মে মাসের মাঝামাঝি, তবু কনকনে হিমেল হাওয়া প্রায়ই কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পথচারীর হাড়। মহামারীর এক আজব সময়ে সমস্ত পৃথিবী স্থবির হয়ে আছে। জন্ম বাংলাদেশে এবং প্রিয়জনেরা সকলেই সেখানে, তাই দেশের দিকে একটা দৃষ্টি সর্বদাই থাকে, তবুএই শহরে থাকতে থাকতে শহরের কিছু মলিন বিষয়গুলোও শঙ্কিত করে তুলছে।আমার বাসা থেকে অফিস যাওয়ার পথে প্রতিদিন কিছু গৃহহীন মানুষের সাথে দেখা হয়। এলাকার আনাচে কানাচে তাদের বসবাস। অতিরিক্ত কথা বলা রোগের কারনে তাদের সাথে একরকম সখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার। মার্চ মাসের শেষের দিকে লকডাউন শুরুর সাথে সাথে সকল নাগরীকের দৈনিক জীবনে কিছু বিশেষ পরিবর্তন আসলেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করছি না। তারা একইভাবে রাত বিরাতে বাসস্ট্যান্ড কিংবা সাইড ওয়াকের কোনায় ঘুমিয়ে থাকছে। এরপরে টরন্টোর “দ্যা স্টারে” প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে আরও কিছু মর্মান্তিক ও আশঙ্কাজনক খবর পেয়ে বিচলিত হয়ে উঠলাম।
এই সময়ে কি নিরাপদ বাসস্থানের অধিকার রয়েছে টরন্টোবাসীর? টরন্টোর আশ্রয় ব্যবস্থা নিয়ে শংকিত সরকারের অভয়ারণ্য মন্ত্রনালয়ের আউটরীচ কর্মী গ্রেগ কুক বলেন, “সরকারকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে হাজার হাজার খালি হোটেল রুম রয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে,হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় আটকে নেই। ”
কুকের মতে,সকল হোমলেস শেল্টারে উপচেপড়া ভিড় এবং অনিরাপদ পরিস্থিতি মে মাসেও অব্যাহত রয়েছে, অন্টারিও প্রদেশ প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার আট সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।নানাবিধ অভিযোগে বলা হয়েছে যে, প্রদেশটি এবং শহরটি দু’পক্ষই গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়কেদ্রকে নিরাপদ করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং আশ্রয়কেন্দ্র গুলো থেকে হোটেল গুলোতে এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরেগতির এবং খুব কমলোকের জন্যই ঘটছে।
এখন মহামারীর সময় এবং সকল নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের।কিন্তু প্রদেশটি লং টার্ম কেয়ার ও অন্যান্য কমিউনিটি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।আশ্রয় ব্যবস্থা ব্যাহারকারীদের জীবন ঝুঁকির ক্ষেত্রে, বলা হয়েছে, শহর ওপ্রদেশটি জীবনের অধিকার,ব্যক্তির সুরক্ষা এবং টরন্টোর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বাসিন্দাদের সমতা লঙ্ঘন করছে।
শহরের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন,সোমবার পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব অর্জনে ২,৪৪৫ জনকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।এর মধ্যে ১,১৬৬ জনকে হোটেল কক্ষে, ৮৭ জনকে অন্তর্বর্তীকালীন আবাসনে এবং ৬৭৫ জনকে স্থায়ী আবাসে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫০০ জনকে অস্থায়ী অবকাশ কেন্দ্রে সরানো হয়েছে।যেখানে আরও হাজার হাজার মানুষের নিরাপদ আবাসন প্রয়োজন।
আসল চিত্র কিন্তু যেমন করুন তেমনই ভয়াবহ। মহামারীর সময়কার সামাজিক দূরত্ব তো নয়ই, স্বাভাবিক সময়ের দূরত্বও বজায় রাখা হচ্ছে না। তার উপরে গৃহহীন এই মানুষগুলো পরিচ্ছন্নতার জন্য Tim Horton’s কিংবা McDonald’s জাতীয়রেস্টুরেন্ট গুলো ব্যবহার করত কিন্তু বহু পাবলিক ওয়াশরুম বন্ধ করে দেওয়াতে তারা সেই সুবিধাও পাচ্ছে না।
আরও একটি সমস্যা হচ্ছে সকল লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তারা ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে পারছে না। তাদের কাছে না আছে কোনও তথ্য, না আছে কোনও সাহায্য আবেদনের উপায়। সমাজকর্মীদের বেশিরভাগই অনলাইন সেবা প্রদান করছেন। তারউপরে এখনও ডিজাবেলিটি সাপোর্ট আবেদনের জন্য ফ্যাক্স ব্যবহার করতে হয় যা খুব সহজলভ্য নয়।
কানাডায় ৩ মিলিয়ন মানুষ চাকরী হারিয়েছে। দ্রব্যমূল্য ও বাড়ীভাড়া তো আগেই অনেকের নাগালের বাইরে ছিল, আর করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি তো আরও ভয়াবহ হবে। গৃহহীন হয়ে পড়বে আরও অনেক মানুষ। সরকারের সকল পক্ষেরই উচিত আরও বেশি করে সামর্থযোগ্য আবাসন গড়ে তুলতে। টরন্টো ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান “Acorn” নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে সকলের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি দায়িত্ব রয়েছে সকল নাগরিকদের। এইবারে আমাদের বাঁচতে হলে সকলের একসাথে বাঁচতে হবে।
সিস্টারিং নামক নারীদের একটি শেল্টারের একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই।যেখানে কখনোই যথেস্ট বেড ছিল না। মেয়েরা খাবার টেবিলের নিচে কিংবা দুটি চেয়ার একসাথে করে তার উপরে ঘুমাত।যখন মেঝেতে একচিলতে খালি জায়গা পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই শীতে ক্রিস্টাল নামে ছোট্ট একটি মেয়ে কোথাও জায়গা না পেয়ে ক্লান্ত শরীরে বাহিরে রাখা কাপড়ের বড় বিনের মধ্যে ঢুকে ঘুমাতে গিয়েছিল।তার ছোট্ট হাত আটকা পড়ে গিয়েছিল বিনের ঢাকনার মধ্যে। সমস্ত রাত কেঁদে কেঁদে ঠান্ডায় প্রাণ হারায় ছোট্ট ক্রিস্টাল। সকালে পুলিশ উদ্ধার করে তার জমাট বাঁধা মৃতদেহ।