দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ০৭।।
বর্বর লাবণ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক-গাছ নির্ঘুম পলাশ। নীলকণ্ঠ পাখির কাছ থেকে চেয়ে-নেয়া নিঃসংকোচ নীরবতা হারিয়ে যায় ক্রমশ ক্ষণের জন্মান্তরে। নদীতে জল নিতে এসে আজানু-লম্বিত কেশে পুব পাড়ার দেবী উপায়হীন বাতাসের ঘ্রাণ মাখছে নিরন্তর। অথবা বাতাস কি মাখছে তরল ঘ্রাণের নিরন্তর চুল? ডুবন্ত কলসের ডাকাবুকো ফুস্ফুস থেকে এক দিস্তা দম ধারে নেয় জলে-হারিয়ে-যাওয়া কোনো কুলনারীর নথ। বিচক্ষণ সৈনিকের মতো একটি কাঁঠালপাতা বাউলা বাতাসে পদাঘাত করতে-করতে এ-গাঁও পার হয়ে গেল অশুভ আত্মাদের বসতভিটে শ্যাওড়া ঝোপের দিকে। তারপর? জংশনে এসে রেলগাড়িদের কখনো কি গতজন্মের জুমচাষের কথা মনে পড়ে?
তোমার হয়ত মনে নেই সেই দিনটার কথা! বাংলার শিক্ষক রফিক স্যার ক্লাশে ঢুকেই বললেন, ‘আজ আকাশে-আকাশে মেঘেরা শিখে গেছে ইকেবানা।‘
জিজ্ঞেস করলে, ‘স্যার, ইকেবানা কী?’ আর সেই-দিনই প্রথম আমি তোমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে শিখে গেলাম। স্যার তান্ত্রিকের ঢঙে যেন মন্ত্র আওড়ালেন, ‘যে-আয়েসে স্বর্গ থেকে যায় আমাদের কাছে!’
ইকেবানার আয়েসে সুখাহত দুখ, দুখাহত সুখ মেলেছে প্রচ্ছায়া প্রীতির পাথারে। এমন আলিঙ্গন-প্রশ্রয়ে তরল পান্নার জোছনাতে বালুচর হয়ে ওঠে মর্ত্য-প্রবাসী অপ্সরাদের রঙমহল।
পাতাল-থেকে-উঠে-আসা জলের ফোয়ারা আমার প্রিয় কদমফুল। এরপরেও কথা থেকে যায়! বালুচরী আবেশে ভুলে-যাওয়া চিন্ময় নিঃসঙ্গতা আমারো আছে।
উরাল নদী থেকে প্রস্ফুটিত উত্থানে বাষ্পীভূত জল নিঃসঙ্গ। তাহলে কী করা! ইবনে বতুতা খ্যাত পাখিদের পথ চিনে-চিনে চলে এল যমুনার পাড়াগাঁয়; কালো মানুষদের হরদম গঞ্জে। হাটেবাজারে ঘুরুক-না দয়াল ফকির রাজার ছদ্মবেশে কিছুদিন। অঝোর বৃষ্টির মতো প্রতিভাবান আলো আর কোথাও দেখি না।
আলোর ঘরবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজি কাকে?
তুমি আমাকে খুবখুব করে বোঝালে, ‘ঘরে আলো জ্বললেই সব-ঘর বাতিঘর হয়ে যায় না।’ নাও বাইতে শিখলাম নাবিক হওয়ার জন্যে। কিন্তু জাহাজ পাব কোথায়? স্নানের ভণিতায় বারবার সাগরতীরে আসি। যদি কোনো জাহাজ নোঙর করে, বলব আমাকেও সঙ্গে নিতে। বিনে পয়সায় ক্যাপ্টেনের সহকারী হিসেবে খেটে দেব। মশলাদ্বীপের কল্পিত ঘ্রাণ প্রশ্বাসের মুঠিতে ধরে রাখি। রাত্রি এলে দারুচিনি রঙের সরল লণ্ঠনের আলোতে জলের ফেনিল পাপড়ি শুঁকে দেখি। জানা নাই– অপূর্ব শিহরণে ভেতরে-ভেতরে তরমুজের মতো অধীর রঙিন হয়ে উঠেছি কতবার!
বাসী রুটির বুকের ভেতরে জমে-থাকা স্যাঁতস্যাঁতে উষ্ণতা জোছনার থকথকে আর্দ্রতাকেও হার মানায়।
বিচারালয়ের ব্যস্ততাকেও উতরে যায় এমন দুমড়ানো মানচিত্রে মহাসাগরগুলো কেমন ঊর্মিল! নৌবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রিধারী ব্যক্তিটি সাঁতার শেখে নি বলে সমুদ্র-সফরে পঞ্চম বারের মতো দারুচিনি দ্বীপে যাওয়ার সংক্ষিপ্ততম তালিকা থেকে বাদ পড়ল। কেউ কি নেই– নেকড়ের নখে জমে-থাকা কয়লার দাগ মুছে দেবে? পেশার জীবনমুখী বিকল্প খুঁজতে গিয়ে হ্যামিলনের বাঁশিওলা এখন উটের ভূমিকায় সাহারা মরুভূমিতে যাযাবর হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যেন তার জীবনের কোনো উচ্চতায় এই সম্ভাবনা কখনো না-আসে– তুষারের বল খেলতে পাড়ি জমাতে হবে উত্তর মেরুতে।
ঐন্দ্রজালিক হাওয়ায় উড়ন্ত খড়কুটো যতই উলম্ব উচ্চতায় পাড়ি দিক-না কেন, তাকে সমতলের মায়াবি টানে মাঠে ফিরে আসতেই হয়। অসহায়ত্ব কি একচক্ষু হরিণ? যার শিং-এর প্রচ্ছায়াতেও জড়িয়ে যেতে পারে অবিবেকী লতার মরণজাল। চোখের জলে পেতে-রাখা বড়শি সে তো কোনো কূপমণ্ডূক ভোটপ্রার্থীর প্রতীক! কেন-যে গণরোষ বাড়লেই, রাক্ষসরা গাঁয়ে আসে আদমশুমারি করতে?
দর্জির দম্ভ ভুলে গেলে, কেমন করে যে দেহ হয়ে ওঠে দৈত্য! কিন্তু, বেচারা মন বরাকের উপত্যকায় এক দুরন্ত খরগোশ ছাড়া আর কিছুই নয়। আঙুলের নখে আপোষ ছোট্ট ফুল হয়ে ফোটে। কখনো চোখে পড়ে। কখনো চোখে পড়ে না। অসম্মান করো না ওকে। কেউ হয়ত একদিন ওই স্নিগ্ধতার প্রসঙ্গ টেনে বলবে, ‘তোমার মধ্যমা যেন লাবণ্যের বাগান।’
অমাবস্যা জানে না কাকে বলে লাবণ্য। তবুও তা অভিসারের স্বর্গীয় প্রণোদনা। রাতে নরম আঁধারের দরজাগুলো পেরুলেই নিকটতম দূরত্বে প্রিয়ার মায়াবী মুখ কত জোছনাময়! যন্ত্রণাকে সাপ্লুডু খেলতে শিখিও না। ও শীঘ্রই তোমার কৌশলী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে।
কৌশল চিরকালই একটি কাছিম নতুবা ঝরাপাতা।
একটি ঝরাপাতা কখনোই স্বর্গ ও নরকের খোঁজ করে না। সে শুধু জানে ইলিশের চাকচিক্যে-পরিপূর্ণ প্রস্থান।
প্রস্থান আগমনের কষ্টার্জিত উপসর্গ। ফিটকিরি-তুল্য স্বচ্ছতা নিয়ে নুয়ে থাকে। আমার চোখের দিকে তাকাও। এখানেই তুমি তোমার প্রাকৃত জনকে দেখতে পাবে। আমার চোখ দিয়ে আমাকে দেখো নি বলে তুমি আমার পাশে থেকেও আমাকে দেখতে পাও নি। তোমার অবহেলা আমাকে নিয়ত করেছে ভঙ্গুর। আর স্পর্শ হল সর্বোত্তম চোখ। পুঞ্জাক্ষি বললেও ভুল হবে না। আমাকে ছুঁয়ে দাও। আমাকে দেখতে পাবে।
টুপির কোটরে জমে-থাকা এক-মুঠো ফড়িঙের সোনাগাছি ছায়া দেখেশুনে রাখি গত শতাব্দী ধ’রে।
যেমনটি স্বদেশ, তেমনটি গুছিয়ে রাখি তোমাকে পল্লবিত কবিতার আন্তরিক বিউগলে। গাছের চুলগুলো বাতাসের যৌবন-স্পর্শে হল সবুজ ঝাড়লন্ঠন। নাগরিকত্বের নোলক প’রে হাসে চিলেকোঠার টবে-লাগানো গোলাপি ফুলগুলো। দুধের বাটিতে টং শব্দ হতেই কোথা থেকে যেন ছুটে এসেছে ঠাস বুনট বিল্লি। ঘাসদের ছুঁড়ে-দেয়া চুম্বন অতিক্রান্ত দিগন্তের বিলে চুল্বুলে হাঁস হয়ে ভাসছে।
যে যা-ই বলুক! সম্পূরক প্রকাশে ব্যাখ্যা করা হয় নাই শামুকের অন্তর্মুখিতা। অনাঘ্রাত ঘোড়ার হ্রেষা পুঁজি করে আলোকবর্ষ দূরত্বে পাড়ি দেয়ার পূর্বপরিকল্পনা এখনো অব্যাহত থাকতে পারে। অহিংস শহর থেকে মায়ার গম্বুজ কাঁধে নিয়ে কে চলে নিজ-শহরে মোহের অভিমুখে?
কুড়িয়ে-পাওয়া মোহরের দ্যুতিতে খোঁজা হয় নি রাজকন্যার হাতছানি। আত্মপীড়নের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত বিষাদগ্রস্ত বর্ষাকে প্রতিবারের মতো এবারও এক বছরের জন্যে পাঠানো হল অনন্ত হ্রদের ওপাড়ে বনবাসে।
কালাকালের বনবাসে-থাকা থুত্থুড়ে কুঁজো বুড়ি এর-ওর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয় – কে কত দিন সকালের মোড়ক খুলে বেছে নেয় নি শাঁসাল যৌবন! (চলবে…)