা বলে মা বাবা দুই জন ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছেন । সে জন্য কাজে যাওয়ার পূর্বে ওকে ডে কেয়ার এ রেখে যাই।
আংকেল এবং আন্টি কতদিনের জন্য ইন্ডিয়া গিয়েছেন ?
মনে হয় ২-৩ মাস থাকবে । ওরা কলিকাতা নিজেদের বাড়িতে কিছুদিন থাকবে এবং দার্জিলিং, দিল্লী ও দেশের বিভিন্ন্য স্থানে নিজেদের লোকজনকে দেখতে যাবে । আমি শুনেছি বাংলাদেশে বাবার আদি বাড়িতে ও যাবে । তবে শরীর ভালো থাকলে ঘুরবে,নতুবা চলে আসবে । তুমি একা বাসায় থাকো ?
দ্রুব এবং আমি দুইজনে বাসায় এটাসেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি । মাঝে মধ্যে প্রদীপ ও এসে যোগ দিয়ে খেয়ে দেয়ে গল্প গুজব করে চলে যায় ।
প্রদীপের কাজ কি হয়েছে?
হ্যাঁ, ও আলাদা বাসা নিয়ে থাকে ।
সুমিতের কি অবস্থা?
সুমিতের শরীর ভালো যাচ্ছে না, সে কয়েকদিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি আছে ।ওকে দেখলে কেউ চিনবে না এত শরীর খারাপ হয়েছে । অসুস্থতার জন্য মেজাজ সব সময় খারাপ থাকে । আমি সেদিন দ্রুবকে নিয়ে সুমিতকে দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে । বাসা থেকে এটাসেটা তৈরী করে নিয়ে গিয়েছি ।
এই অল্প বয়সে ওর এত এত সমস্যা হয়ে গেলো?
ওর একসিডেন্টে অনেক সমস্যা হয়েছে । ব্রেন অপারেশন, তাছাড়া হার্ট এটাক এবং ওপেন হার্ট সার্জারি । এতগুলি সমস্যা কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগে । তাছাড়া সে স্মোক করে, ওটা থেকে বের হতে পারছে না এবং কারো কথা ও শুনে না ।
নিমি বলে অনেক কথা তোমার সম্পর্কে শুনা যাচ্ছে, তুমি প্রদীপকে আজ ও ছাড়তে পারছো না । তুমি দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছো, ওটা কি সত্যি ?
মানুষ কত কিছু বলে,তাদের বলতে দাও,আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবে । আমি যদি এমন কিছু করি, তাহলে সবাই জানবে ।
ওটা তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার, আমার কিছুই বলার নেই । ঠিক আছে এখন যাই, দ্রুব সম্পর্কে কোনো কমপ্লেইন আছে কি?
না,ও আপন মনে কাজ করে এবং কাউকে বিরক্ত করে না ।
বিকেলে প্রদীপ কাজ থেকে বের হয়ে কেন্টাকি থেকে ফ্রাইড চিকেন, ফ্রাইজ এবং কোল্ড ড্রিংক নিয়ে বাসায় এসে দেখে শুচিতা কেবলই দ্রুবকে নিয়ে এসেছে । দ্রুব দেখে তো চিৎকার, আংকেল এসেছে, তা ছাড়া ওর পছন্দের খাওয়া, সে তো কাপড় না পাল্টিয়েই খাওয়াতে হাত ঢুকিয়েছে । শুচিতা রাগ করে বলে কাপড় ছাড়ো এবং হাতমুখ না ধুয়ে খাবে না । প্রদীপ বলে ঠিক আছে আমি ওকে সামলাই, তুমি তৈরী হয়ে খেতে এসো । শুচিতা বলে তুমি রোজ রোজ এ সব কেনও আনো?
তুমি সারাদিন কাজ করো, কখন কি করবে, তাই একটু নিয়ে আসলাম । শুচিতা বলে বেশ ভালো করেছো, আমার কিছু রান্না করতে হলো না ।তুমি বস, আমি আসতেছি । প্রদীপ দ্রুব কে কাপড় পাল্টিয়ে হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসিয়ে বলে তুমি খাওয়া শুরু কর । শুচিতা সারাদিনের অফিসের কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে বলে বাসায় কিছু রান্না আছে গরম করে নেই । সে ফ্রীজ থেকে কালকের পুরানো খাওয়া বের করে মাইক্রোওয়েভ এ গরম করে টেবিলে দিয়ে বলে চলো খেয়ে নেই ।
প্রদীপ ও সূচি দুইজনে ডিনার শেষ করে দুই কাপ কপি নিয়ে টেলিভিশনের সামনে আরাম করে বসে ২৩ চ্যানেলে আজকের আবহাওয়া দেখে বলে আজ ঝড় হতে পারে । বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । প্রদীপ বলে রাতের খাওয়া হলো,এখন চলি বাসায় । দেরি হলে মারিয়া আমার জন্য চিন্তা করতে পারে ।
শুচিতা হাঁসতে হাঁসতে বলে মারিয়ার সঙ্গে কি তোমার প্রেমের সম্পর্ক?
হ্যাঁ, তাই । শুচিতা বলে তুমি এত কষ্ট করে আসার দরকার ছিল না ।
প্রদীপ বলে যে যাকে ভালো বসে তার জন্য এর চেয়েও বেশি করতে পারে, আমি আর কি করলাম ।
শুচিতা বলে রিয়েলি !
প্রদীপ হেঁসে হেঁসে বলে রিয়েলি । যাক একটু রসালাপ করলাম, এ সামান্য খাওয়া এনেছি দ্রুবর জন্য । ঠিক আছে ভালো থেকো ।
প্রদীপকে বিদায় দিয়ে শুচিতা টেলিভশন বন্ধ করে মা ও বাবাকে কলিকাতা টেলিফোন করে । আভা টেলিফোন উঠিয়ে বলে কেমন আছিস শুচিতা ?
আমি ও দ্রুব ভালো আছি । তোমরা কেমন আছো?
আমরা জার্নি সিক এবং রেস্টে আছি । তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবি?
দাও । বাবা তুমি কেমন আছো?
আমরা একটু জার্নি সিক এবং রেস্টে আছি । থাকো রেস্টে, বেশি ছুটাছুটি করবে না । আচ্ছা ঠিক আছে ।
পরদিন কাজ থেকে শুচিতা বের হয়ে হাসপাতালে কিছু খাওয়া নিয়ে সুমিতকে দেখতে যায় । সুমিতের সঙ্গে কথা বলার পর সে ডাক্তার শর্মার সঙ্গে আলাপ করে জানে সুমিতের শরীরের কি অবস্থা । শর্মা বলে সুমিতের ব্রেন অপারেশন হলেও কিছু সেল কাজ করছে না । তাছাড়া দুই বার হার্ট এটাক হওয়ার ফলে ওর নানাহ ধরণের কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে এবং ওকে আপাতত হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা যাবে না । রিলিজ করলে ও ২৪ ঘন্টা মেডিকেল কেয়ার এ থাকতে হবে । শুচিতা দ্রুবকে পিকআপ করতে যাবে সে জন্য বেশিক্ষন না বসে বলে আমি সময় নিয়ে আবার আসবো ।
হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে অধরা ও সুশীলের সঙ্গে ওর দেখা । শুচিতা প্রণাম জানিয়ে বলে আপনারা কেমন আছেন?
ওরা বলে ভালো । সুমিতের কি অবস্থা ?
আন্টি ডাক্তার শর্মা বলে ওর নানাহ ধরণের কমপ্লিকেশন রয়েছে, আমি দ্রুবকে ডে কেয়ার থেকে পিকআপ করতে যাবো সে জন্য বেশিক্ষন বসতে পারলাম না । ঠিক আছে তুমি যাও,পরে কথা হবে । শুচিতা ট্যাক্সি নিয়ে ডে কেয়ার এ গিয়ে দ্রুবুকে নিয়ে বের হতেই নিমিকে বলে আমি হাসপাতালে গিয়ে সুমিতকে দেখে এসেছি, ওর শরীরের অবস্থা ভালো নেই এবং ডাক্তার খুব একটা ভরসা দেয় না ।
ক্রমশ :