আজ সারাদিনই মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে বাচ্চাদের বড় হওয়া নিয়ে , মানুষ করা নিয়ে। বর্তমানের এই যান্ত্রিক যুগে বাচ্চাদের সব চাহিদা যদি আমরা পূরণ করে দেই তাহলে বাচ্চারা কি আদৌ বুঝবে কোন জিনিষের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব কতটুকু! সকাল থেকে আমার ছোট ছেলে তাসিন খেলছিল মোবাইল দিয়ে । আমি যখনই ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়েছি অমনি সে হাত পা ছুঁড়ে কান্না শুরু করেছে।  তার বাবাও দৌড়ে এসেছে ছেলের কি হলো দেখতে । আর সে  আমাকে ছেলের হয়ে অনুরোধ করছে মোবাইলটা দিয়ে দেয়ার জন্য। আমি জানি এমন ঘটনা প্রায় প্রতিটি পরিবারের জন্য নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । অনেক সময় শপিং মল বা মার্কেটে গেলে দেখা যায় অনেক  বাচ্চা কোন একটা খেলনা বা জিনিষ ধরে বসে আছে । জিদ করছে। বাবা বা মা সেটা না কিনে ফিরতে পারছেন না ঘরে। এধরনের পরিস্থিতিতে যা ঘটছে তা হচ্ছে আমাদের সন্তানরা শিখছে  কান্না বা জীদ করলেই সব কিছু পাওয়া যায় । কোন কিছু চাইলেই যে সেই সময়ে পাওয়া যায় না তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এটা তারা মানতে নারাজ  । সব কিছুর জন্যই লাগে ধৈর্য , অধ্যবসয় । এই শিক্ষা দিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি আমাদের প্যারেন্টিং এর কারনে। আমি আজ লিখছি আমাদের প্যারেন্টিং এর ধরণ নিয়ে যা একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে ভুমিকা রাখে।

 প্রত্যেক পরিবারে পিতামাতার সন্তানকে চালাবার ধরন ভিন্ন, প্রত্যাশা ভিন্ন । অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন পরিবারে বাবা মায়ের উচ্চ প্রত্যাশার মিল থাকলেও সন্তানকে চালাবার ধরনে হয়ত মিল নেই। এই সব কিছুর উপর বিবেচনা করে ১৯৬০ সালে ডায়ান বৌমিন্ডে পারেন্টিং স্টাইলকে চার টি ভাগে ভাগ করেছেন। আমি আপনাদের সঙ্গে এই ভাগ গুলো শেয়ার করলে হয়ত আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনি কোন স্টাইলে আপনার সন্তানকে পরিচালনা করছেন আর সেটা আপনার সন্তানের জন্য সঠিক কিনা।

ভাগ গুলো হচ্ছেঃ

1.কর্তৃত্ববাদী ( Authoritarian or Disciplinarian) 2. অনুমতিপ্রাপ্ত ( Permissive) 3. অবহেলা ( Uninvolved) 4. আধিকারিক (Authoritative)

1.কর্তৃত্ববাদী ( Authoritarian or Disciplinarian) : এই স্টাইলে বা শৈলীতে  সন্তানদের কাছে বাবা মায়ের  প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশী ।   বাবা মা  সন্তানদের পছন্দ অপছন্দকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নিজেরা যেটা ভাল মনে করেন তা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন। তারা কোন সিদ্ধান্ত নিলে বেশির ভাগ সময়েই সন্তানকে বলেন না কেন তারা এটা করছেন। এতে সন্তানদের বাবা মায়ের প্রতি বিরূপ ধারনা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পিতামাতার   অতিমাত্রায় কর্তৃত্ব পরায়নতার  জন্য সন্তানদের সাথে দূরত্বের সৃষ্টি হয় । ছেলেমেয়েরা বাইরে কোন কিছু করলে বাবা মাকে তা প্রকাশ করে না শাস্তির ভয়ে। ফলে ছেলেমেয়েদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

2. অনুমতিপ্রাপ্ত(Permissive) : এই শৈলীতে বাবা মা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের দ্বারা পরিচালিত হন। ছেলেমেয়েরা যা চায় যেভাবে চায় সেভাবেই তারা দিয়ে থাকেন। এখানে পিতামাতা কোন শৃঙ্খলা এবং সীমিতকরণ করেন না। ফলে সন্তানরা বুঝতে পারে না তাদের চাওয়া পাওয়ার গন্ডী কতটুকু হওয়া উচিত । এই ছেলেমেয়েদের পরবর্তীতে বাইরের জগতের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রচণ্ড সমস্যা হয়।এই ছেলেমেয়েদের বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও কম থাকে।তারা নিজেদের চাওয়া পাওয়াকেই বড় করে দেখে।

3. অবহেলা ( Uninvolved): এই শৈলীতে সন্তানরা পিতামাতার অবহেলার শিকার হয়। পিতামাতা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সন্তানের ভাল মন্দ কোন কিছুরই খোঁজ রাখেন না। এতে শিশুদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়।তারা বাড়ীর বাইরেও নিজেদেরকে অপ্রত্যাশিত মনে করে। এই সকল শিশুরা প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের আত্ন বিশ্বাসের অভাব থাকে। তারা সহজে সবার সাথে মিশতে পারে না।

4. আধিকারিক (Authoritative): স্বাভাবিক শিশুদের জন্য সর্বাধিক কার্যকরী এবং উপকারী প্যারেন্টিং শৈলী হিসাবে আধিকারিক প্যারেন্টিংকে গণ্য করা হয়। এখানে বাবা মায়ের প্রত্যাশাগুলো সন্তানদের কাছে তুলে ধরা হয়। সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় কেন তারা এটা প্রত্যাশা করছেন। পিতামাতা ছেলেমেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দেন। তারা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধানের চেষ্টা করেন। তারা সন্তানের সফলতা বা ব্যর্থতাকে স্বাভাবিকভাবে দেখেন এবং সন্তানদেরকে উৎসাহিত করেন পরবর্তী ধাপে পা রাখার জন্য।

সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার মতো প্রতিটি পিতামাতাই কমবেশি চিন্তিত।কেন না আমাদেরকেই  নিশ্চিত করতে হবে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ । তারজন্য আমাদেরকেই গড়ে দিতে হবে সুন্দর পথ যেখানে স্বাধীনতা থাকবে, থাকবে সীমাবদ্ধতা। শাসন থাকবে, থাকবে ভালবাসা । বিপদ থাকবে, থাকবে ভরসা। সমস্যা থাকবে, থাকবে সমাধান। আর এ সবকিছুকে নিয়েই এগিয়ে যাবে আমাদের সন্তানেরা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে। যার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি।

(ছবি:-সৌজন্যে Nepal Halkhabar)


আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন