-মোঃ মনিরুজ্জামান

মার্চ মাসের ২১ তারিখ বেলা বারোটার দিকে  আমরা ফ্লোরিয়ানাপোলিস থেকে ব্রাজিলের তথা সারা বিশ্বের একটি অন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণ ইগুয়াজু ওয়াটার ফলস (IGUAZU WATER FALLS) দেখার জন্য ফ্লোরিপা ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ফ্লোরিপা থেকে লাটিম এয়ার লাইনের একটি বিমানে আমরা যখন ফ্লোরিপা ছাড়লাম তখন বিকাল চারটা বাজে। আমরা সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ইগুয়াজু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌছালাম। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শহরে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত হোটেলের উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি নিলাম। হোটেলে পৌঁছে অগ্রিম ভাড়া পরিশোধ করে দোতালায় আমাদের রুমে গেলাম।হোটেলটি ছোট ও অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশের মতো। তবে সুইমিং পুলসহ অন্যানো সব সুবিধা রয়েছে। রোনালদো ও আমি এক রুমে, জন একা এক রুমে ও  মহিলারা নিচতলায় সবাই এক রুমে থাকবে বলে ঠিক হল। রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আমরা নিচের কাউন্টারের কাছে সবাই মিলিত হলাম।

রাতের খাবারের জন্য ভালো রেস্টুরেন্ট কোথায় সেটি হোটেলের কাউন্টারে কর্মরত ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জেনে নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা ইগুয়াজু ডাউন টাউনের কাছে চলে গেলাম। ইগুয়াজু একটি ছোট শহর। সাধারণত বর্ডার অঞ্চলের শহরগুলি এরকমই সব দেশে। ইগুয়াজু ছোট শহর হলেও এটির গুরুত্ব আছে। এ শহর আসলে তিন দেশ ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের মধ্যেবর্তী একটি জায়গা। একারণে এখানে প্রতিদিন অসংখ্য টুরিস্ট দেখা যায়। এ শহরের প্রায় সব রাস্তায় গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল ,রেস্টুরেন্ট,কাফে ও নাইট ক্লাব। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে এসব হোটেল রেস্টুরেন্টের অবস্থান। পথে যেতে যেতে বেশ কিছু ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট দেখলাম। রাত দশটার কাছাকাছি হলেও রেস্টুরেন্ট গুলিতে খাবার জন্য ট্যুরিস্টদের ভিড় লক্ষ্য করলাম।  অবশেষে ফেরার পথে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। এখানেও সেলফ সার্ভিস বুফে আছে। তবে এখানে দাম বেশ চড়া। প্রতি কেজি  ৫৫ রিয়াল। অবশ্য খাবারের ভ্যারাইটি অনেক। আমরা যে যার পছন্দমত খাবার খেয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। হোটেলে পৌঁছে নিচ তলায় সুইমিং পুলের পাশে আরামদায়ক চেয়ারে বসে আমরা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললাম। এসময় আমরা ইগুয়াজুতে আমাদের পরবর্তী তিনদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করে নিলাম। রাত আর একটু গভীর হলে নিজেদের রুমে যেয়ে ঘুমের আয়োজন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে হোটেলের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা ইগুয়াজু ফলস দেখতে যাবো বলে তৈরি হলাম। হোটেল কাউন্টারে আলাদা একটি টেবিল নিয়ে মোটামুটি ইংরেজি জানে এরকম একজন মহিলাকে বসে থাকতে দেখে আমরা তার সাথে কথা বললাম। তার কাজই হোটেলের গেস্টদের ইগুয়াজু ট্যুরে সহায়তা করা। সে  আমাদের ইগুয়াজু ফলস যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি ঠিক করে দিল। সেইসাথে ইগুয়াজুতে আর যেসব টুরিস্ট এট্ট্রাকশন বা দেখার জায়গা আছে তার একটি লিফলেট আমাদের দিল। দেখলাম এখানে ইগুয়াজু ফলস ও ন্যাশনাল পার্ক  ছাড়াও বিশ্বের অন্যতম ও বৃহত্তম হাইড্রোলিক ইলেকট্রিসিটি উৎপাদনের প্লান্ট ,ব্রাজিল ,আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে দিন ব্যাপী শপিং ট্যুর , একটি ‘বার্ড স্যাংচুয়ারি’  ও আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। আমরা প্রথম দিনে ইগুয়াজু ফলস ও ন্যাশনাল পার্ক এবং বার্ড সংক্যুয়ারি দেখবো বলে ঠিক করেছি।

ইগুয়াজু ফলস দেখার জন্য আমরা সকাল দশটায় যাত্রা করলাম।  ইগুয়াজু ফলস শহর থেকে বিশ  কিলোমেরে দূরে। শহর ছাড়ানোর পর পরই রাস্তা দু’দিকে ভাগ হয়ে একটি ইগুয়াজু ন্যাশনাল পার্ক ও অপরটি আর্জেন্টিনা বর্ডারের দিকে যেতে দেখলাম। ড্রাইভার জানালো আমাদের হোটেল থেকে আর্জেন্টিনা বর্ডার পর্যন্ত যেতে আধাঘন্টা মত লাগে। আমরা চাইলে ফলস দেখার পর  সে আমাদের বর্ডারে নিয়ে যেতে পারবে। আমরা তাকে এ বিষয়ে পরে জানাবো বললাম।  ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদেরকে ইগুয়াজু ন্যাশনাল পার্কার গেটের কাছে  টিকেট কাউন্টারে নামিয়ে দিল। ইগুয়াজু ফলস আসলে ইগুয়াজু ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে অবস্থিত। টিকেট কাউন্টারে সব লাইনেই প্রচন্ড ভিড়। টিকেট পেতে আমাদের চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল। টিকেট দেখিয়ে গেট পেরিয়ে দেখতে পেলাম সারি সারি ছাদ বিহীন বিশাল ডবল ডেকার বাসের লাইন। আমরা টিকেটে উল্লেখিত সিরিয়াল নম্বরের বাসে উঠে বসলাম। বাস ন্যাশনাল পার্কের রাস্তার দু’পাশের থেকে ঘন রেইন্ ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করল। অবশেষে বিশ মিনিট পর আমরা ইগুয়াজু ফলস এর পূর্ব প্রান্তের প্রবেশ পথের কাছে বাস থেকে নামলাম। আশেপাশে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় আমার ফলস দেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।  তাই বাস  থেকে নেমেই ফলস দেখার জন্য চওড়া কাঠের নির্মিত ‘ওয়াকওয়ে/ক্যাটওয়াক (হাঁটার রাস্তা)’র দিকে ছুটলাম সবাই।

 

ছবি:- ইগুয়াজু ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ পথে টিকেট কাউন্টারের সামনে থেকে তোলা , ইগুয়াজু,ব্রাজিল

 

 

 

ইগুয়াজু ফলস বা জলপ্রপাত বিশ্বের একটি অন্যতম বিস্ময় হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৮৬ সালে UNESCO এটিকে ‘WORLD HERITAGE AREA’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ব্রাজিলের পারানা (PARANA) স্টেট ও আর্জেন্টিনার মিসিনেস (MISIONES) প্রভিন্সের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ইগুয়াজু নদী থেকে ইগুয়াজু ফলসের উৎপত্তি। ইগুয়াজু নদী আসলে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সীমানা বা বাউন্ডারি বলা যেতে পারে। নদীর অদূরে ইগুয়াজু নামে দু’টি শহর। ব্রাজিলের অংশের নাম FOZ DE IGUAZU ও আর্জেন্টিনা অংশের নাম PUERTO IGUAZU । ইগুয়াজু ফলসের অদূরেই প্যারাগুয়ে বর্ডার ও পারাগুয়ান শহর CIUDAD DEL ESTE। তিন দেশের সম্মিলিত এ অঞ্চলকে “TRIPAL FRONTIER” বলা হয়। 

 

ছবি:-ইগুয়াজু ফলসের প্যানারোমিক ভিউ ,ইগুয়াজু ,ব্রাজিল

 

ইগুয়াজু ফলস দু’দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হলেও ফলসের বেশির ভাল অংশই আর্জেন্টিনার মধ্যে পড়েছে। তবে ব্রাজিলের ওয়াকওয়ে থেকেই ফলস সম্পূর্ণ ও ভালো মত দৃষ্টিগোচর হয়।  পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ও  তিন কিলোমিটার চওড়া ইগুয়াজু ফলসটি ২৭৫ টি ছোটবড় ওয়াটার ফলসের সমন্বয়ে সৃষ্টি। ফলসের পশ্চিম প্রান্ত যেখানে দু’দেশের জলরাশি একত্র হয়ে নিচে পড়ছে সেই জায়গাটিকে বলা হয়  ‘ডেভিলস থ্রট’ (DEVIL’S THROAT) । ইগুয়াজু ফলস আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া ফলস বা আমেরিকা-কানাডার নায়াগ্রা ফলস থেকে অনেক বেশি ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত। ফলসের দু’দিকে  দু’দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই সুন্দর। ফলসের  দু’দিকেই রেনফরেস্ট ও তার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ ওয়াকওয়ে থেকে দর্শনার্থীরা ফলসের সম্মিলিত জলরাশি একেবারে কাছে থেকে দেখতে পারেন। আমরা পূর্ব প্রান্তের ওয়াকওয়ে থেকে হাঁটা শুরু করলাম। ওয়াকওয়ের জঙ্গলের ধার ঘেঁষে নির্মিত। এটির একপাশে জঙ্গল ও ওপর পাশে গভীর ঢাল নেমে গেছে ফলসের জলরাশির কাছে। ওয়াকওয়ে তে মানুষের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে আমরা ফলসের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হাঁটছি। অপরপাশে আর্জেন্টিনা অংশে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও প্রচুর লোকের সমাগম। তবে অতদূরের (প্রায় তিন কিলোমিটার ) সব কিছু খালি চোখে ভালো মত দেখা গেল না।

 

ছবি:-ইগুয়াজু ফলসের  আসে পাশে এ প্রাণীটি সচরাচর দেখা যায়

 

ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় দেখলাম বিভিন্ন রং বেরং প্রজাপতি ,টিয়া পাখি ও নাম না জানা আরো পাখি। এ ছাড়া ছোট এক প্রকার প্রাণী (নাম মনে নাই) যার আকৃতি বড় কাঠ বেড়ালির  মত, তবে মুখমন্ডল অনেকটা শুকরের মত। কিছু খাবারের প্রত্যাশায় আমাদের পায়ের কাছ দিয়ে হেঁটে আমাদের সাথে চলেছে । আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দু’কিলোমিটার যাবার পর জঙ্গলের মধ্যে একটি ক্যাফে তে ঢুকলাম কিছুক্ষণ রেস্ট ও হালকা কিছু স্ন্যাকস খেতে। ওয়াটার ফলসসহ  চারিদিকের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবি তুলতে তুলতে আমরা আবারও হাঁটা শুরু করলাম। এখন থেকে ডেভিলস থ্রোট আরো দেড় কিলোমিটার। পশ্চিম প্রান্ত অর্থাৎ ডেভিলস থ্রোটের দিকে ফলস আরো চওড়া ও পানির প্রবাহ অনেক সর্বোচ্চ। পানির তীব্র গর্জনের জন্য  চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। এক সময় আমরা ডেভিলস থ্রোটের কাছে পৌঁছে গেলাম। দু’দিক থেকে  বিশাল এলাকা জুড়ে হাজার হাজার টন পানি নিচের ঢালে পড়ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আমি ভালো বর্ণনাকারী নই ,তাই সব কিছু ইচ্ছা থাকলেও যথাযথ ভাবে লিখতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পানি যে , আমার দেখা নায়াগ্রা ও অন্যানো ওয়াটার ফলসের তুলনায় ইগুয়াজু ফলস ব্যাপক-বিসতৃত ও অনেক সৌন্দর্যমন্ডিত। নায়াগ্রা ফলস থেকে এটি বেশি উঁচু ও দ্বিগুণ চওড়া । ৮২ মিটার উচ্চতা থেকে ১৫০ মিটার চওড়া ও ৭০০ মিটার দীর্ঘ ‘U -SHAPE’ আকৃতির ওয়াটার ফলস থেকে  প্রতি সেকেন্ডে 450,000 কিউবিক মিটার পানি নিচের ঢালে প্রবাহিত হচ্ছে। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের স্ত্রী ‘ELEANOR ROOSEVELT’ এ ফলস দেখে মন্তব্য করেছিলেন ,”POOR NIAGRA !”

 

ছবি:- ইগুয়াজু ফলসের ডেভিলস থ্রোট (ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা অংশের মিলিত স্থান),ইগুয়াজু ফলস ,ব্রাজিল

 

 

ডেভিলস থ্রোটের প্রান্ত ঘেঁষে দু’টি বড় টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এ টাওয়ারের উপর  থেকে জলরাশির নিম্নে পতনের দৃশ্য কাছ থেকে দেখা যায়। আবার টাওয়ারের ল্যান্ডিংয়ের নিচে দিয়ে ওয়াকওয়ে চলে গেছে একেবারে ফলসের মাঝামাঝি পর্যন্ত যেখান থেকে পানির প্রবাহ  ঢালের মধ্যে একসাথে মিলিত হয়ে নিম্নে ধাবিত হচ্ছে প্রবল বেগে। আমরা প্রথমে টাওয়ারের উপরে উঠলাম সিঁড়ি বেয়ে। উপরে মজবুত রেলিং দিয়ে ঘেরা বিরাট আকারের ল্যান্ডিংয়ে লোকজন ঘোরাফেরা করছে আর ছবি তুলছে। নিচের যেখানে পানি একত্রে পড়ছে সূর্যের আলোতে সেখানে রং ধনুর সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সেখানে বেশ কিছুক্ষন থেকে নিচের মেইন লান্ডিংয়ে নেমে এলাম। এবারে আমরা নিচের ওয়াকওয়ে দিয়ে ফলসের মধ্যেবর্তী স্থানে যেতে মনস্থ করলাম। তবে এত নিচে যেতে চাইলো না এস্থের ও মার্গারেট। রিনালদো  ও জন ল্যান্ডিংয়ের ক্যাফেতে বসে রেস্ট নিতে চাইলো। আমি ও গ্রেস ঠিক করলাম আমরা নিচে যাবো আরো কাছে থেকে উপর থেকে পানি নিচে পড়ে কিভাবে বিশাল আড়োলন সৃষ্টি করছে সেটা আরো কাছে থেকে দেখতে। ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে এলো। পানি এখানে প্রবল বেগে নিচে নেমে মেঘের মতো ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পানির বিন্দু বিন্দু কনা গুলি বৃষ্টির মত ঝির ঝির করে  চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্য দর্শনার্থীরা রেইনকোট পরে এসেছে। আমি ও গ্রেস রেইনকোট আনিনি। তাই আমরা প্রায় ভিজে গেলাম। তবে সেদিকে আমাদের যেন কোনো খেয়াল নাই। আমরা ওয়াকওয়ের শেষ মাথায় নির্মিত লান্ডিংয়ে যেয়ে চারিদিকের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলাম। এখন থেকে আর্জেন্টিনার ওয়াকওয়েতে দর্শনার্থীদের দেখা গেল। আমরা হাত নেড়ে তাদের সম্ভাষণ জানালাম। ও পাশ থেকে তারাও আমাদের সম্ভাষণ জানালো। পানির প্রচন্ড তোড়ের জন্য যে শব্দ হচ্ছে তাতে কাছে থেকে চিৎকার করে না বললে কিছুই শোনা যাচ্ছে না । গ্রেস জানালো তার ফোনে পানি ঢুকে গেছে তাই ছবি তুলতে পারছে না। আমি যেন তার ছবি বেশি করে তুলি এবং তাকে সেগুলি পরে পাঠিয়ে দেই সেটা । আমি ইশারায় তাকে এ ব্যাপারে আশস্ত করলাম এবং তার ও আশেপাশের প্রচুর ছবি তুললাম। একসময়ে সারা শরীর ভিজে গোসল হয়ে গেল। আমি গ্রেসকে ফেরার তাগাদা দিলাম। যেনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে আমার সাথে টাওয়ারের লান্ডিংয়ে ফেরার পথ ধরলো।

 

ছবি:-  ডেভিলস থ্রোটের কাছে ইগুয়াজু ফলসের মধ্যে দিয়ে নির্মিত ওয়াকওয়ের শেষ প্রান্ত ,ইগুয়াজু, ব্রাজিল

 

 

যখন টাওয়ারের কাছে ফিরে এলাম সবাই হাসতে শুরু করলো আমাদের ভিজে কাকতাড়ুয়া চেহারা দেখে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে আমরা দ্রুত টাওয়ারের চেঞ্জ রুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি পরনের পোশাক পাল্টে নিলাম। অতঃপর একসময় রিনালদো আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো ,এখানথেকে এখন বাহির না হলে আমরা পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি করে ফেলবো এবং আমাদের ভ্রমণ প্লানেরও হেরফের হবে। তাই আমরা টাওয়ারের অপর পার্শে উপরের দিকে বাহিরে যাবার পৃথক ওয়াকওয়ে ধরে রওয়ানা হলাম। উপরে যাওয়ার ওয়াকওয়ে দিয়ে উঠতে বেশ পরিশ্রম ও কষ্টসাধ্য। তার পরও ধীরে ধীরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এক সময় মেইন রাস্তার উপর উঠে এলাম। পূর্ব প্রান্তে  যেখানে আমরা বাস থেকেই নেমেছিলাম এখন থেকে সে জায়গা প্রায় তিন কিলোমিটার। এখানে সকল ডাবল ডেকার বাসগুলি দাঁড়িয়ে আছে। মূলত টিকেট কাউন্টার থেকে এপর্যন্তই বাসগুলির শেষ স্টপেজ। ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত দর্শনার্থীদের এখানে বসা ও পানিও পান করার জন্য  বেশ কিছু কাফে ও ফাস্ট ফুডের দোকান দেখা গেল। কিছুক্ষন রেস্ট করে আমরা একটি বাসে উঠে বসলাম। বাস আমাদেরমেইন গেটের  টিকেট কাউন্টারের অপরপাশে নামিয়ে দিল।

ইগুয়াজু ফলস দেখা হটাৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেল। আমার মনে হল অনেক কিছু যেন অসুম্পূর্ণ থেকে গেল। যাইহোক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমাদের সব কিছু করতে হবে। এ সময় বেলা তিনটার কাছাকাছি বেজেছে। আমরা হালকা স্ন্যাকস খেয়ে  ইগুয়াজু ‘BIRD SANCTUARY’ বা পাখির পার্ক দেখতে যাবো বলে স্থির করলাম।  ইগুয়াজু ফলসের মেইনগেট থেকে ইগুয়াজু পাখির পার্ক খুব একটা দূরে নয়। আমরা পায়ে হেঁটেই বার্ড পার্কের গেটে পৌঁছে গেলাম। টিকেট কেটে আমরা সংক্যুয়ারির মধ্যে ঢুকলাম। এটি ইগুয়াজু ন্যাশনাল পার্কের ঘন রেইনফরেস্টের ভিতরে অবস্থিত। এখানে গাছপালার এতো ঘন যে সূর্যের আলো  অনেক স্থানে ঠিক মত পৌঁছে না। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল সমূহে যেসব পাখি বসবাস করে তাদের থাকার উপযোগী করে  এরকম পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। বার্ড সংক্যুয়ারি বলা হলেও এখানে ব্রাজিলের জঙ্গলে সচরাচর দেখা যায় এমন বেশ কিছু জীবজন্তু ও অন্যানো দেশে দেখা যায় এমন অনেক পাখিও এখানে আছে। গেটের কাছে ইনফরমেশন বুথ থেকে বার্ড সংক্যুয়ারির একটি ম্যাপ ও লিফলেট সংগ্রহ করলাম। লিফলেট থেকে জানতে পারলাম এ বার্ড পার্কে ১৫০ প্রজাতির প্রায় ৯০০ পাখি আছে। কোথায় কোন জাতের পাখি বা অন্যানো জীবজন্তু আছে সেবিষয়ে এ ম্যাপ থেকে জানা গেল। সংক্যুয়ারিটি অনেক বড় এলাকা নিয়ে অবস্থিত।

 

ছবি:- ইগুয়াজু বার্ড সংক্যুয়ারির অভ্যান্তরে “A TREE OF LIFE” ,ইগুয়াজু,ব্রাজিল

 

 

জঙ্গলের মধ্যে গাছ পালার ফাঁকে ফাঁকে বড় এলাকাজুড়ে লোহার তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে বিভিন্ন জাতের পাখি পঙ্খী রাখা হয়েছে। সংক্যুয়ারির জোন ” এ ” তে  প্রথমেই দেখতে পেলাম ব্রাজিলের জাতীয় পাখি ‘THE RUFOS- BELLIED THRUSH’(TURDOS RUFIVENTRIS) এর বিশাল খাঁচা। এটি ধূসর বর্ণের একটি ছোট প্রজাতির পাখি। ব্রাজিলে কেউ কেউ আবার এটাকে ‘রবীন’ বলেও ডাকে। এর পরে দেখলাম ম্যাকাও (MACAW ) ও  টুকেন্স (TOUCANS )জাতীয় টিয়া পাখির  বেশ কিছু বাসস্থল। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে  এ পাখি দু’টি  পাখি সচরাচর দেখা যায়। ম্যাকাও পাখিটি দেখতে খুব সুন্দর ও শান্ত শিষ্ট। আমরা একটি পাখির সাথে বেশ কিছু ছবি তুললাম। বার্ড পার্কের  জোন ‘বি’তে দেখলাম বিভিন্ন প্রজাতির কুমির বা কেইমান। এখানে দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলের বিখ্যাত এনাকোন্ডা সাপসহ বেশ কয়েক প্রকার সাপ দেখলাম। বিভিন্ন ধরণের প্রজাপতি দেখলাম বিশেষ একধরণের খাঁচার মধ্যে। দর্শনার্থীরা সেই খাঁচার ভিতরে যেয়ে কাছ থেকে এসব প্রজাপতি দেখার সুযোগ পাচ্ছে ও ছবি তুলছে । আমরা আলো আঁধারের এই সুশীতল পরিবেশে সংক্যুয়ারির বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখছি আর ছবি তুলছি। তবে জঙ্গলের এমন পরিবেশে পাখির বিভিন্ন ধরণের ডাক শুনে খুব ভালো লাগছে । এভাবে বার্ড পার্কের অন্যানো অংশে  হরেক রং বেরংএর পাখি দেখতে  দেখতে আমরা প্রায় তিনঘন্টা ব্যায় করলাম।

 

ছবি:- ইগুয়াজু বার্ড সংক্যুয়ারিতে ম্যাকাও (MACAW ) পাখির সাথে তোলা একটি ছবি ,ইগুয়াজু ,ব্রাজিল

 

বার্ড পার্ক ঐ  দিনের মত বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে আমরাও বেরিয়ে আসলাম। সেদিনের ভ্রমণ কাযক্রম শেষ করে আমরা ট্যাক্সি করে হোটেলে ফিরে  আসলাম। রুম  থেকে ফ্রেশ হয়ে আবার বাহিরে রওয়ানা হলাম রাতের খাবারের জন্য। রাস্তায় এখনও যথেষ্ট লোক সমাগম ও রেস্টুরেন্ট-ক্যাফে খোলা রয়েছে। নাইট ক্লাবগুলি খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তার দু’পাশের  ফুটপাথে ছোট ছোট অস্থায়ী বা পোর্টেবল দোকানে আর্জেন্টিনা  ও প্যারাগুয়ে থেকে আনা বিভিন্ন গিফট আইটেম ,ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও  পোশাক বিক্রি হচ্ছে। চোরাই পথে এসব সামগ্রী আসছে বলে জানা গেল। তবে এসব ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশের কোনো মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হল না। ট্যুরিস্টরা  ভিড় করে এসব দোকানগুলি থেকে কেনাকাটা করছে। আমরা কয়েকটি দোকানে ঢুঁ মেরে দেখলাম এসব সামগ্রী। এস্থের ও মার্গারেট কিছু গিফট আইটেম কিনলো। পরে আমরা একটি সেলফ সার্ভিস বুফেতে ঢুকে রাতের খাবার খেলাম। খাবার পরে বেশ কিছুক্ষন ঘোরাফেরা করে আমরা হোটেলে ফিরে  এলাম। গভীর রাত  পর্যন্ত আমরা সুইমিং পুলের কাছে বসে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলে একসময় যার যার রুমে গেলাম।

ইগুয়াজু ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চের আগে আমরা ইগুয়াজু শহরতলি ও ইটাইপু হাইড্রোলিক ড্যাম (IAIPU HYDROLIC DAM) দেখতে যাবো এবং বিকালে আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে বর্ডার এলাকায় যাবো বলে স্থির করেছি। হোটেলের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করে আমরা হেঁটে ইগুয়াজু শহরের ডাউন টাউন ও সংলগ্ন এলাকা দেখতে বাহির হলাম। উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমরা ডাউন টাউন গেলাম। তখনও দোকানপাট ভালোমত খুলে নাই। শহরটি খুব একটা বড় নয় এবং দেখার মতো উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নাই। তাই আমরা ইটাইপু ড্যাম দেখার জন্য বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। চল্লিশ মিনিট পরে বাস থেকে ড্যামের অদূরে নেমে আমরা হেঁটে ড্যামের প্রবেশ পথে টিকেট কাউন্টারে গেলাম। টিকেট নিয়ে অন্যানো ট্যুরিস্টদের সাথে আমরা ড্যামের উপরে বড় রাস্তায় উঠলাম।

চীনের একটি হাইড্রোলিক ড্যামের পর ইটাইপু ড্যাম বিশ্বের একটি বড় হাইড্রোলিক পাওয়ার প্লান্ট। ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত পারানা নদীর উপরে এ ড্যামটি অবস্থিত। পারানা নদীটি ব্রাজিলের কুরিটিবা পাহাড়িয়া এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে  দুটি শাখায় বিভক্তি হয়ে একটি আর্জেন্টিনা সীমান্তে ইগুয়াজু নদীর সাথে মিলিত হয়ে ইগুয়াজু ফলসের সাথে মিশেছে এবং ওপর শাখাটি ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৬৬ সালের মে মাসে ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে সরকারের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় পারানা নদীর উপর যৌথ উদ্দোগে এ পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করার। আমেরিকা ও ইতালির দুটি প্রতিষ্ঠান এ প্লান্ট নির্মাণ শুরু করে ১৯৭৪ সালে। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের মধ্যে এক ত্রিদেশীয় চুক্তির মধ্যমে ইগুয়াজু ফলসের পানির প্রবাহ ঠিক রেখে ওয়াটার রিজার্ভার লেক ও আনুষঙ্গিক নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। তিন দেশের মধ্যে অনেক দরি দরবার/ নেগোশিয়েশনের পর  ১৯৮৪ সালের মে মাসে ইটাইপু ড্যামের প্রথম জেনেরেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। ইটাইপু ড্যামে ১৮টি বিদ্যুৎ উৎপাদন টারবাইন/ইউনিট আছে। এ ড্যাম থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দ্বারা ব্রাজিলের শতকরা বিশ ভাগ ও প্যারাগুয়ের শতকরা আশি ভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ হয়।

প্রবেশ পথের কাছেই একটি বোর্ডে ইটাইপু ড্যামের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখার জন্য সুনিদ্রিষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া আছে। আমরা সে মোতাবেক ড্যামের উপরিভাগে নির্মিত চওড়া রাস্তা ( যানবাহন চলাচলের জন্য নয়) ধরে হেঁটে হেঁটে দু’পাশের ছবি তুললাম। রাস্তার মাঝ বরাবর একটি বড় লোহার গেট দ্বারা বন্ধ করে ব্রাজিল প্যারাগুয়ে এলাকা পৃথক করা হয়েছে। ড্যামের উপরের রাস্তা থেকে নেমে আমরা নিচে উৎপাদন ইউনিট এলাকা দেখতে গেলাম। এতো কাছে থেকে কোনো বড় পাওয়ার জেনারেটর আমি আগে দেখিনি। ড্যামের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধ ও অবিভুত। সেখান থেকে আর এক তালা নিচে মেইন কন্ট্রোল ও ডিস্ট্রিবিউশন রুমে গেলাম। বিশাল বিসতৃত এ হলঘরের মাঝ বরাবর একটি স্বল্প উঁচু রেইলিং দিয়ে দু’দেশের কন্ট্রোল এলাকা পৃথক করা হয়েছে। রেলিঙের দু’দিকে ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের কর্মচারীগণ ভিন্ন রংএর পোশাক পরে কাজ করছে। জরুরি প্রয়োজনে তারা ওপর পাশে যেয়ে যাতে মতবিনিময় করতে পারে সে জন্য রেলিঙের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গেট আছে। প্রয়োজন অনুযায়ী  কর্মচারীগণ উৎপাদন  ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা মনিটর করতে পারছে । সামগ্রিক ব্যাবস্থাপনা আমার কাছে যথেষ্ট অর্গানাইজ মনে হল।এখানে ছবি তোলা নিষেধ থাকায় আমরা শুধুমাত্র দেখার সুযোগ পেলাম। একসময় আমরা সেখান থেকে উপরে উঠে এলাম। ড্যামের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে আমরা আরো কিছু ছবি তুললাম। ড্যামের বিভিন্ন অংশ দেখে  আমরা এক সময় ফেরার পথে রওয়ানা  হলাম। আমরা বাসে করে যখন ইগুয়াজু শহরে ফিরে এলাম তখন বেলা দুইটা বাজে। দুপুরের খাবার শেষে হোটেলে ফেরার পথে রাস্তার পাশের দোকানগুলি থেকে  ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের সিল ছাপ মারা বিভিন্ন গিফট সামগ্রী কিনলাম।

 

 

ছবি:- ইতাইপু( ITAIPU) হাইড্রোলিক পাওয়ার প্লান্ট ,ইগুয়াজু,ব্রাজিল

 

 

বিকালে আমরা হোটেল থেকে একটি ট্যাক্সি নিলাম  চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে আমরা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বর্ডার ও ব্রাজিল আর্জেন্টিনা প্যারাগুয়ের মিলনস্থল দেখবো । প্রথমেই আমরা ব্রাজিল আর্জেন্টিনা বর্ডারে গেলাম। হোটোলে থেকে আধা ঘন্টার পথ। ইগুয়াজু নদীর উপর ব্রিজ পাড়িয়ে পাশেই আর্জেন্টিনার ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস অফিস দেখা যায়। বিশ্বের  আর সব দেশের ল্যান্ড বর্ডারের মতোই এখানে দু’দেশের ইমিগ্রেশন ,কাস্টমস অফিস ও আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে । শুধু পার্থক্য  বর্ডারের দু’পাশের ভিন্ন ভাষা । ব্রাজিলে সাইডে সবকিছু পর্তুগিজ ও আর্জেন্টিনা সাইডে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। এমনকি এখানে কেহ দুটি ভাষা জানলেও নিজ দেশের ভাষাতেই কথা বলে থাকে। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে কাছের শহর ‘PUERTO IGUAZU’ বেশি দূরে নয়। আর্জেন্টিনার বর্ডার সেদেশের মিসিনেস (MISIONES) প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত । মিসিনেস প্রদেশের রাজধানী শহর  ‘POSADAS’ এখন থেকে চার ঘন্টার পথ। জানতে পারলাম বর্ডার থেকে বাসে আর্জেন্টিনার রাজধানী শহর ‘BUENOS AIRES’ যেতে ১৪ ঘন্টা লাগে। বর্ডারের ওপাশে দেখলাম অনেক সুন্দর ও লাক্সারী বাস দাঁড়িয়ে আছে। অনেক টুরিস্ট ডে ট্যুরে আর্জেন্টিনা যায় শপিং করতে। আমরা ইচ্ছা থাকলেও আর্জেন্টিনা যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি। কারণ ভিসা না লাগলেও বর্ডারে ‘RECIPROCITY FEE’ দিতে হবে ৮৬ মার্কিন ডলার। বর্ডারের দু’পাশের দোকানগুলিতে দু’দেশের পণ্যসামগ্রী সাজানো রয়েছে। আমরা কিছু গিফট আইটেম কিনে বর্ডার দেখার পর্ব শেষ করলাম।

ছবি:- ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের মিলনস্থল “TRIPAL FRONTIER”

আমরা ব্রাজিল সাইডে আরো কিছুক্ষন ঘোড়া ফেরা করে ট্যাক্সি করে তিন দেশের মিলনস্থল দেখতে রওয়ানা দিলাম। বর্ডার থেকে চল্লিশ মিনিটের পথ তিনদেশের মিলনস্থল (TRIPLE FRONTIER) । পারানা  ও ইগুয়াজু যদি যেখানে দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে সেখানেই তিন দিকে এ তিনটি দেশের সংযোগ স্থল। ইগুয়াজু নদী কিছুদূর যেয়ে আরো ঢালু হয়ে ইগুয়াজু ফলসের সাথে না মিশেছে। ফলসের দুপাশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার অবস্থান। অপরদিকে পারানা নদী ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে কে বিভক্ত করে প্রবাহিত হয়েছে। এখানথেকে কয়েক মিলিমিটার দূরেই ব্রাজিল প্যারাগুয়ে বর্ডার ও ইটাইপু ড্যামের অবস্থান। ইগুয়াজু নদীর উপর ‘TANCREDO  NEVES  INTERNATIONAL  BRIDGE’ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে একটি সংযোগকারী ব্রিজ। এ ব্রিজের থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরেই  আর্জেন্টিনার PUERTO IGUAZU শহরের অবস্থান। তবে এ ব্রিজটি দিয়ে দু’দেশে যাতায়াত এখন বন্ধ রয়েছে। এদিকে পারানা নদীর ওপর পারে  নির্মিত ‘LA  AMISTAD  INTERNATIONAL  BRIDGE’ পেরিয়ে ব্রাজিল থেকে প্যারাগুয়ে যাতায়াত করা যায়। প্যারাগুয়ের বর্ডার শহরের ‘CIUDAD DEL  ESTE’ মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে । প্যারাগুয়ের বর্ডার থেকে রাজধানী শহর আসনসিয়েন (ASUNCION) যেয়ে চার ঘন্টা লাগে। তবে আমরা ব্রাজিল প্যারাগুয়ে বর্ডারে যায়নি। ‘ত্রিপল ফ্রন্টিয়ার’ থেকে আমরা এ তিনদেশের বর্ডার ,কাছাকাছি শহর, দুই নদীর সংযোগ স্থল ও আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী যতটুকু সম্ভব দেখলাম। আবহাওয়া ভালো থাকলে ত্রিপল ফ্রন্টিয়ার থেকে সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায়। অনেক দর্শনার্থীই এ সুযোগ নিয়ে থাকেন। আমরাও সূর্যাস্ত দেখে এখান থেকে যাবো ঠিক করেছি। একসময় সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে পেলাম। তিনদেশের মিলনস্থলে ঘন জঙ্গলের মাঝে সূর্যটা আস্তে আস্তে যেনো হারিয়ে গেল। আমাদের অনেকে এই সৌন্দর্যময় দৃশ্যের ছবি তুললো। অন্ধকার আরো ঘন হলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। হোটেলে ফিরে  রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেমে এলাম সুইমিং পুলের কাছে। আজ আর বাহিরে খেতে না যেয়ে সেখানে বসে হোটেল সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারের অর্ডার দিলাম। খাবার পরে আমরা অনেক্ষন সেখানে বসে বিভিন্ন গল্পগুজব করলাম।  তার ১২টার পর রুমে গেলাম ঘুমানোর জন্য।

To be contd /………….

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন