গল্প/উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে আমার অনেক এক্সপেরিমেন্ট আছে। সে সমস্ত এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল বিশেষ সুবিধার না। পাঠকরা সহজে যেন একটু হকচকিয়ে উঠে আমার লেখা পড়ে সেই আশা থেকে আমি মাঝে মাঝে বাহারি সব নাম দিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করি, যেমন: সিঙ্গেল মাদার, হোমলেস, জোসনা ম্যানসন, স্বপ্নের ইমিগ্রেশন ইত্যাদি। মাঝে মধ্যে কাজ হয়। ফেসবুক ভিত্তিক কিছু গ্ৰুপে, ব্লগে অথবা আমার ফেসবুক পেজে সে সমস্ত গল্প পোষ্ট করলে কিছু কিছু উৎসাহী পাঠক আমার লেখা নিয়ে তাঁদের মনের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন। আমি আনন্দিত হই। আমার জীবনের সেরা আনন্দজনক ঘটনা ঘটেছিলো যখন আমি বগুড়া জিলা স্কুলের নোটিস বোর্ডে টাঙানো ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল দেখেছিলাম। আজ এতবছর পরে, সেদিনের সেই আনন্দ ঠিক সমপরিমানে আমাকে এখনও একই ভাবে উল্লসিত করে যখন দেখি আমার লেখাগুলো সামান্য হলেও কিছু মানুষের মনে ভালো লাগার অনুভূতি তৈরী করতে পেরেছে।
কথা হচ্ছিলো, আমার গল্পের নামকরণ নিয়ে। আমার আজকের গল্পের নামকরণ দিয়েছি ‘কথা দিলাম’। যদিও এই নাম অনেক সেকেলের ভাব জড়িয়ে আছে, তবুও ইচ্ছা করেই এই নামটি ঠিক করলাম কারণ আজকের গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে এই নামকরণের কিছুটা সঙ্গতি আছে বলে আমি মনে করি। গল্পটির শেষ পর্যন্ত পড়লে এর নামকরণের যথার্থতা বুঝতে সক্ষম হওয়া যেতে পারে।
আমি যখন ফাস্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারে অর্থাৎ ‘আমি’ দিয়ে লেখা লেখি তখন বেশ মজার ঘটনা ঘটে। আমার কিছু পাঠক মনে করেন এসব ঘটনা সত্যিই আমার জীবনে ঘটেছে। এভাবে একবার আমি ফেঁসেও গেলাম। গতবছর ঈদের গল্পে রহিমা খালা নিয়ে এক গল্প লিখে প্রায় ক্যালেঙ্কারি কান্ড ঘটিয়ে ফেললাম। গল্পের শেষের দিকে কোথাও লিখেছি হাই ওয়ের একসিডেন্টে আমার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে মারা গিয়েছে আমি পঙ্গু হয়ে বিছানায় শুয়ে অতীত স্মৃতি নিয়ে বিষাদময় ভাবে ঈদ উজ্জাপন করছি। গল্পের কমেন্টে নানান পাঠক আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন। একসিডেন্টের ব্যাপারটি আরো ডিটেলস জানার জন্য দেশ থেকে বন্ধুরা বন্ধু ফোন করা শুরু করলো। আমি প্রমাদ গুনলাম।
আমার সেই অভিজ্ঞতাকে মনে রেখে সম্প্রতি আমার নতুন ধারাবাহিক ‘হাউজ হাজব্যান্ড’ গল্পে আমি আর ন্যূনতম ঝুঁকি নেয়নি। আমি আমার সেই গল্পে ফাস্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারে না লিখে গল্পের একটি নায়কের নাম দিয়ে চালিয়েছি, নায়কের নাম দিয়েছি টুটুল। সেখানেও নিস্তার নেই, আমাকে দেখলেই পরিচিত অনেকেই বলেন, ‘এই যে ভাই হাউজ হাজব্যান্ড, আপনার এবারের লেখাটি কিন্তু হ্যাবি হচ্ছে, তবে লিখতে বোধ হয় খুব সহজ হচ্ছে তাই না? নিজের জীবনের কথা লিখছেন তো তাই আর কি।’ আমি এসবের জবাবে শুধু মুচকি হাসি। একধরণের ভালো লাগা আমার মধ্যে কাজ করে। মানুষ তা হলে এখনও লেখা পড়ে!!!
আমি আসলেই ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করেছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। চলুন আর কথা না বাড়িয়ে আমার আজকের গল্প ‘কথা দিলাম’ এর মধ্যে প্রবেশ করি। গল্পটি আমার সম্প্রতি কুইবেক প্রদেশ সফর নিয়ে। তাই বলে আবার ভাববেন না আমি ছলে বলে কৌশলে ফাঁদে ফেলে আপনাদের আমার ভ্রমণ কাহিনী শোনাচ্ছি। আমারা এখন যে যুগে বসবাস করছি এই যুগের আমি একটি নাম দিয়েছি, ‘সময় নেই যুগ’। এই সময় নেই যুগে থেকে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার ভ্রমণ কাহিনী শোনাবে ইচ্ছা আমার নেই। তবে ঈশপের গল্পের মতো জাস্ট দুটি বিষয় জানানোর জন্য এতো ভনিতা করছি।
প্রথমটি হচ্ছে মিতা প্রসঙ্গে। ইদানিং লংড্রাইভ করতে যেয়ে আমার কিছুটা ঘুমের ভাব আসে। আমার নিরাপপত্তা হোক বা নিজের নিরাপত্তা হোক আমার এই ড্রাইভিংয়ের সময় ঘুমানোর ব্যাপারে মিতাকে অসম্ভব চিন্তিত ও উদবিগ্ন হতে দেখা গেল। মিতা আমাকে ধরে বেঁধে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে হাবিজাবি সব টেস্ট করালো। এক্সট্রা সাপ্লিমেন্ট হিসাবে মাল্টিভিটামিন, ভিটামিন ডি ইত্যাদি কিনে আনলো। এই জাতীয় সম্যাসার মধ্যেও আমরা ৬/৭ ঘন্টার ড্রাইভে কুইব্যাকে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় সপ্তাহ ব্যাপী এই লংড্রাইভের প্রস্তুতি পর্ব চললো। মিতা ওয়ালমার্ট থেকে চানাচুর, বাদাম, চকলেট, হালকা স্ন্যাক প্রভৃতি কিনে ব্যাগ ভর্তি করলো। এসবের রহস্য হচ্ছে আমাকে খাবারের মধ্যে রেখে ড্রাইভিংয়ের সময় সজাগ রাখা যাতে আমি ঘুমিয়ে না পড়ি। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য দিক থেকে।
যে দিন আমরা ভ্রমণ শুরু করবো সেদিন মিতা খুব সকালে উঠে নাস্তা রেডি করে কাপড়চোপড় পড়ে যাওয়ার জন্য রেডি। কিন্তু বাচ্চারা অর্থাৎ অর্ণব, অধরা কিছুতেই ঘুম থেকে উঠছে না। এদিকে আমাদের সকাল সকাল রওনা হওয়ার কথা। বাচ্চাদের ওপর রাগ করে মিতা ভ্রমণ যাত্রা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, তবে হাল ছাড়লাম না। মিতার ওপর অগাধ বিশ্বাসঃ নিয়ে গাড়ি লোড করা শুরু করলাম, গাড়িতে সুটকেস তুললাম, আমার , মিতার ও বাচ্চাদের আরও ছোট ছোট লাগেজ তুললাম । নানান কৌশল প্রয়োগ করে বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে লাগেজ তোলার মতো করে ওদেরকেও গাড়িতে তুলে হাতে নাস্তার প্লেট ধরে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিলাম। যা হবার তাই হলো। ঘন্টাখানিক ড্রাইভ করেই ঘুমের ভাব চলে এলো। পাশ থেকে মিতা বললো ‘একটু গাড়ি থামাও, খাবারের ব্যাগ থেকে আমি চানাচুরের প্যাকেট বের করছি’। আমি গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামাতেই মিতা গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্ক খুলে চানাচুরের ব্যাগ খুঁজতে লাগলো। আমিও মিতাকে হেল্প করার জন্য নেমে এলাম এবং বিশ্বয়ের সাথে লক্ষ্য করলাম আমি খ্যাবারের পুরো ব্যাগ বাসায় রেখে এসেছি। তাড়াহুড়ো করায় গাড়িতে আর তোলা হয়নি। এবার আমার দশা সত্যি সত্যিই আমার লেখা হাউজ হাজব্যান্ডের টুটুলের মতো হলো। কি আর করা, টিমহর্টনের স্নাক্স কিনে আবার ড্রাইভ করা শুরু করলাম। মনে মনে ভাবলাম কোথাও যাত্রা শুরু করার আগে মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত। অবিশ্বাস্য জনক ঘটনা হলো পুরো যাত্রা পথে ড্রাইভ করার সময় আমার আর ঘুম এলো না।
এবার আসি পরের ঘটনায়। মূলতঃ এই ঘটনার সাথেই আমার আজকের গল্পের সংযোগ রয়েছে। কুইবেকের হোটেলে রাতে থেকে আমরা সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে Île d’Orléans নামক একটি আইল্যান্ড ভ্রমণের জন্যে বের হয়েছি। এই প্রাচীন আইলেন্ডটি কুইবেক সিটি থেকে মাত্র পাঁচ কি মি পূর্বে । এই আইল্যান্ডটির দৈর্ঘ্য ৩৩ কি মি এবং আয়তন ১৯২ .৮ বর্গ কি মি. যা পাহাড়ের পাদদেশে সেন্ট লরেন্স রিভারের মাঝখানে অপূর্ব সৌন্দর্যের ক্ষেত্র তৈরী করে রেখেছে।
সুন্দর ডিজাইন করা শক্তিশালী ব্রিজের ওপর দিয়ে সেন্ট লরেন্স রিভারের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আইল্যান্ডের ভিতরে প্রবেশ করে চারিপাশের ছবির মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে অভিভূত হলাম। আইল্যান্ডের ভিতরে আরও আধা ঘন্টাখানিক গাড়ি চালতেই আমাদের বাথরুম পেয়ে গেল।একটি চমৎকার রেস্টুরেন্টের পাশে গাড়ি পার্ক করে ঢুকে পড়লাম। হুট্ করে ঢুকেই বাথরুম করা খারাপ দেখায় ভেবে কর্মরত মহিলাকে ইংরেজিতে বললাম, আমাদেরকে দুটি রেগুলার কফি দাও , আর শোনো আমরা কি বাথরুম ব্যাবহার করতে পারি?
কুইবেকের অধিকাংশ যায়গায় ইংরেজির প্রচলন নেই সব কথা ফ্রেঞ্চে বলতে হয় । এমনকি রাস্তার STOP সাইন পর্যন্ত ফ্রেঞ্চে লেখা। তবে হোটেল রেস্টুরেন্টে দু একজন থাকে যারা ইংরেজিতে কাস্টমারদের সাথে কমুনিকেশন করে। আমাদেরকে অবাক করে মহিলাটি পরিষ্কার ইংরেজিতে বললো, ‘সরি কফি হবে না, আমাদের রেস্টুরেন্ট এখন বন্ধ, দুপুর বারোটায় খুলবে। আর যেহেতু হোটেল বন্ধ তাই বাথরুম লক করা। এখন বাজে সবেমাত্র সকাল পৌনে এগারোটা, আমি হতাশ হলাম না। ওদেরকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা এদিকটায় বেড়াতে এসেছি, আমরা ফেরার পথে তোমাদের এই রেস্টুরেন্ট থেকে কফি কিনবো, প্লিজ আমাদেরকে ওয়াশরুম ব্যাবহার করতে দাও । কাজ হলো, মহিলাটি ওয়াসরুম খুলে দিলো। আমরার ওয়াশরুম সেরে আবারো ড্রাইভ শুরু করলাম।
চারিদিকে চমৎকার চমৎকার সব দৃশ্য। কখনো আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফেসবুকে লাইভ এলাম, কখনো শুধু ভিডিও করলাম, আর ফটোসেশন চলতে থাকলো অবিরাম। এভাবে প্রায় ঘন্টা তিনেক সেই দ্বীপে ঘোরাঘুরি করে ফিরে যাচ্ছি। আমরা যখন সেই রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন আমাদের হাতে একেবারেই সময় নেই, এখন পর্যন্ত কুইবেকের সেই বিখ্যাত ফলস আমাদের দেখা হয়নি । পরের দিন সকাল সকাল রওনা হতে হবে, হাতে এক মুহূর্তও সময় নেই, তাই সেই রেস্টুরেন্টে আর থামার প্রশ্নেই আসে না। আমি রেস্টুরেন্টটিকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি। বুকের মধ্যে চিন চিন করছে । প্রায় দশ সেকেন্ড গাড়ি চালিয়ে আবার ব্যাক করে গাড়ি ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টের কাছে আসতেই বাচ্চাদের চোখমুখ খুশিতে চক চক করে উঠলো। ওদের বাবা কথা রেখেছে। বাচ্চারা আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুটি কফি নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলাম।
আমি যে দেশে আমার পরিবার নিয়ে থাকি এখানে এক অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এখানকার আলোবাতাসে বেড়ে উঠে বাচ্চারা বেশ ভিন্নভাবে নিজেদেরকে গোড়ে তোলে । এদের মধ্যে দেখেছি এক ধরণের মূল্য বোধ তৈরী হয় যা কোনো মানুষকে ঠকাতে শেখায় না। আমি শত ব্যাস্ততার মধ্যেও, আরো অনেক সুন্দর সুন্দর যায়গায় বেড়াতে যাওয়ার তাড়া থাকা সত্ত্বেও সেই রেস্টুরেন্টে আবার ফিরে কফি কিনে যে কথা রাখার দৃষ্টান্ত ওদের তুলে ধরলাম তা দিয়ে আমি আসলে আমার বাচ্চাদেরকে একটি মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করলাম। ‘বাচ্চারা, আমি যে দেশে জন্মেছি সেই দেশের আলো বাতাসও আমাকে লোক না ঠকানোর মরাল দিয়ে গড়ে তুলেছে।
—-
পরিশিষ্ট: কথা দেওয়া এবং কথা রাখা চরিত্রের একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ। আমাদের সমাজে সৎচিরিত্রের বেশ আকাল যাচ্ছে। আমরা ইচ্ছা করলেই সেই আকাল দূর করতে পারি। আমাদের নিজ নিজ চরিত্রকে সুসংগঠিত করতে পারি।দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধের কথা ভেবে এ প্রজন্মকে যেন দিয়ে যেতে পারি সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ। কথা দিলাম।
সমাপ্ত