দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ১।।
ওদিকে বাগানে একটা খালি চেয়ার পড়ে আছে। অনেক দিন ওখানে কেউ বসে না। নিঃসঙ্গতা কাকে বলে ও জানে। জানে কাকে বলে একলা থাকার যাতনা। গোলাপি মেঘটার অভিজ্ঞতাও সেরকম। প্রথম যেদিন সে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হল তখন সে বুঝল পাথর বিরহের সমকক্ষ নয়। রোদে পুড়েপুড়ে পাথরের টেরাকোটা হওয়ার দশা হলে নদী আসে। এসে সেখানে জলের আঁচল বুলিয়ে দেয়। আচ্ছা, নদীর ঢেউগুলো সপ্তডিঙার মতো বহর মেলে কোথায় যায়? সোহরাব-রুস্তমের মতো যুদ্ধজয়ে যায়! আত্মঘাতী যুদ্ধজয় নয় তো? এ পৃথিবীতে কত যুদ্ধ এল। গেল। কিন্তু ট্রয়ের ঘোড়া তো জাগল না। বলল না, ‘এসো, আর নয় যুদ্ধযুদ্ধ খেলা। আমরা ভালো থাকি এক শঙ্খধ্বনির মতো।’
শঙ্খের রঙ কেমন হয়? লাল? নীল? শঙ্খনীল কারাগারে কে পোষে একটুকরো ভালোলাগা? ভালোলাগা তো বাঁশির বাদামী সুর। ছোটবেলায় কত পাতার বাঁশি বানিয়েছি। বানিয়ে সুরেসুরে ইশারায় বন্ধুদের ডাকতাম। যেতাম পদ্মদিঘিতে। পদ্মের বুকে ভ্রমররা কেন ঘুরেঘুরে আসে? মধুর সন্ধানে? কোনো ছোটবেলায় মধুপূরে গিয়েছিলাম। মধুপুরের ধুলোরা ছিল বড়ো রঙিন! মুঠিতে ভরেছি থেকেথেকে। হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলেছি, ‘ভালো থেকো ধুলো। আলোদের গান। ছায়ার পাখসাট।’
ট্রেনেই ফিরেছি মধুপুর থেকে। দেখেছি পড়ন্ত বিকেলে ট্রেনের দীঘল ছায়া। অজগরের মতো কিলবিল করে ছুটছে কী নিশ্চিত গতিতে। ওদিকে প্রলম্বিত দিগন্তে চুপচাপ ডুবে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্লান্তিতে-অন্তরলীন সূর্য। ইছামতি নদীর মতো আয়েস করে ঘুমঘুম উমে তলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একরত্তি পোকার অস্থিরতা হয়ে প্রশ্নটা মাথায় চক্কর দিতে লাগল। সূর্যকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি উদয় ভালোবাসো, না, অস্ত?’ কেমন হবে সে-উত্তর? ভাবতে-ভাবতে মনে পড়ে গেল আমাদের নিঝুম বিলটার অস্তবেলার কথা। এ সময় কী অপূর্ব সুন্দর লাগে বিলটাকে। দূরে কোথাও দিকচক্রবালে লালের লালাতে চিটচিটে হয়ে আছে গাছদের সারি। গাছেদের খুব গায়ে পড়ার স্বভাব। কেমন একগাছ আরেক গাছের গা ঘেঁষে এলিয়ে পড়তে চায়। শেকড় থেকে শেকড়ে করে আত্মীয়তা। ওদের বড্ড শেকড়ের টান।
শেকড়ের টানে একদিন গাঁয়ে এলাম। তাও বছর পাঁচেক পর। পাড়াপড়শিরা ছুটে এল। পাড়া-সম্পর্কের এক-চাচীর আমাকে দেখেই চক্ষু-চড়কগাছ। ‘তুই অনেক শুকিয়ে গেছিসরে!’ বলেই আমার এক-সপ্তাহের দাড়ি-না-কামানো খরখরে মুখে গোবরে-উঠান-নিকানোর হাত দিয়ে একপশলা সুবাস বুলিয়ে দিল।
কোথা থেকে যেন পরিপূর্ণ লেবুর স্নিগ্ধ সুবাস ভেসে আসছিল। তার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে মাটির সোঁদা গন্ধ। গন্ধে হৃদয়ে হেঁচকা টান পড়ল। ঘরের মতো বাড়ি। বাড়ির মতো পাড়া। পাড়ার মতো গ্রামে জন্মেছিলাম কোনো এক-কালবৈশাখীর রাতে। সে রাতে ছন্নছাড়া ঝড়ে ভেঙেছিল একটি সুরম্য তালগাছ। তালগাছে বাসা বেঁধেছিল শিল্পসচেতন দু’ জোড়া বাবুই পাখি। খড়ের নিখুঁত বুননে খাসা ছিল তাদের নীড়। কত পাখি আসে যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওছিলাতে থেকে যায় ওরা ওখানে। সকালে ঝড় থামলে, আমার বড়ো বোন মাঠের পাড়ে গিয়ে কুড়িয়ে এনেছিল সে-পাখিগুলোর নিথর দেহ। অনেক কেঁদেছিল আমার বোন। মায়ের কাছে এরকম কত গল্প শুনেছি ছোটোবেলায়। গল্প শুনেছি কাজলরেখা আর সুচকুমারের। কঙ্কন দিয়ে কাজলরেখা বিপদগ্রস্ত এক-দাসীকে কিনেছিল। সেই কঙ্কনদাসীই পরে কাজলরেখার অশেষ দুঃখের কারণ হয়। গল্প শুনতেশুনতে আমার দু’ চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে পড়েছে। কেউ বুঝতে পারে নি। কাজলরেখার দুঃখে ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছিল। অনেক কষ্টে সে কান্না থামিয়ে রেখেছিলাম। কষ্ট কি কোনো কষ্টি পাথর? যার সংস্পর্শে না-এলে আমরা আমাদের প্রকৃত আনন্দবেদনার পরিচয়ই হয়ত পেতাম না। বুঝত পেতাম না কোনটি আসল সুখ, আর কোনটি নকল সুখ। বাতিল হয়ে যাওয়া ছাতার দুঃখ কেউ বুঝতে চায় না।
মানুষের কত রকমের দুঃখ। দুখের অদৃশ্য করাতে মানুষ রক্তপাতহীন ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। দুর্দশার ভারে নুয়ে পড়ে। আবার উঠে দাঁড়ায়। হারতে-হারতে এমন করে মানুষ একদিন জিতে যায়।
জেতার নেশা বড়ো পাগলপারা। আসে প্লাবন। আসে মহামারী। তবুও মানুষ থমকে থাকে না। থমকে থাকে না কলম্বাসরা। আলটপকা বেড়িয়ে পড়ে নতুন মহাদেশের সন্ধানে। অক্টোপাসের মতো করাল থাবা নিয়ে বিপদ তেড়ে আসে। নিমেষে গ্রাস করে ফেলবে বুঝি! কিন্তু ভয় পেলে চলবে? দমবার পাত্র নয় দোর্দণ্ড নাবিক। পাল ছিঁড়ে যায়। হাল ভেঙে যায়। স্কারভি হয়ে মৃত্যুদূত ধেয়ে আসে। ক্যাপ্টেন কুক সেবার বেশি করে লেবু নিয়েছিল জাহাজে। এই প্রথম নাবিকদের কেউ দাঁতের রোগে আক্রান্ত হল না। আবিষ্কার হল স্কার্ভি রোগের মহৌষধ লেবু।
আবিষ্কারের ঘোরে মানুষ জলোচ্ছ্বাস বধ করার কৌশল শেখে। যে দিন মানুষ পাথরে পাথর ঘষে আগুন আবিষ্কার করা শিখেছিল সে দিনই বুঝতে পেরেছিল সব সম্ভব থাকে আসলে অসম্ভবের ছদ্মবেশে। বোধবুদ্ধির সংকেতে হৃদয়ের তন্ত্রীতে-তন্ত্রীতে গড়ে তোলে সৃজনশীলতা ও সাহসিকতার মেলবন্ধন। পাহাড় কেটে বানায় শহর। গড়ে ওঠে সভ্যতা। নোবেল পাহাড় বিদীর্ণ করার ডিনামাইট তৈরি করল। কী তার উচ্ছ্বাস! হাজার শ্রমিকের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে আর পাহাড় ভাঙতে হবে না। পাহাড়-ভাঙা হবে না সময়সাপেক্ষ। গিরিখাত মৃত্যুকূপ নয়, হবে বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। নোবেলের এই মহাবিশ্বের সমতুল্য আত্মবিশ্বাস হঠাৎ একদিন চুপসে-যাওয়া বেলুনের মতো পর্যুদস্ত হল। বুঝল, সে এক-মস্ত ভুল করে বসেছে। মানবজাতির কল্যাণ ডেকে আনতে গিয়ে ডেকে এনেছে সর্বনাশ। ডিনামাইট আজ সভ্যতা গড়তে নয়, ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। ধ্বংসের ধ্বজাতলে কার বিজয়নিশান ওড়ে? অবিশ্বাসের? বিশ্বাসের ওজন খুব ভারি? তাই ওকে কেউ বুঝি সহজে বইতে চায় না। তবুও এ ধরণীতে পরাক্রমশালী কেউকেউ আছে। আছে পরের স্বার্থে নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া দেবদূতরা। হারকিউলিসের মতো বিশ্বকে নিজের কাঁধে নিয়ে এখনো কষ্টের নীল বিষে নিজেদেরকে রাঙিয়ে যায় তারা। (চলবে…)
এই মহাবিশ্বের সমতুল্য আত্মবিশ্বাস হঠাৎ একদিন চুপসে-যাওয়া বেলুনের মতো পর্যুদস্ত হল। পড়ে খুব ভালো লাগলো। পরবর্আতী সংখ্মিযা পড়ার আশায় রইলাম। আমিও ভাবছি তোমার মত করে গদ্য কবিতা লিখবো। তোমার মতো একটু বুদ্ধি দিও ভাই। ভালো থেকো। মনের আনন্দে লিখতে থেকো। অশেষ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
অনেক-অনেক ধন্যবাদ দাদা। শুভেচ্ছা রইল নিরন্তর।